পথরেখা অনলাইন : লিওনেল মেসি ও ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর মধ্যকার লড়াইটা বেশ পুরনো। বিশেষ করে যখন বার্সেলোনা ও রিয়াল মাদ্রিদে খেলতেন তখন দ্বৈরথটা ছিল চোঁখে পড়ার মতো। দুজনই এখন ইউরোপ ছেড়ে ভিন্ন মহাদেশের বাসিন্দা হয়েছেন। মেসি যেখানে মার্কিন যুক্তরাস্ট্রে সেখানে রোনালদো ঘাটি গেড়েছেন সৌদি আরবে। ফুটবল গোলের খেলা হওয়ায় সেই গোলের হিসেবে ২০২৩ সালে বিশ্ব তারকাদের মধ্যে শীর্ষে ছিলেন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। একই সঙ্গে গড়েছেন আন্তর্জাতিক ফুটবলে সবচেয়ে বেশি ম্যাচ খেলার রেকর্ড। ২০২২ সালের দুঃসহ স্মৃতি পেছনে ফেলে রোনালদো নিজেকে ফিরে পেয়েছেন স্বমহিমায়। ২০২২ সাল পর্যন্ত বিশ্ব ফুটবলে সেরার প্রশ্নে ভক্তদের চায়ের কাপে ঝড় তুলেছে রোনালদো আর লিওনেল মেসি বিতর্ক। তবে কাতার বিশ্বকাপের পর সেই বিতর্ক অনেকটাই ঢাকা পগে গেছে। ৩৬ বছর পর আর্জেন্টিনাকে বিশ্বকাপ এনে দিয়ে মেসি এখন সর্বকালের সেরা ফুটবলার হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার দাবিদার। আর কাতার বিশ্বকাপের ব্যর্থতায় পর্তুগালের ‘মহানায়ক’ যেন হয়ে পড়েছেন পার্শ্বচরিত্র! যদিও ২০২৩ সাল রোনালদোর জন্য কেটেছে স্বপ্নের মতো।
আড়ালের দেশে থাকলেও আলোটা ঠিকই কেড়ে নিয়েছেন এই পতুর্গিজ। জীবনের ৩৮টি বসন্ত পেছনে ফেলে আসার পরও ফুটবলের সবুজ ময়দানে সাবলীল রোনালদো ছুটছেন টগবগে তরুণের মতো। ক্লাব আর আন্তর্জাতিক ফুটবল মিলিয়ে গোল করেছেন ৫৪টি। কিলিয়ান এমবাপ্পে, আর্লিং হালান্ড, হ্যারি কেনদের ছাপিয়ে রোনালদো ২০২৩ সালের সর্বোচ্চ গোলদাতা। শীর্ষ গোলদাতার প্রতিযোগিতায় রোনালদোর সঙ্গে টক্কর দিয়েছেন ৫২ গোল করা কেন আর এমবাপ্পে। হালান্ড করেছেন ৫০ গোল। ২০১১ সাল থেকে পাঁচটি বছর রোনালদো শেষ করেছেন শীর্ষ গোলদাতা হিসেবে। এ সময়ে মেসি আর রবার্ট লেভানডভস্কি দুবার করে বছর শেষ করেছে শীর্ষ গোলদাতার মর্যাদা নিয়ে। কাতার বিশ্বকাপে ব্যর্থতা আর ২০২৩ সালের শুরুতে ইউরোপ ছেড়ে সৌদি আরবের আল নাসর ক্লাবে যোগ দেওয়ায় রোনালদোকে অনেকেই ফেলে দিয়েছিলেন বাতিলের খাতায়।
কিন্তু পারফরমার যেখানেই থাকুক না কেন তার দ্যুতি ছড়াবেই। রোনালদোর মতো গ্রেট ফুটবলাররা যে অন্য ধাতুতে গড়া। নিজেকে প্রমাণে মরিয়া সিআর-সেভেন খ্যাত রোনালদো যেন নিজের সেরাটাই দিলেন বছর জুড়ে। দেশের হয়ে ইউরো বাছাই পর্বে করলেন ১০ গোল। একমাত্র দল হিসেবে টানা ১০ জয়ে পর্তুগালকে নিয়ে এলেন ইউরো-২০২৪-এর চূড়ান্তপর্বে। সঙ্গে প্রতিযোগিতার সর্বোচ্চ ৮ গোল করে আল নাসরকে জিতিয়েছেন আফ্রো-আরব চ্যাম্পিয়নশিপ ক্লাব কাপ। তার ক্যারিয়ার গোল এখন ইতিহাসের সর্বোচ্চ ৮৭২টি। ৮২১ গোল নিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে মেসি। সমস্যা হচ্ছে, পর্তুগাল আর আল নাসরের হয়ে লাগাতার গোল করেও রোনালদো ছিলেন আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিবঞ্চিত। ২০২৩ সালে রোনালদোর চোখের সামনে দিয়ে ব্যালন ডি’অর আর ফিফা অ্যাওয়ার্ড নিয়ে গেছেন তার প্রবল প্রতিপক্ষ মেসি। উয়েফা আর আইএফএফএইচএসের বর্ষসেরা হয়েছেন হালান্ড। রোনালদো ছিলেন না সংক্ষিপ্ত তালিকাতেও। তাই বছরের সেরা গোলদাতা হয়েও রোনালদো নিভৃতে ‘হাহাকার’ করেছেন নিঃসন্দেহে। যা তাকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে।
সে হিসেবে নতুন বছরেও একই ধারা বহমান থাকবে। তবে ২০২৪ সালে উয়েফা ইউরো চ্যাম্পিয়নশিপ রোনালদোর সিংহাসন পুনরুদ্ধারে সহায়ক হতে পারে। মেসির সামনেও রয়েছে কোপা আমেরিকা জয়ের মাধ্যমে নিজেকে আরও উঁচুতে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ। ২০২৩ সালে মেসিও কম যাননি। পিএসজি, ইন্টার মিয়ামি আর আর্জেন্টিনার হয়ে তার গোলের সংখ্যা ৪০টি। আমেরিকার ক্লাবে যোগ দিয়েই জিতেছেন লিগ কাপ; যা মিয়ামির ইতিহাসের প্রথম ট্রফি। ১০ গোল করে আসরের সেরা গোলদাতা হয়েছেন। প্রাপ্তির খাতায় যোগ হয়েছে ব্যালন আর ফিফা বেস্ট অ্যাওয়ার্ডসহ বেশকিছু পুরস্কার। সব মিলিয়ে বছর জুড়ে মেসি ছিলেন আলোচনার শীর্ষে। আগামী ১৪ জুন থেকে মাঠে গড়াচ্ছে ইউরো চ্যাম্পিয়নশিপ। ২৪ দেশ নিয়ে জার্মানির মাটিতে অনুষ্ঠিতব্য টুর্নামেন্টের অন্যতম ফেভারিট পর্তুগাল। ২০১৬ সালে ইউরো চ্যাম্পিয়নশিপের সুবাদেই রোনালদো জিতেছিলেন প্রথম আন্তর্জাতিক ট্রফি। জিতেছিলেন ব্যালন, ফিফা আর উয়েফার স্বীকৃতি। যদিও বিশ্ব ফুটবলের রাজা হিসেবে নিজেকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে রোনালদোর সামনে ইউরো জয়ের কোনো বিকল্প নেই। মেসিও জুন-জুলাইয়ে আর্জেন্টিনার হয়ে অধিনায়কের আর্মব্যান্ড নিয়ে নামছেন কোপা আমেরিকায়।
যার মধ্যে ২০২১ সালে কোপা আমেরিকা মেসিকে দিয়েছিল আন্তর্জাতিক শিরোপার প্রথম স্বাদ। ২০২৪ সালেও মেসির আর্জেন্টিনা হট ফেভারিট। ১৬ দল নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে মেসিবাহিনী লড়বে টানা দ্বিতীয় কোপা আমেরিকা জয়ের লক্ষ্যে। লক্ষ্য পূরণ হলে মেসি শুধু রোনালদো না, ইতিহাসের মহানায়কদের ছাড়িয়ে এককভাবে শ্রেষ্ঠত্বের মালিকানায় নিজেকে সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে নিয়ে যেতে সক্ষম হবেন। তা ছাড়া মেসির জন্য ২০২৪ সালের কোপা আমেরিকা হতে পারে বিদায়ী আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট। ২০২৬ সালের বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার খুদে জাদুকর খেলবেন, নিশ্চয়তা নেই। এটা ঠিক, মেসির ক্যারিয়ারে পাওয়ার কিছু বাকি নেই। কিন্তু ক্যারিয়ার সায়াহ্নে কোপা আমেরিকার মতো আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে তিনি নিজেকে ফের উজাড় করে দেবেন, এটা নিশ্চিত। তাইতো দুজন দুই মহাদেশে থাকলেও দ্বৈরথটা সেই পুরনোই রয়ে গেছে।
পথরেখা/আসো