পথরেখা অনলাইন : নরওয়ের মধ্যস্থতায় ৩০ বছর আগে ফিলিস্তিনি ও ইসরায়েলিরা একটি শান্তিচুক্তি করেছিল। হোয়াইট হাউজের রোজ গার্ডেনে তৎকালীন মর্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের উপস্থিতিতে চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তির আওতায় পশ্চিম তীর, গাজাসহ কয়েকটি ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রণ ফিলিস্তিনিরা পায়। গঠিত হয়েছিল ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ বা পিএ। পিএর প্রতিষ্ঠাকালীন প্রধান ছিলেন একসময়ের বিপ্লবী ও গেরিলা নেতা ইয়াসির আরাফাত। বর্তমানে তার উত্তরসূরি হিসেবে আছেন ৮৭ বছর বয়সী মাহমুদ আব্বাস। হামাস নিয়ন্ত্রিত গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের চলমান হামলায় তিনি এখনো পর্যন্ত হামাসকে সহযোগিতা করতে এগিয়ে আসেননি। এ কারণে তাকে নিয়ে পশ্চিমা দেশগুলো, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র বিশেষ আশাবাদী যে সংঘাত-পরবর্তী গাজার দায়িত্ব তাকে দেওয়া যেতে পারে।
গত মাসে গাজা নিয়ন্ত্রণকারী ফিলিস্তিনি গ্রুপ হামাস ইসরায়েলে অতর্কিত হামলা চালানোর পর এই সংঘাতের সূত্রপাত হয়। এতে এখনো পর্যন্ত প্রায় ১২ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে, যাদের বেশির ভাগই নারী ও শিশু। আহত হয়েছে প্রায় ৩০ হাজার। প্রথম দিকে পশ্চিমা বিশ্ব ইসরায়েলকে আকুণ্ঠ সমর্থন দিলেও পরে সুর নরম করে। কারণ ইসরায়েলি হামলায় আহত-নিহতদের বেশির ভাগই নিরীহ সাধারণ মানুষ। বিশেষ করে শিশু। সংঘর্ষের তীব্রতা কমে এলেও এখনো থামেনি। উত্তর গাজার একটি অংশ দখলে নিয়েছে ইসরায়েল। বিশেষ করে ছিটমহলটির সবচেয়ে বড় হাসপাতাল আল-শিফা এখন ইসরায়েলি ডিফেন্স ফোর্সের (আইডিএফ) পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে। যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের প্রতি সর্বাত্মক সমর্থন জানালেও যুদ্ধ যত দীর্ঘায়ত হবে, ওয়াশিংটনের জন্য সেটা কূটনৈতিক সমস্যা তৈরি করবে।
ওয়াশিংটন আশা করেছিল, ইসরায়েল ও সৌদি আরবের মধ্যে একটি সমঝোতা হবে। মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতি শান্ত থাকবে। চীন ও এশিয়ার অন্যান্য অঞ্চলের প্রতি মনোযোগ নিবদ্ধ করা যাবে। কিন্তু চলমান সংঘাত তাদের সেই পরিকল্পনায় বাধা তৈরি করেছে। মনে হচ্ছে যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর সেখানে হামাসের কর্তৃত্বের অবসান ঘটবে। পিএ প্রধান আব্বাস সেই দায়িত্ব পাবেন। বর্তমানে আব্বাস রামাল্লায় থেকে পশ্চিম তীর দেখাশোনা করছেন। তার এই ক্ষমতা মূলত আনুষ্ঠানিক। পশ্চিম তীরে হামাস ও ইসলামিক জিহাদের মতো মিলিশিয়া গ্রুপগুলো যেন প্রাধান্য বিস্তার করতে না পারে, সেটা ইসরায়েল নিয়ন্ত্রণ করে।
চুক্তি অনুযায়ী পিএ অস্ত্র সমর্পণ করেছে অনেক আগেই, তাদের নিজস্ব কোনো নিরাপত্তা বাহিনীও নেই। আইডিএফই পশ্চিম তীরের নিরাপত্তা দেখে। তাদের হাতে নিয়মিত নিরস্ত্র ফিলিস্তিনিদের রক্ত ঝরছে। বর্তমান যুদ্ধ গাজাকে কেন্দ্র করে ঘটলেও ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে গত দেড় মাসে শতাধিক ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনিরা ইসরায়েলি হামলার প্রতিবাদে রাস্তায় বিক্ষোভ করেছে। আব্বাস ইসরায়েলি হামলার নিন্দা জানিয়েছেন, তবে তিনি হামাসের পাশে দাঁড়াননি। তিনি আগে থেকেই জনপ্রিয়তার সংকটে ছিলেন, চলমান সংঘাত তার জনপ্রিয়তাকে একেবারে তলানিতে নিয়ে গেছে।
গাজায় হামলা শুরুর পর মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টোনি ব্লিনকেন দুই দফা মধ্যপ্রাচ্য সফর করেছেন। রামাল্লায় আব্বাসের সঙ্গে তার আলোচনা হয়েছে। ব্লিনকেন বলেছেন, ভবিষ্যতে গাজায় পিএর ভূমিকা হবে গুরুত্বপূর্ণ। আব্বাস বলেছেন, গাজার দায়িত্ব নিতে পিএ প্রস্তুত আছে, কিন্তু তা হতে হবে একটি কাঠামো চুক্তির আওতায়। যে চুক্তি একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করবে। বহির্বিশ্বে পিএ-ই ফিলিস্তিনি জনগোষ্ঠীকে প্রতিনিধিত্বকারী একমাত্র বৈধ সংগঠন। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলোর যাবতীয় সহায়তা ফিলিস্তিনিরা এর মাধ্যমেই পেয়ে থাকে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটির কোনো ভূখণ্ড কার্যকরভাবে পরিচালনার ক্ষমতা নাই। আব্বাস অনেক আগেই তার ফাতাহ দলের সামরিক শাখা বিলুপ্ত করেছেন। সশস্ত্র লড়াইয়ের ধারণাও তিনি ঘোষণা দিয়ে ত্যাগ করেছেন।
ফিলিস্তিনিদের বেশির ভাগই মনে করে, সশস্ত্র লড়াই ছাড়া স্বাধীনতা বা স্বায়ত্তশাসনও অর্জন করা যাবে না। শান্তিবাদী দৃষ্টিভঙ্গির জন্য আব্বাস পশ্চিমে যথেষ্ট জনপ্রিয়, যদিও নিজের জনগণের কাছে তার জনপ্রিয়তা এখন ২০ শতাংশেরও নিচে। আব্বাস ২০১২ সালে বলেছিলেন, ফিলিস্তিনিদের কোনো রাষ্ট্র গঠিত হলেও তিনি সেখানে বিভিন্ন দেশে থাকা শরণার্থীদের ফিরে আসা সমর্থন করবেন না। নিজের পরিবারেরও ফিরে আসার পক্ষে তিনি থাকবেন না। আব্বাসের পরিবারও ১৯৪৮ সালে পূর্বপুরুষের ভিটা থেকে উত্খাত হয়েছিল।
অনেকে প্রশ্ন তুলছেন, অসলো শান্তিচুক্তির কোনো কার্যকারিতা অবশিষ্ট আছে কি না। পিএ গঠিত হয়েছিল অন্তর্বর্তী ব্যবস্থা হিসেবে। বাস্তবতার দৃষ্টে এটি স্থায়ী রূপ পেয়েছে। মনে হয় যেন এটাই ফিলিস্তিনিদের যাবতীয় সমস্যার একমাত্র সমাধান। ইসরায়েলিরাও মনে করে যে গাজা প্রকাশ্যে দখলে নেওয়ার পরিবর্তে পিএর হাতে তুলে দেওয়া বরং ভালো। সেক্ষেত্রে আরব ও বাইরের দুনিয়াকে এই বার্তা দেওয়া যাবে যে গাজা ইসরায়েলিরা দখল করেনি, বরং তা ফিলিস্তিনিদের হাতেই আছে।
পথরেখা/আসো