মোয়াজ্জেম হোসেন রাসেল : এশিয়া কাপ ক্রিকেটের বর্তমান চ্যাম্পিয়ন কোন দেশ, এটা বোধহয় অনেকেই ভুলতে বসেছেন। বিশ্বকাপ বাছাইপর্ব খেলতে নামার আগে আগে এশিয়া সেরা হয়েছিল শ্রীলঙ্কা। এরপরই জিম্বাবুয়ের মাটিতে সাবেক এই বিশ্বচ্যাম্পিয়ন দলটিকে নিজেদের প্রমাণ করে তবেই ভারতের টিকিট পেতে হয়েছে। সাফল্যের ধারাবহিকতা ধরে রেখে আবারও এশিয়া কাপের ফাইনালে উঠেছে ধাসুন শানাকার দল। শাষরুদ্ধকর ম্যাচে পাকিস্তানকে ২ উইকেটে হারিয়ে শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচে ভারতকে পেয়েছে স্বাগতিকরা। অথচ কত সমস্যার মধ্যদিয়ে দল গড়তে হয়েছিল। ‘ইতিহাস নিজেই নিজের পুনরাবৃত্তি ঘটায়’, বহু ক্লিশে এই কথা শোনেননি এমন মানুষ খুবই কম। কথাটা আবারও বলতে হচ্ছে এশিয়া কাপ প্রসঙ্গে। ২০১৮ থেকে ২০২৩-গত পাঁচ বছরে তিন এশিয়া কাপেই ভারত-পাকিস্তান ফাইনাল হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা ছিল। ফিকশ্চারই যে সাজানো হয়েছিল এভাবে। তবে কোনোবারই তা সফল হয়নি। গতবারের মতো এবারও এশিয়ার দুই চিরপ্রতিদ্বন্ধীর ফাইনাল হওয়া ভন্ডুল করে দিল শ্রীলঙ্কা। দুইবারই সবাইকে চমকে দিয়ে ফাইনালে উঠেছে লঙ্কানরা।
আর এবারের এশিয়া কাপে শ্রীলঙ্কাকে নিয়ে বাজি ধরার লোক হয়তো কমই ছিলেন। বাজি ধরবেনই বা কীভাবে, লঙ্কানদের যে ২০২৩ বিশ্বকাপের টিকিট কাটতে হয়েছে বাছাইপর্ব খেলে। তার ওপর এশিয়া কাপ শুরুর আগে ওয়ানিন্দু হাসারাঙ্গা, দুষ্মন্ত চামিরা, দিলশান মাদুশঙ্কের মতো বেশ কয়েকজন তারকা ক্রিকেটার পড়েছেন চোটে। এ কারণে একদম শেষ মুহূর্তে গিয়ে দল ঘোষণা করতে হয় শ্রীলঙ্কাকে। দুনিথ ভেল্লালাগে, মাথিসা পাথিরানা, চারিথ আসালাঙ্কাদের মতো তরুণদের নিয়ে এশিয়া কাপ খেলতে যায় লঙ্কানরা। শুধু তাই নয়, কুশল মেন্ডিস, ধনঞ্জয় ডি সিলভার মতো নিয়মিত ক্রিকেটারদের অফফর্ম বাড়িয়েছে আরও দুশ্চিন্তা। ফাইনাল তো দূরের পথ, দাসুন শানাকার শ্রীলঙ্কার কাছে তখন নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখাই ছিল মূল চ্যালেঞ্জ। তবে জহুরির চোখ বলে তো একটা কথা আছে। এশিয়া কাপ শুরুর আগেই ওয়াসিম আকরাম বলেন, ‘ভারত-পাকিস্তান ম্যাচে সবারই নজর থাকে। সেটা সত্যিই। কিন্তু অন্যান্য দলগুলোও তো এশিয়া কাপ খেলতে এসেছে। তাই আপনি বাংলাদেশ বা শ্রীলঙ্কাকে হিসাবের বাইরে রাখতে পারবেন না।’ বাংলাদেশ পারেনি ঠিকই।
তবে লঙ্কান ক্রিকেটাররা পাকিস্তানি কিংবদন্তির ভবিষ্যদ্বাণীর যথার্থতা কিছুটা হলেও প্রমাণ করতে পেরেছে। আসালাঙ্কা, ভেল্লালাগে, পাতিরানারা দেখিয়েছেন চাপ সামলে কীভাবে লড়তে হয়। টানা ১০ ওয়ানডে জয় নিয়ে এবারের এশিয়া কাপ খেলতে গিয়েছিল শ্রীলঙ্কা। শুধু তাই নয়, এই দশ ম্যাচে প্রতিপক্ষকে অলআউট করার রেকর্ড ছিল শ্লীলঙ্কানদের। যা ছিল তখন অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে যৌথ সর্বোচ্চ। গ্রুপ পর্বে বাংলাদেশকে অলআউট করে রেকর্ডটা পুরোপুরি নিজের করে নেয় লঙ্কানরা। পাথিরানা, মাহিশ থিকসানাদের দুর্দান্ত বোলিংয়ের সঙ্গে সাদিরা সামারাবিক্রমা, আসালঙ্কার জোড়া ফিফটিতে হেসেখেলে ৫ উইকেটের জয় পায় লঙ্কানরা। এই জয়ে টানা ১১ ওয়ানডে জয়ের রেকর্ড গড়ে শ্রীলঙ্কা। পরের ম্যাচে আফগানদের বিপক্ষে ম্যাচটা ছিল আরও রুদ্ধশ্বাস। অফফর্মে থাকা মেন্ডিস এ দিন করেছেন দুর্দান্ত এক ফিফটি। আর ভেল্লালাগের পারফরম্যান্সও ছিল দারুণ। ৮ নম্বরে নেমে ৩৩ রানের ইনিংস খেলেন। মাহিশ থিকসানার সঙ্গে তাঁর ৬৪ রানের জুটি লঙ্কানদের এনে দিয়েছে ৩০০ ছুঁই ছুঁই স্কোর। আর বোলিংয়ে নিয়েছেন জোড়া ধাক্কা।
মাত্র ২ রানের রুদ্ধশ্বাস জয়ে সুপার ফোর নিশ্চিত করে লঙ্কানরা। সুপার ফোরে আবারও তারা পায় বাংলাদেশকে। বাংলাদেশের বিপক্ষে ম্যাচটি ছিল লঙ্কানদের জন্য নিজের রেকর্ডটা সমৃদ্ধ করার। গ্রুপ পর্বের মতো এবারও জ্বলে উঠেছিলেন সাদিরা, পাথিরানা। সঙ্গে দাসুন শানাকা, ভেল্লালাগের বোলিং ভেল্কিতে কুপোকাত বাংলাদেশ। ২১ রানে জিতে টানা ১৩ ওয়ানডে জয়ের রেকর্ড গড়ে লঙ্কানরা। তাতে দক্ষিণ আফ্রিকা, পাকিস্তানের টানা ১২ ওয়ানডে জয়ের রেকর্ড ভেঙে দেয় লঙ্কানরা। এশিয়া কাপ ফাইনালে উঠে এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিলকে (এসিসি) যেন কড়া জবাব দিল শ্রীলঙ্কা। কলম্বোতে বৃষ্টির পূর্বাভাস জেনেও সুপার ফোরের ম্যাচ কলম্বো থেকে সরায়নি আয়োজকেরা। উপরন্তু টুর্নামেন্টের মাঝপথে এসে নিয়ম বদলায় এসিসি। সুপার ফোরে শুধু ভারত-পাকিস্তান ম্যাচের জন্যই রাখা হয় রিজার্ভ ডে। এমনকি গতকাল বৃষ্টির বাগড়ায় পড়া শ্রীলঙ্কা-পাকিস্তান ‘অলিখিত সেমিফাইনাল’ ম্যাচ যে করেই হোক চালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল। কেননা, যে জিতবে সেই মুখোমুখি হবে ভারতের। আর শ্রীলঙ্কা-পাকিন্তান ম্যাচ বৃষ্টিতে ভেস্তে গেলে রানরেটের হিসেবে বাদ পড়ে যাবে পাকিস্তান। ফলে ভারত-পাকিস্তান ফাইনাল তো হচ্ছে না। একারণে তাই স্থানীয় সময় সাড়ে ১২টা পেরিয়ে গেলেও খেলা হয়েছে।
আর পুরোটা ম্যাচজুড়ে প্রেমাদাসার গ্যালারীতে ছিল ‘শ্রীলঙ্কা, শ্রীলঙ্কা’ স্লোগান। ভক্ত সমর্থকদের হতাশ করেনি লঙ্কান ক্রিকেট দল। মেন্ডিস, সাদিরা, আসালাঙ্কারা রুদ্ধশ্বাস ম্যাচ জিতে নিজেদের নিয়ে গেলেন ফাইনালে। একই সঙ্গে যেন ২০২৩ বিশ্বকাপে বিপক্ষ দলগুলোকে ‘প্রচ্ছন্ন হুমকি’ই দিয়ে রাখল লঙ্কানরা। বর্তমান সময়ে শ্রীলঙ্কার সবচেয়ে বড় তারকা ক্রিকেটার কে? চোখবন্ধ করে বলে দেওয়া যাবে ওয়ানিন্দু হাসারাঙ্কার নাম। সর্বশেষ লঙ্কান প্রিমিয়ার লিগের কথাই ধরা যাক, নিজ ফ্রাঞ্চাইজিকে শিরোপা জিতিয়েছিলেনই, সেই সঙ্গে সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি ও সর্বোচ্চ রানসংগ্রাহক এমনকী সবচেয়ে বেশি ছক্কা হাঁকানোর রেকর্ডও নিজের দখলে নেন। আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারেও লঙ্কানদের বড় ভরসার নাম হাসারাঙ্গা। জিম্বাবুয়ের মাটিতে ভারত বিশ্বকাপ বাছাইয়ে ব্যাট-বলে দুর্দান্ত পারফরম্যান্সে দলকে চ্যাম্পিয়ন করেছিলেন। অথচ এই তারকা স্পিন অলরাউন্ডারকে ছাড়াই এশিয়া কাপে খেলতে নামতে হয় লঙ্কানদের। এবার শিরোপায় চোঁখ তাদের।
পথরেখা/আসো