গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’ হিসেবে পরিচিত বিশ্বকাপ শুরু হচ্ছে ২১ নভেম্বর থেকে। এবারের আসর বসছে মরুস্বর্গরাজ্য কাতারে। ম্যাচগুলো মোট ১০টি স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত হবে। আসরে অংশগ্রহণ করবে মোট ৩২ দেশ। মোট ৭১ টি ম্যাচ অনুষ্ঠিত হবে। আসরে ফাইনাল অনুষ্ঠিত ১৬ ডিসেম্বর। প্রতি চারবছর অন্তর অন্তর বিশ্বকাপ ফুটবলের সবচেয়ে বড় আসরটিকে নিয়ে আগ্রহ আর উম্মাদনা আকাশচুম্বি। বিশ্বের নাম দেশে দেশে অনুষ্ঠিত হয়েছে বিশ্বকাপ ফুটবল। সেইসব আসর নিয়ে ধারাবাহিকভাবে জানাচ্ছেন- মোয়াজ্জেম হোসেন রাসেল
১৯৩০ সালে শুরু হয় বিশ্বকাপের প্রথম আসর। তবে বিশ্বকাপের আগে ফুটবলের যাত্রাটা কোন দেশ থেকে তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। অনেকেই খেলাটির জন্মভুমি হিসেবে ইংল্যান্ডের নাম বলে থাকেন। জানা গেছে, ১৩১৪ খ্রিস্টাব্দে রাজা দ্বিতীয় অ্যাডওয়ার্ডের সময়ই ফুটবল খেলার প্রচলন শুরু হয়। সেটাতে অবশ্য রাগবি আর সকার মিলেমিশে একাকার ছিল। সেখানে দু’দলের খেলোয়াড়দের মধ্যে প্রতিনিয়তই মারামারি লেগে থাকত। এরপর একটা সময় ইংল্যান্ডে ফুটবল নিষিদ্ধ ঘোষনার পর অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে পেয়েছে নতুন রুপ। হাতে বল এসে পৌছায় পায়ে, যোগ হয় অনেক নিয়ম কানুন। এরপর বিশ^কাপের আসর মাঠে গড়ানোয়ও রয়েছে ইতিহাস। ১৮৬৩ সালে ইংল্যান্ড ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন (এফএ)। এর ঠিক নয় বছর পর ১৮৭২ সালের ৩০ নভেম্বর ইংল্যান্ড-স্কটল্যান্ডের মধ্যকার প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়। হাজার চারেক দর্শকের সেই আন্তর্জাতিক ম্যাচটির পর ফুটবল পায় নতুন মাত্রা। ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। তবে ইংরেজরা কখনোই চায়নি ফুটবলের বিস্তারটা দুনিয়াজুড়ে হোক। একটা সময় এসে খেলাটির জনপ্রিয়তা দেখে এগিয়ে আসে অলিম্পিকের আন্তর্জাতিক সংস্থা আইওসি। যার সুত্র ধরে ১৯০০ ও ১৯০৪ সালের গ্রীস্মকালীন অলিম্পিকে ফুটবল খেলাটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আনুষ্ঠানিক মর্যাদা না থাকায় সেটা ছিল প্রদর্শনী ম্যাচ। এর মধ্যেই ১৯০৪ সালে ফ্রান্স, বেলজিয়াম, স্পেন, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, ডেনমার্ক, নেদারল্যান্ড এই ৭ দেশ মিলে ঐতিহাসিক সিদ্বান্তের মাধ্যমে প্রথমবারের মতো গঠন করা হয় বিশ^ ফুটবলের সর্বোচ্চ সংস্থা ফিফা। ফরাসী ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের তখনকার প্রেসিডেন্ট রবার্ট গুয়েরিনই নির্বাচিত হন ফিফার প্রথম সভাপতি। শুরুতে না থাকলেও ১৯০৬ সালে ইংল্যান্ড ফিফায় যোগদান করে। এরপর তাদের আগ্রহেই ১৯০৮ অলিম্পিকে ফুটবল আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি লাভ করে। ১৯১৪ সালে অলিম্পিকের সাথে চুক্তির পর ১৯২০ সালে আয়োজন করা হয় আন্তঃমহাদেশিয় ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপের। ১৯২১ সালে ফিফার প্রেসিডেন্ট হন ফ্রান্সের জুলে রিমে। ১৯২৬ সালে প্রস্তাবনার পর ১৯২৮ সালে সিদ্বান্ত হয়, বিশ্ব ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপ আয়োজন করবে ফিফা।
১৯৩০ সালের প্রথম বিশ্বকাপের জন্য ফ্রান্সহ কয়েকটি দেশ স্বাগতিক হওয়ার দাবী রাখে। কিন্তু তখনকার ফুটবলে আন্তর্জাতিক সাফল্য, অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর যাবতীয় খরচ বহনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে সবার চেয়ে এগিয়ে থেকে বিশ্বকাপের আয়োজন হয় উরুগুয়ে। ১৯২৪ ও ১৯২৮ সালের অলিম্পিকের স্বর্ণ জেতা দক্ষিণ আমেরিকার দেশটি ২৩-৫ ভোটে আয়োজক হওয়ার পাশাপাশি প্রথম বিশ্বকাপের শিরোপাও জয় করে। তখনকার ৪১ টি দেশ ফিফার সদস্য হলেও ইউরোপের অনেক দেশ উরুগুয়ে দুরের দেশ বলে বিশ্বকাপে অংশ নেয়নি। এরপর অনেক নিয়ম পরিবর্তন করে আয়োজিত হয়েছে ২১টি বিশ্বকাপ। শুধুমাত্র ১৯৪২ ও ১৯৪৮ সালের দুটি আসর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে আয়োজন করা সম্ভব হয়নি। এর আগে ও পরে চার বছর পরপরই অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে বিশ্বসেরা আসর। এবার ২২তম আসরের জন্য প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ আয়োজন করছে কাতার। এবার দেখে নেয়া যাক ফেলে আসা ২১ টি আসরের সার সংক্ষেপ।
১৯৩৮ দ্বিতীয় আসর : ইতালির টানা দ্বিতীয় শিরোপা জয়
দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধে ডামাডোলের মধ্যেই নানা বিতর্কিত ঘটনার মধ্যদিয়ে বিশ্বকাপ ফুটবলের তৃতীয় আসর অনুষ্ঠিত হয় ফ্রান্সে। প্রথমবার আয়োজক হয়েও শিরোপা জিততে পারেনি দেশটি। টানা দ্বিতীয়বারের মতো শিরোপা জিতে দারুণ এক অর্জন করে বসে আজ্জুরিরা। বিশেষ করে প্রথম আসরের রানার্সআপ আর্জেন্টিনা শত চেষ্টা করেও আয়োজক হতে না পেরে বিশ্বকাপে খেলবেনা বলে পরিস্কারভাবে জানিয়ে দেয়। প্রতিবেশি দেশ উরুগুয়েও হাটে আর্জেন্টিনার দেখানো পথেই। এরপর মেক্সিকোও শেষ মুহুর্তে নাম প্রত্যাহার করে নেওয়ায় সুযোগ ঘটে ক্যারিবীয় অঞ্চলের কিউবার। ফিদেল ক্যাষ্ট্রোর দেশটি এরপর আর কখনোই বিশ্বসেরা আসরে খেলতে পারেনি। এছাড়া গৃহযুদ্ধের কারণে ইউরোপের দেশ স্পেনও অংশ নেয়নি। হিটলারের দেশ জার্মানী রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে অষ্ট্রিয়া দখলে নিলে সব খেলোয়াড়ও তাদের হয়ে যায়। দলটির সবচেয়ে বড় তারকা ম্যাথিয়াস সিন্ডলার জার্মানীর হয়ে খেলতে অপারগতা প্রকাশ করার পর তার লাশ পাওয়া যায়।
তবে সে সময় প্রচার করা হয়েছিল তিনি নাকি আত্বহত্যা করেছেন। বিশ্বকাপের তৃতীয় আসরে এসে এশিয়ার প্রথম দেশ হিসেবে সুযোগ পায় ইন্দোনেশিয়া। তবে তারা ডাচ ইন্ডিজ নামে অংশ নিয়েছিল। ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন ইতালি ও স্বাগতিক ফ্রান্স সরাসরি আর ৩৬টি দল থেকে ১৩টি আসে বাছাইপর্ব খেলে। ব্রাজিল ৬-৫ গোলে পোল্যান্ডকে, হাঙ্গেরি ৬-০ গোলে ডাচ ইন্ডিজকে এবং সুইডেন ৮-০ গোলে কিউবাকে পরাজিত করে। গোলরক্ষকরা কতটা অসহায় ছিলেন সেটা গোলের পরিসংখ্যানে যথেষ্ট। আসরের ১৮টি ম্যাচের ৮টিতেই গোল হয়েছে কমপক্ষে ৬টি করে। বলা যায় যোগ্যথম দল হিসেবেই চ্যাম্পিয়ন হয় তারা। ফাইনালে হাঙ্গেরিকে ৪-২ গোলে পরাজিত করে নান্দনিক আর শৈল্পিক খেলা দিয়ে। আগের আসরের মতো এতটা রক্ষনাত্বক খেলা তারা খেলেনি।
তবে আসরের আলোচিত দল বলা যেতে পারে ব্রাজিলকে। দুর্দান্ত খেলে বিশ্বকাপে জায়গা করে নিয়ে গ্রুপ পর্ব থেকে শুরু করে সেমিফাইনাল পর্যন্ত দারুণ খেলে। ৫ ম্যাচে প্রতিপক্ষের জালে ১৪ গোল দিয়ে শিরোপার অন্যতম দাবিদারও হয়ে যায় তারা। দারুণ সব পাস আর দর্শনীয় ফুটবল দিয়ে নিজেদের প্রতিটা ম্যাচেই প্রমাণ করে থাকে। কোচ আসরে ৭ গোল করে সর্বোচ্চ গোলদাতা হওয়া লিউনিডাকে সেমিফাইনালে বসিয়ে রেখে ম্যাচ হেরে যায়। এছাড়া অন্য তারকাদের পূর্ন বিশ্রামে দেওয়ার কারণে সুযোগটা এসে যায় ইতালির সামনে। তারা সেই সুযোগে ২-১ গোলে জিতে ফাইনালে জায়গা করে নেয়। এরপর তো শিরোপাই জিতে নেয়। এতটা ঘটনার বিশ্বকাপ আর কখনোই অনুষ্ঠিত হয়নি। যা সে সময়ের অনেকের মানসপটে ভেসে ওঠে।
এক নজরে আসর
স্বাগতিক : ফ্রান্স
চ্যাম্পিয়ন : ইতালি (টানা দ্বিতীয়বার শিরোপা জয়)
রানার্সআপ : হাঙ্গেরি
সময়কাল : ৪-১৯ জুন ১৯৩৮
অংশগ্রহকারী দলসমুহ : মোট ১৫টি দল (ইতালি, নরওয়ে, ব্রাজিল, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, পোল্যান্ড, চেকোস্লোভাকিয়া, নেদারল্যান্ড,হাঙ্গেরি, ডাচ ইস্ট ইন্ডিজ, সুইজারল্যান্ড, জার্মানী, সুইডেন, কিউবার ও রোমানিয়া) মোট ভেন্যু : ১০টি (১০ শহরে)
মোট ম্যাচ : ১৮ টি
মোট গোল : ৮৪ টি (ম্যাচ প্রতি ৪.৬৭)
সর্বোচ্চ গোলদাতা : লিউনিডাস (চেকোস্লোভাকিয়া) ৭টি
মোট দর্শক উপস্থিতি : ৩৬৯৭২০ (ম্যাচ প্রতি গড়ে ২০৫৪০)