অর্ণব সান্যাল : এ দেশে এখন কোটি টাকার নাট-বল্টু পাওয়া যাচ্ছে। জানা গেছে, বর্তমানে নাকি আমাদের দেশে চা-নাশতার খরচও কোটির ঘরে। এমন অবস্থার মধ্যেই আমরা নিয়ত শুনছি এগিয়ে যাওয়ার গান। কিন্তু সেই এগোনোটা আসলে কাদের? যে দেশে নাট-বল্টুর দাম কোটির ঘরে, সেখানে পুরো মেশিনের দাম আসলে কত?
ওপরের দুটি প্রশ্ন ধরনের দিক থেকে নতুন নয়। এ দেশে দীর্ঘদিন ধরেই নিয়মিত বিরতিতে এমন প্রশ্নের উদ্ভব হয় জনমনে। মনটা যেহেতু গণের, তাই অগণদের তাতে ভ্রুক্ষেপ থাকে না তেমন। উত্তরও কেউ দেয় না। কারণ, এসবে কান দিলে যে হাত দুটো টেবিলের নিচে আর কর্মক্ষম থাকে না। আর সেটি না হলে নাট-বল্টুর কেজি কোটিতে পৌঁছাবে কী করে?
আজকের পত্রিকায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, সরকারি কেনাকাটায় এই মচ্ছব হয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত সার কারখানা সিলেটের শাহজালাল ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেডে (এসএফসিএল)। লোহা বা স্টিলের এক কেজি নাটের দাম ১ কোটি টাকা। বল্টুর দাম তার অর্ধেক, প্রতি কেজি ৫০ লাখ টাকা। এই তালিকায় আরও আছে এক্সপেন্ডার হুইল। রাবার ও লোহায় তৈরি ছোট আকারের এই ঘূর্ণমান চাকার কেজি পড়েছে ১ কোটি টাকার বেশি। আধা কেজি ওজনের একটি লোহার স্প্রিংয়ের দাম ১৬ লাখ টাকা। এ রকম অস্বাভাবিক দাম দিতে গিয়ে ২৪৩ কেজি ওজনের এই চালানের খরচ পড়েছে সাড়ে ১৪ কোটি টাকা। গত ১৯ ফেব্রুয়ারি চালানটি চট্টগ্রাম বন্দর থেকে খালাস নেওয়া হয়।
এই কেনাকাটায় যে হারে মূল্য দেখানো হয়েছে, সেটির সঙ্গে বাস্তবতার যোগ কতটুকু—তা না হয় আমরা নিজেরাই অনুমান করি। দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নেওয়ার অন্যতম কারণ আসলে কর্তৃপক্ষের উদাসীন ও ধরি মাছ না ছুঁই পানি আচরণ। প্রতিবেদনটি তৈরি করতে গিয়ে সংশ্লিষ্ট বেশ কয়েকজন সরকারি কর্মকর্তার সঙ্গে প্রতিবেদককে কথা বলতে হয়েছিল। সেখানে একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা অন্য আরেকজনের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দিয়েই খালাস। আরেকজন বলেছেন, ‘এটি সরকারি প্রতিষ্ঠান, আর দাম যা-ই হোক, মানি লন্ডারিংয়ের কোনো সুযোগ নেই।’ অর্থাৎ, এ ক্ষেত্রে দাম ‘যা-ই, তা-ই’ বা ‘যেমন–তেমন’ যে হয়েছে, সেটির ইঙ্গিত স্পষ্ট। ওনার কথায় ‘সরল বিশ্বাস’ রেখে না হয় মেনেই নিলাম যে, মানি লন্ডারিং হয়নি। তবে পাল্টা যুক্তিতে বলতে হয়, নাট-বল্টু কেনায় খরচ করা বাড়তি অর্থ দেশের ভেতরেই আছে। বাড়তি টাকা তো গলিয়ে নাট-বল্টুতে মেশানো যাবে না। সুতরাং তা নিশ্চয়ই কারও না কারও পকেটে জায়গা করে নিয়েছে। তা, সেই সমৃদ্ধিশালী পকেটগুলো কি চিহ্নিত করা সম্ভব হবে?
আদতে যে সম্ভব হয় না, তা এ দেশের দুর্নীতির অবস্থা পর্যবেক্ষণ করলেই বোঝা যায়। বার্লিনভিত্তিক দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল নিয়মিত দুর্নীতির সূচক প্রকাশ করে থাকে। গত জানুয়ারিতে প্রকাশিত ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) দুর্নীতির ধারণা সূচক ২০২১-এ জানা গেছে, সর্বোচ্চ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের ক্রমে বাংলাদেশ এর আগে ছিল ১২ নম্বরে। এখন আছে ১৩ নম্বরে। তবে গত তিন বছরের মতো এবারও বাংলাদেশের স্কোর ১০০-তে ২৬। আর সর্বোচ্চ থেকে গণনা অনুযায়ী ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৭। টিআইবির বক্তব্য অনুযায়ী, স্কোর একই থাকায় এ দেশে দুর্নীতির উন্নতি হয়নি। ১০ বছর ধরে অবস্থান একই। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে আফগানিস্তানের পরে দ্বিতীয় সর্বনিম্ন অবস্থানে আছে বাংলাদেশ। টিআইবির প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছিল, এ দেশের আপামর জনগণ দুর্নীতিগ্রস্ত নয়। তারা দুর্নীতির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ও ভুক্তভোগীমাত্র। ক্ষমতাবানদের দুর্নীতি এবং তা প্রতিরোধে ব্যর্থতাই এই ভোগান্তির মূল কারণ।
এখন চলুন দুইয়ে-দুইয়ে চার মেলানো যাক। এ দেশের আপামর জনগণ দুর্নীতিগ্রস্ত নয়, সেটিরও প্রমাণ আছে আজকের পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনেই। খবরে প্রকাশ, শুল্কায়নের জন্য আমদানি চালানের তথ্য চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে দাখিলের পর অস্বাভাবিক দাম দেখে সন্দেহ করেন চট্টগ্রাম বন্দরের কর্মকর্তারা। এরপর চালানটি এক মাস আটকে রাখা হয় বন্দর জেটিতে। পরে পরীক্ষা করতে গিয়ে দেখা যায়, কাগজপত্রে পণ্যের যে পরিমাণ দেওয়া হয়েছে, পণ্য আছে তার কম। আবার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে এক পণ্যের, আনা হয়েছে আরেকটি। এ নিয়ে শুল্ক কর্মকর্তাদের সঙ্গে সার কারখানা কর্তৃপক্ষের অন্তত তিন দফায় বৈঠক করতে হয়েছে। সাধারণ কোনো আমদানিকারক এটা করলে ২০০ শতাংশ জরিমানা করা হতো; কিন্তু সরকারি প্রতিষ্ঠান বলে পার পেয়ে গেছে। এ প্রসঙ্গে নাম প্রকাশ না করার শর্তে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের একজন উপকমিশনার বলেছেন, এভাবে বেশি দামে পণ্য আমদানি করে বিপুল পরিমাণ অর্থ নয়ছয় হয়েছে বলে তাঁরা মনে করেন।
অর্থাৎ, আমাদের দেশে দুর্নীতির বিষবৃক্ষের গোড়া মূলত একটি নির্দিষ্ট উচ্চ ক্ষমতাবান শ্রেণির মধ্যে সীমাবদ্ধ। শুল্ক কর্মকর্তারা দুর্নীতির বিষয়টি আঁচ করতে পেরে তা ঠেকানোর কিছু চেষ্টা করেছিলেন। তাঁদের কেন শেষ পর্যন্ত হাল ছাড়তে হয়েছে, সেটি অনুমেয়। নিশ্চয়ই উচ্চপর্যায় থেকে সবুজসংকেত এসেছে। ক্ষমতার চরিত্রটা এমন যে, এখানে কাঠামোটাই টিকে থাকে উঁচু থেকে নিচে নির্দেশনা প্রবাহের মধ্য দিয়ে। ফলে যে যার নিচে থাকে, তাকে এ অঞ্চলে বিনা বাক্যব্যয়ে নির্দেশ পালনের তালিম নিতে হয় এবং দিতে হয়। আর ঠিক এই প্রক্রিয়ার ভেতরেই দুর্নীতি ডালপালা গজাতে থাকে। কারণ, প্রশ্ন বা জবাবদিহি যেখানে থাকে কম, সেখানেই ক্ষমতার অপব্যবহার হয় চরম। এবং একসময় সেই অনিয়মই নিত্যকার নিয়মে রূপান্তরিত হয়।
অথচ এই কোটি টাকার নাট-বল্টু কিনতে খরচ হয়েছে সাধারণ নাগরিকদের করের টাকা। সেই টাকা আমরা আমজনতা দিই মূলত দেশ গঠনের জন্য, কোনো ক্ষমতার শিখরে কর্তৃপক্ষ সেজে বসে থাকা সরকারি কর্মচারী বা অন্য কোনো তৃতীয় পক্ষের আরাম-আয়েশ বা বিলাসব্যসন নিশ্চিত করার জন্য নয়। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, আমাদের শুধু নিজেদের গরিবি হাল মেনে টিসিবির লাইনে কড়া রোদ বা ঝড়-বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে থাকার দায়! আর কর্তাব্যক্তিরা সেই লাইনের পাশ দিয়েই পাজেরো হাঁকিয়ে যেতে যেতে হয়তো বিরক্তি প্রকাশ করে বলবেন—‘ছোটলোক কোথাকার! কোনো নিয়ম মানে না, লাইনেও হট্টগোল!’
ওপরের কল্পিত উক্তিটি কেন ব্যবহার করলাম, তার ছোট একটা ব্যাখ্যা দিই। গতকাল বাসায় ফেরার পথে চোখে পড়ল টিসিবির এক ট্রাক। চোখে পড়ার আগে কানে বেঁধেছে আসলে। হট্টগোল শুনেই চোখ গিয়েছিল রাস্তার ওপাশে। ব্যাকুল মানুষদের তাড়াহুড়ো দেখে হঠাৎ মনটা বিষিয়ে গেল। পকেটে শূন্যস্থান কতটা হলে কম দামে চাল-ডাল কিনতে ভরসন্ধ্যাতেও লাইনে দাঁড়াতে হয়, সেটি হয়তো কর্তাব্যক্তিরা বুঝতে পারেন না। বুঝলে হয়তো তাঁরা নিজেদের পকেট ভারী করতে গিয়ে গণদের পকেট কাটতেন না।
আর ঠিক এমন অবস্থাতেই আমাদের সহ্য করতে হয় সুখ সূচকে এগিয়ে যাওয়ার আত্মতৃপ্তির ঢেকুর। সুখ সূচকে এগিয়ে যাওয়াই নাকি দেশে সুখ বাড়ার প্রমাণ। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কোটি টাকা কেজি দরে নাট-বল্টু কিনে সুখ আসলে বাড়ছে কাদের? পকেট কাটনেওয়ালাদের এ হেন বাড়বাড়ন্তে আঙুলটা ওদিকে নির্দেশিত হওয়ার সম্ভাবনাই যে বেশি!
দেশকণ্ঠ/আসো # সূত্র : আজকের পত্রিকা; লিঙ্ক : https://www.ajkerpatrika.com/159794