মোয়াজ্জেম হোসেন রাসেল : অনেকটা হঠাৎ করেই যেন আসল খবরটি। বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ (বিপিএল) শেষ হওয়ার পরই বজ্রপাতের মতো খবর আসে দেশের ফুটবল অঙ্গনে। হঠাৎ করেই বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে) থেকে জানা যায়, সব ধরনের ফুটবলীয় কার্যক্রম থেকে নিজেদের সরিয়ে নেওয়ার সিদ্বান্তের কথা জানিয়ে চিঠি দিয়েছে সাইফ স্পোর্টিং ক্লাব লিমিটেড। দ্রুত সময়ের মধ্যে সারাদেশে খবরটা ছড়িয়ে পড়ে। বৈশ্বিক অর্থনীতির কারণে নিজেদের আর্থিক অবস্থার কথা জানিয়ে চিঠিতে আর বর্তমান সময়ে ক্লাব পরিচালনা করা সম্ভব নয় জানিয়ে ফুটবল থেকে সরে যাওয়ার কথা জানানো হয়েছে।
গত জুলাই মাসের শেষদিকে দেশের ফুটবল অঙ্গনে খবর আসে, সাইফ এসসির সরে যাওয়ার সম্ভাবনার বিষয়টি। গুঞ্জনের পালপালা এতটাই প্রশস্ত হয় যে, এখন আর দেশের ফুটবলে নেই সর্বশেষ বিপিএল ফুটবলে তৃতীয় হওয়ার দলটি। অথচ পেশাদার ফুটবলে প্রবেশের পর থেকে চলতি আসরেই সবচেয়ে ভাল ফলাফল করে ক্লাবটি। ঠিক এই সময়েই অনেকটা চমকে দিয়ে এমন সিদ্বান্তের পর নানা আলোচনা শুরু হয়েছে। সাময়িক সময়ের জন্য বলা হলেও আগামী দিনে আদৌ সাইফ এসসি দেশের ফুটবলে ফিরে আসবে কিনা তাতে সংশয় থেকেই যাচ্ছে। নতুন মৌসুমের জন্য দল গুছিয়ে নিলেও এখন আর ফুটবলেই নেই তারা। তবে দ্বিতীয় ফুটবল লিগের গ্রপিং করা হলে সেখানে রাখা হয়েছে সাইফ এসসি যুব দলকে।
অথচ দেশের ফুটবলে প্রথম করপোরেট দলটিকে নিয়ে অনেক বেশি প্রত্যাশা ছিল। বাফুফেকে দেয়া চিঠিতে স্বাক্ষর করেছেন সাইফ এসসির চেয়ারম্যান তরফদার মোহাম্মদ রুহুল সাইফ। তার নামেই ক্লাবটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। তিনি সাইফ পাওয়ারটেক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তরফদার মোহাম্মদ রুহুল আমিনের একমাত্র ছেলে। জানা গেছে, ফুটবলে না থাকলেও দাবা ও অন্যান্য ক্রীড়া কার্যক্রম চালিয়ে যাবে সাইফ পাওয়ারটেক। এর আগে নিজেদের সরে যাওয়ার দিন পনের পূর্বে ফয়সাল আহমেদ ফাহিম ও মেরাজ হোসেনকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত নিজেদের খেলোয়াড় দাবি করে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছিল। আর ২০২১-২২ মৌসুম শেষ হওয়ার পরদিন ফুটবল থেকে নিজেদের গুটিয়ে নেয়ার ঘোষণা দিয়ে যেন সবকিছুই উলট পালট করে দিয়েছে! হয়তো পরিস্থিতি হয়তো আগাম বুঝতে পেরেছিলেন বলেই ফুটবলাররা অন্য ক্লাবের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেছেন। এর আগে ২০১৬-১৭ মৌসুমে বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়নশিপ লিগ (বিসিএল) জয়ের পর দেশের প্রথম কর্পোরেট দল হিসেবে পরের বছর বিপিএলে আবির্ভাব হয় সাইফ এসসির। প্রথমবারই তারকা মিডফিল্ডার হিসেবে জামাল ভূঁইয়াকে দলে ভিড়িয়ে চমক দেখানো শুরু হয়। এই সময়ের মধ্যে দেশ-বিদেশের নামি-দামি ফুটবলার এবং কোচদের দিয়ে দল সাজিয়ে চ্যাম্পিয়নশিপের লড়াইয়েও বেশ অগ্রভাগে থাকলে শিরোপা জিততে পারেনি।
এবার সর্বশেষ প্রিমিয়ার লিগে তৃতীয় হয়েছে সাইফ এসসি। ২০১৭-১৮ মৌসুমে প্রথমবার বিপিএলে অংশ নিয়ে চতুর্থ হয়েছিল ক্লাবটি। শুরু থেকেই ক্লাবটি তারুণ্যনির্ভর দল তৈরি করে এবং বিদেশি কোচ এনে লিগে পাঁচের মধ্যে ছিল। ২০১৮-১৯ মৌসুমে ক্লাবটি হয়েছিল চতুর্থ, ২০২০ সালের পরিত্যক্ত লিগে আবার পঞ্চম স্থানে ছিল দলটি। আর গত লিগে চতুর্থ হয়ে শেষ করার পর সর্বশেষ লিগে জাতীয় দলের সাবেক কোচ আর্জেন্টাইন দিয়েগো আন্দ্রেস ক্রুসিয়ানির অধীনে প্রথমবারের মতো তৃতীয় স্থান লাভ করেছে। ২২ ম্যাচে ১১ জয়, ৪ ড্রতে ৩৭ পয়েন্ট তাদের। সেই দলটিই আগামী মৌসুমে থাকছেনা বাংলাদেশের পেশাদার ফুটবল লিগের সর্বোচ্চ আসরে।
দেশের ফুটবলে আবির্ভাবের সাত বছরের মাথায়ই পাততালি গোটালো সাইফ এসসি। কারোনা ভাইরাস শুরুর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর বৈশ্বিক আর্থিক কারণ দেখিয়ে সবধরণের ফুটবলীয় কার্যক্রম থেকে নিজেদের গুটিয়ে নেয় জামাল ভুইয়ার দল। বাংলাদেশের ঘরোয়া ফুটবলে বেশ ঘটা করে আগমন ঘটার পর ভালোও করছিল নিয়মিত। কিন্তু আর্থিক সংকটের কারণে সাত বছর পার না হতেই বিদায় বলে দিলেন কর্মকর্তারা। ২০১৬-১৭ মৌসুমে ঘরোয়া ফুটবলের দ্বিতীয় স্থর বিসিএলের রানার্সআপ হয়ে প্রিমিয়ার লিগে উত্তীর্ণ হয় তারা। এরপর থেকে দেশি-বিদেশি ভালো খেলোয়াড়, কোচদের সন্নিবেশ ঘটিয়ে শিরোপার জন্য প্রতিবছরই বেশ ফাইট দিচ্ছিল। বাফুফের কাছে দেয়া চিঠিতে সাইফ এসসি কারণ হিসেবে বৈশ্বিক অর্থনীতির পরিস্থিতির কথা তুলে ধরেছিল। তারা বৈশ্বিক মন্দার সঙ্গে পেরে উঠতে না পারায় ফুটবলে মনোযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এ বিষয়ে সাইফ পাওয়ারটেক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তরফদার মোহাম্মদ রুহুল আমিন সংবাদ মাধ্যমকে বলেছেন, ‘সাইফ স্পোর্টিং ক্লাবের সঙ্গে আমি সরাসরি সম্পৃক্ত নই। সাইফ পাওয়ারের বোর্ড অব ডিরেক্টরদের সভায় ফুটবলে না থাকার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আসলে ক্লাবটির পেছনে যে পরিমাণ ব্যয় হচ্ছে তার বিপরীতে প্রত্যাশা মতো রিটার্ন আসছে না। পাশাপাশি গ্রুপের বাণিজ্যিক কাজে ব্যস্ততাও বেড়েছেঅনেক বেশি’। এছাড়া দল পরিচালনায় অনেক সময়ের প্রয়োজন হলেও সময় দেওয়া কঠিন হয়ে যাচ্ছে তাদের পক্ষ থেকে। তাছাড়া বিশ্বজুড়ে সবাই আর্থিক সমস্যায় জর্জরিত থাকায় ফুটবলে পুরোটা দিতে পারছে না তারা। তবে এখন অনেকেই বলছেন, আর্থিক কারণ না কি অন্যকিছু আছে সেই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। বিশেষ করে ফুটবল থেকে সরে দাড়ানোর একদিন আগে কোচ আন্দ্রেস ক্রুসিয়ানির দেয়া শাস্তিও নাকি একটা বড় কারণ? এছাড়া অনেক সময়ই সাইফ এসসির সঙ্গে বিমাতাসুলভ আচরণ করা হতো বলে অভিযোগ ছিল বাফুফের বিরুদ্ধে।
আগামী মৌসুমের জন্য দল গুছিয়ে নিলেও অনেকটা হঠাৎ করে দেশের ফুটবলের সকল কার্যক্রম থেকে সরিয়ে নেওয়ার পর দুশ্চিন্তায় রয়েছেন সাইফ এসসির ফুটবলাররা। বিপিএল ফুটবল শেষ হওয়ার একদিন না যেতেই এমন সিদ্বান্তে চরম হতাশা বিরাজ করছে তাদের মধ্যে। খবরটি শুনে কেউ বিস্মিত, মর্মাহত, আবার কেউ লিগের প্রতিদ্বন্ধিতা নিয়েও শংকা প্রকাশ করেছেন। ২০১৭-১৮ মৌসুমে বিপিএল ফুটবলে অভিষেক হওয়ার পর থেকেই নতুন এই ক্লাবটি গড়ে আসছিল তারুণ্যনির্ভর দল। ক্লাবটিতে ইতিমধ্যে অনেকেই খেলোয়াড় তৈরির একটা ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। সেই ক্লাবটিই এখন ফুটবলে না থাকার খবরটি তাই চরম হতাশার। এই ক্লাবের খেলোয়াড়রা মহা দুশ্চিন্তায় রয়েছেন, বিশেষ করে যে সকল খেলোয়াড়রা আগামী মৌসুমে অন্য ক্লাবের সঙ্গে যোগাযোগ না করে সাইফ এসসিতে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। নিজেদের হতাশার বিষয়ে সাইফ এসসির গোলরক্ষক পাপ্পু হোসেন বলেন, ’ক্লাবের ফুটবল থেকে সরে যাওয়ার সিদ্ধান্তটা শুনেছি সাময়িক। তাই আমরা আশা করতেই পারি, ক্লাবটি ফুটবলে ভবিষ্যতেও আসবে। ক্লাবটি নতুন ক্যাম্প ভাড়া করেছে বলেও আমরা শুনেছি। অনেক খেলোয়াড়ের সঙ্গে কথাবার্তা বলার পর আত্মবিশ্বাস বাড়ছে।’ তবে দুশ্চিন্তায় থাকলেও সবাই যার যার মতো অন্য ক্লাবের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন।
দেশকণ্ঠ/আসো