ড. রাজিয়া সুলতানা : বিজয়ের মাসের ৪ ডিসেম্বর ছিল ঐতিহাসিক ধানুয়া কামালপুর হানাদার মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে পাক হানাদার বাহিনীর শক্তিশালী ঘাঁটি কামালপুরে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করেছিল। দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে বরাবরের মতো এবারও হানাদার মুক্ত দিবস পালন করা হয়েছে। স্থানীয় বীর মুক্তিযোদ্ধা, জামালপুর জেলা প্রশাসন ও উপজেলা প্রশাসনের সম্মিলিত উদ্যোগে দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করা হয়েছে। এই দিবস উপলক্ষ্যে ধানুয়া কামালপুর উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। এ ছাড়া দিনব্যাপী বর্ণাঢ্য র্যালি, দেবিমূলে পুস্পস্তবক অর্পণ করা হয়। স্থানীয় শিল্পীদের পরিবেশনায় আয়োজন করা হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। বিপুল সংখ্যক সাধারণ মানুষ এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়েছিল।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জামালপুর জেলা প্রশাসক মো. শফিউর রহমান। এ ছাড়া আরো উপস্থিত ছিলেন বকশীগঞ্জ উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আব্দুর রউফ তালুকদার, বীর মুক্তিযোদ্ধা মো সুজাত আলী, বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মফিজ উদ্দিন, বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মজিবর রহমান, বকশীগঞ্জ উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. আতাউর রাব্বী, বকশীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকতা আব্দুল আহাদ খান, ধানুয়া কামালপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মো. মশিউর রহমান লাখপতি প্রমুখ। আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন বকশীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার অহনা জিন্নাত।
প্রধান অতিথি জামালপুর জেলা প্রশাসক মো. শফিউর রহমান বলেছেন, ‘মুক্তিযুদ্ধকালে ধানুয়া কামালপুর ছিলো ১১ নং সেক্টরের আওতায়। মুক্তিযোদ্ধাদের তুমুল আক্রমণে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে এ ঘাঁটির হানাদাররা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। এ ঘাঁটি দখলের মধ্য দিয়ে শেরপুর, জামালপুর, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল ও দেশের উত্তর মধ্যাঞ্চলের জেলাগুলোসহ ঢাকা বিজয়ের পথ সহজ হয়ে যায়।’ তিনি আরো বলেন, ‘শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে বিডিআরের নিজস্ব অর্থায়নে ধানুয়া কামালপুর স্মৃতি সৌধ নির্মাণ করা হয়েছে। ডিসেম্বর মাস এলেই বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মিলন মেলায় পরিণত হয় ধানুয়া কামালপুর। কামালপুর রণাঙ্গন সন্দেহাতীতভাবে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম কালের সাক্ষী। কামালপুরের যুদ্ধ যেমন ঐতিহাসিক; তেমনি পাক হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণও ইতিহাস সমৃদ্ধ।’
আলোচনা সভায় মুক্তিযোদ্ধারা বলেন, পাক হানাদার বাহিনী মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে এখানে শক্তিশালী ঘাঁটি গড়ে তুলেছিল। তাদের মূল টার্গেট ছিল উত্তর রণাঙ্গনের ১১ নম্বর সেক্টরের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের আঘাত হেনে যে কোনো মূল্যে ওই ঘাঁটি দখল করা। কামালপুর রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধাদের সাহসী আক্রমণ ও প্রতিরোধের মুখে আজ ৪ ডিসেম্বর কমান্ডার আহসান মালিকসহ ১৬২ জন পাক হানাদার বাহিনীর সদস্য আত্মসমর্পণ করে। এখানে খণ্ড খণ্ড যুদ্ধে ১৯৭ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়েছেন, আহত হয়েছেন অসংখ্য। অন্যদিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ২২০ জন সেনা নিহত হয়েছেন।’
সভাপতির ভাষণে বকশীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার অহনা জিন্নাত বলেছেন, ‘জাতীয়ভাবে ৪ ডিসেম্বর ধানুয়া কামালপুর মুক্তদিবস পালন করা হয়। এখানে পাক হানাদার বাহিনীর সঙ্গে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সরাসরি যুদ্ধ হয়েছে। কামালপুর রণাঙ্গন মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী হয়ে রয়েছে। কামালপুর যুদ্ধে অনেকেই শহিদ হয়েছেন; গুলিবিদ্ধ হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন। পাকিস্তানি বাহিনী নির্লিপ্তভাবে মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষকে হত্যা করে বিভিন্ন স্থানে গণকবর দিয়েছে। গণকবরগুলো যথাযথভাবে সংরক্ষণও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।’
কামালপুর মুক্ত দিবস সাদামাটাভাবে পালন শুরু হলেও এখন রাষ্ট্রীয়ভাবে পালিত হচ্ছে। বাড়ছে এর সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় গুরুত্ব। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকেও এই দিবসের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করা হয়েছে। তারাও নিজেদের নানাভাবে সম্পৃক্ত করছে। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম আনুষ্ঠানিক বিজয় এসেছিল ধানুয়া কামালপুর রণাঙ্গন থেকেই। স্থানীয় প্রশাসনও আন্তরিকভাবে দিবস উদযাপন করে আসছে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস-ঐতিহ্যের অন্যতম বিজয়সারণী হয়ে রয়েছে কামালপুর রণাঙ্গন।
পথরেখা/আসো