রাজধানী ঢাকার রাস্তায় তীব্র জ্যামে বসে থাকতে থাকতে অনেকেই মন্তব্য করেন, এর চেয়ে হেঁটে যাওয়া ভালো! বিরক্তি নিয়ে কথাটা বললেও, খুব একটা ভুল কিন্তু তিনি বলেন নাই। বরং বলা যেতে পারে সঠিক কথাটি তিনি বলেছেন।
আসুন একটু দেখে আসি, গবেষণা কি বলে? ২০ থেকে ২৯ বছর বয়সী মানুষের হাঁটার গতি ঘণ্টায় ৪.৯ কিলোমিটার। ৩০ থেকে ৫০ ঊর্ধ্ববয়সী মানুষের হাঁটার গতি ঘণ্টায় ৫.১ কিলোমিটার। ষাটোর্ধ্বদের ক্ষেত্রে এই গতি ঘণ্টায় ৪.৮২ কিলোমিটার। আর সত্তরোর্ধ্ব মানুষ ঘণ্টায় হাঁটতে পারেন ৪.৫ কিলোমিটার। এভাবে বিভিন্ন বয়সী মানুষের গড় হাঁটার গতি ঘণ্টায় ৪.৮৩ কিলোমিটার, যা বর্তমানে ঢাকার সড়কে চলা গাড়ির গতির চেয়েও বেশি। অবাক হলেন? যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ব্যুরো অব ইকোনমিক রিসার্চের এক গবেষণায় ঢাকার বিষয়ে এমন তথ্য উঠে এসেছে। গবেষণার সূচকে ঢাকার পয়েন্ট ০.৬০। পরের অবস্থানে নাইজেরিয়ার লাগোস, পয়েন্ট ০.৫২।
বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ‘দ্য ফাস্ট, দ্য স্লো, অ্যান্ড দ্য কনজাস্টেড : আরবান ট্রান্সপোর্টেশন ইন রিচ অ্যান্ড পুওর কান্ট্রিস’ শীর্ষক ওই গবেষণা গত আগস্টে প্রকাশিত হয়। গবেষণায় পৃথিবীর ১৫২টি দেশের এক হাজার ২০০ শহর নিয়ে কাজ করা হয়। অবশ্য, চীন ও উত্তর কোরিয়া গবেষণার আওতায় ছিল না।
গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা ছাড়াও বিশ্বের শীর্ষ ২০ ধীরগতির শহরের তালিকায় বাংলাদেশের ময়মনসিংহ ও চট্টগ্রামের নামও আছে। ময়মনসিংহের অবস্থান নবম, চট্টগ্রাম ১২তম। উল্টো দিকে বিশ্বের শীর্ষ ২০ গতিশীল শহরের ১৯টিই যুক্তরাষ্ট্রে। ২০২০ সালে করা বুয়েটের এক গবেষণায় দেখা যায়, সড়কে ব্যস্ত সময়ে (পিক টাইমে) চলাচল করা যানবাহনের গড় গতি ছিল ঘণ্টায় সাড়ে ছয় কিলোমিটার। ২০২২ সালে এই গতি নেমে এসেছে প্রায় ৪.৮ কিলোমিটারে। উল্টো দিকে শারীরিকভাবে সুস্থ মানুষের হাঁটার গড় গতি প্রতি ঘণ্টায় এর চেয়েও বেশি।
ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে আটকে কর্মঘণ্টা ও জ্বালানির অপচয় হচ্ছে, বায়ুদূষণও বাড়ছে। আর্থিক ক্ষতির প্রভাব পড়ছে দেশের মোট দেশজ উৎপাদনেও (জিডিপি)। যানজটের কারণে ঢাকা বিশ্বের শীর্ষ ধীরগতির শহরে পরিণত হয়েছে। দরিদ্র ও ধনী দেশের তুলনা করতে গিয়ে গবেষণায় দেখা গেছে, গরিব দেশের তুলনায় ধনী দেশের শহরে গাড়ির গতি অন্তত ৫০ শতাংশ বেশি। যে শহরের গতি বেশি সে শহরের মাথাপিছু আয়ও বেশি।
এখন প্রশ্ন আসতে পারে, শব্দ কিংবা পরিবেশ দূষণের পাশাপাশি এই ধীরগতির শহর থেকে মুক্তি মিলবে কিসে? প্রয়োজন, সামাজিক সচেতনতা আর অতি বিলাসিতা পরিহার। ঢাকা শহরের ৮০ ভাগ পরিবহণ এখন ব্যাক্তিগত গাড়ি। ধানমণ্ডি, উত্তরা, গুলশান, বনানী কিংবা বারিধারা, প্রায় প্রতিটি স্কুলে শিক্ষাথীরা আসে ব্যাক্তিগত গাড়িতে, যায় ব্যাক্তিগত গাড়িতে। অভিযোগ আছে, ভর্তির আগে স্কুল থেকে নিশ্চিত হয়, ব্যক্তিগত গাড়ি আছে কিনা! ফলাফল, প্রধান সড়ক থেকে জ্যাম ছড়িয়ে পরে অলিগলিতে। প্রতিটি স্কুলে স্কুল বাস বাধ্যতামূক করা এখন সময়ের দাবী। পৃথিবীর প্রতিটি দেশে আমাদের মতো এভাবে কোন দেশ রাজধানী কেন্দ্রিক নয়। পাশের দেশ ভারতেও অনেক দূর থেকে এসেও মানুষ অফিস করে। দিন শেষে আবার ফিরে যায়। কখনো কখনো সেটা ৮০-১০০ কিলোমিটার দুরেও। আমাদের দেশে সেটা কল্পনার অতীত।
আরেকটি প্রধান সমস্যা, ঢাকায় গাড়ি পার্ক করার জায়গার অভাব! অপরিকল্পিত ভাবে তৈরি ভবনে পারকিং না থাকায় স্কুল কিংবা অফিস-আদালতের সামনের সড়কে রাখা হচ্ছে গাড়ি। হোটেল, রেস্টুরেন্ট কিংবা হাসপাতালেও নেই পর্যাপ্ত পারকিং। এর চেয়েও বড় সমস্যা, দিন দিন মানুষের কমে যাচ্ছে ধৈর্য শক্তি। ফলাফল, চালককে উৎসাহিত করছি নিয়ম ভাংতে। ট্রাফিক আইন অমান্য করে পুরো শহরকে দিয়ে ফেলেছি সুপার স্লো শহরের তকমা! উন্নয়নের জোয়ারে যতই ভেসে যাক প্রিয় শহর, নিজেকে পরিবর্তন না করতে পারলে, ঘণ্টার পরে ঘণ্টা শ্রমঘন্টাই অপচয় হবে। দেশ পড়বে পিছিয়ে।
পথরেখা/আসো