১৯৭৭ সনের ৮ মে বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি থেকে পাসড আউট হই। আমরা আর্মিতে যাবার আগ্রহসহ সবকিছুই মেজর হাফিজ বীর বিক্রমের প্রচেষ্টাতে। তিনি নিউমার্কেট থেকে ডগার ব্রাদার্সের বই নিয়ে এসে আমাকে আর্মিতে যাবার পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত করান। আমার বাবা মরহুম শামসুদ্দিন ছিলেন সাব-রেজিস্ট্রার। বাবা অনেক সৌখিন ছিলেন, বাগান করতেন। হরিণ পালতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ছিলেন হকি ও ফুটবল দলের ক্যাপ্টেন। আজ যেমন আবাহনী আর মোহামেডান তখন ওয়ারি ক্লাব আর ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাব ছিল মাঠের চুম্বক শক্তি। বাবা ভিক্টোরিয়ার হকি ও ফুটবল ক্যাপ্টেন ছিলেন।
দেরাদুন আর্মি একাডেমিতে গেলেন। দাদীমা উমদা খাতুন জেনেই একাডেমিতে জানালেন ছেলেকে আর্মিতে দিতে তিনি অনিচ্ছুক। দাদা ওসমানউদ্দিন সেই আমলের ডাক সাইটে পুলিশ ইন্সপেক্টর হলেও তিনি বিপ্লবী সূর্যসেনের ভক্ত ছিলেন। একাডেমি থেকে নিয়ে এসে দাদীমা গেলেন একে ফজলুল হকের কাছে এবং বাবার জন্য সাব-রেজিস্ট্রার চাকরির নিশ্চয়তা নিয়েই ফেরত আসেন।
বাবা চাকরির সাথে সাথে ফুটবল টিম করতেন। জাকারিয়া পিন্টু, গজনবী, নূরুন্ন্নবী, মেজর হাফিজ মানে ঐ সময়ের সব শ্রেষ্ঠরাই খেলতেন। সুতরাং এমন পরিবেশই আমাকে খেলোয়াড় হতে সাহায্য করেছে। মা বেগম সালেহা চাকলাদার বহুল প্রচলিত বেগম আর সওগাতে নিয়মিত লিখতেন। বাবার পোস্টিং তখন গৌরনদীতে। এক হিন্দু গণক আমার হাত দেখে বলেছিল আমি আর্মিতে যাব। যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ পড়ছি তখন মনে মনে গণককে মিথ্যুক ভাবতাম। আমি হকি প্রাকটিস শেষে মোহামেডান ক্লাবে যেতাম। হাফিজ ভাইও ফুটবল প্রাকটিস শেষে ক্লাবেই আসতেন। আমার বাবা আর মেজর হাফিজের বাবা ডক্টর আজাহার বন্ধু ছিলেন। দাদু পুলিশ ইন্সপেক্টর হিসেবে ভোলাতে পোস্টিং ছিল। দুইজন গভমেন্ট স্কুলে এক ক্লাসেই পড়তেন। মেজর হাফিজ বাবাকে ভীষণ শ্রদ্ধা করতেন; সেই হিসেবে আমাকে বেশ স্নেহ করতেন।
শেষমেষ গণকের কথাই বাস্তব হল আমি আর্মিতে গেলাম। আমি সিলেক্টেড হই এসএসসি থার্ড এর সাথে। যখন আইএসএসবিতে যাব। সেখানে তিনদিন থাকতে হয় এবং চল্লিশ পঞ্চাশ থেকে দশ বারো জন সিলেক্ট হয়। হকির অন্যতম স্টার সাব্বির ভাই আমাকে ফরিদপুরের হয়ে জাতীয় হকি চ্যাম্পিয়শিপ খেলে তারপর বিএমএতে যেতে বলে। আমি আর্মি অথরিটির কাছে আবেদন করে এক কোর্স পরে যোগ দিবার আবেদন করি। আবেদন একসেপ্ট হয়। জাতীয় হকি হয়েছিল রাজশাহীতে আর আমরাই চ্যাম্পিয়ন হই।
যে দিন প্রথম বিএমএ তে যাই। সবাই স্যুট টাই পরে গিয়েছিলাম। মেজর হাফিজ আমাকে কেডস পরে যেতে বলেছিল। বললাম হাফিজ ভাই স্যুটের সাথে কেডস? বললেন— গেলে টের পাবে। আমাদের রেলস্টেশন থেকে নিয়ে আসা গাড়ি বিএমএ গেটে দাঁড়াল। ভিতরে যায় না কেন। বলতেই বলা হল আপনেদের রিসিভ করতে জিসিরা আসবেন। দেখি আমাদের অগ্রজ মানে এসএসসি থার্ডের জিসি মানে জেন্টেলম্যান ক্যাডেটরা আসলেন। উনারা টপ অব দ্য ভয়সে সাউট করে নামতে বললেন— থতমত খেয়ে নামলাম। আর শুরু হলো বিশেষ কায়দায় অভ্যর্থনা। আমাকে বিএমএ ওয়াল থেকে কমপক্ষে বিশ বার লাফ দিতে হল। মাঠে দৌড় করতে হল আর নর্দমায় নামিয়ে হাঁটু দিয়ে হাঁটতে হল। এসব কমই। যাদের নর্দমাতে না নামিয়ে পিচের রাস্তাতে হাঁটু দিয়ে হাঁটাল তারাতো যায় যায় অবস্থা। এ সব হতে হতেই বলল— চেঞ্জ ইন টু সিভিস এবং ডিনার টাইম বলে দিল। ডিনার খাচ্ছি, হঠাৎ হু আর দ্য পিউপেল প্লেয়িং গিটার। হয়েছে কি কাটা চামচে টুংটাং আওয়াজ হচ্ছে। খাওয়া বন্ধ। ফল ইন দ্য গ্রাউন্ড। ফল ইন হলাম। ঝাকা-নাকা খেয়ে আবার ডাইনিং হলে। এক সিনিয়র আমার কাছে এসে বলল— তুমি স্যুটের সাথে কেডস পরে ছিলে; ওভারস্মার্ট? তুমি রাত দশটায় মাঠে দু চক্কর দিবে। তখন ক্যাডেটরা দুই কোম্পানিতে বিভক্ত ছিল। বীর শ্রেষ্ঠ জাহাঙ্গীর আর বীর শ্রেষ্ঠ রব কোম্পানি। আমি রব কোম্পানির। এদের মধ্যে বিভিন্ন প্রতিযোগিতা লেগেই থাকত। বক্সিং আমার অপোন্যান্ট ছিল শওকত জামাল। ব্রিগেডিয়ার হিসেবে অবসরে, ওর নাক মুখ ফাটিয়ে দিয়েছিলাম। শ্রেষ্ঠ বক্সার হয় মোস্তফা ও প্যাল্স্টিয়ান ক্যাডেটকে তুমুল লড়াইর পর হারিয়েছিল। বিএম এ থেকে ছুটির দিনে চিটাগং শহরে আসা ছিল একমহা তৃপ্তির বিষয়। তবে নির্দেশ ছিল তাদের বাছাই করা স্থান সমূহের বাইরে নয়। আর সেল্যুটিং টেস্ট পাশ না করতে পারলে শহরে যাবার অনুমতি ছিল না। বিএমএর ভিতর এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় নো হাঁটা-হাঁটি। দৌড়ের উপর যেতে হবে।
বাসায় বন্দুক আছে। প্রচুর পাখি মারতাম তবে রাইফেলে একটাই বুলেট। ১০০ গজ দূরে মাটিতে পর পর হেলমেট রেখেছে। লাগলে হেলমেট ডিগবাজি খাবে। রাইফলে এই প্রথম— অনভ্যস্ত; গুলি লাগলই না। স্টাফ বলল গুলিগুলতো নষ্ট করলেন। বললাম লাগলেও ত নষ্টই হত। স্টাফ বললেন, আপনিত দেখি আধ্যাত্মিক কথা বলেন। প্যাক -০৮ নেন; আর ঐ যে পাহাড়ের উপর চির উন্নত মম শির লেখা দেখা যায়। ওখানে গিয়ে জোর আওয়াজে দশবার বলবেন চির উন্নত মম শির। প্যাক-০৮ এ দশ ইঞ্চি আটটা ইট পিঠে নিয়ে পাহাড়ী পথ বেয়ে পৌঁছলাম। দেখলাম প্যারেড গ্রাউন্ডে বেশ কজন। আওয়াজ করে চির উন্নত মম শির বললাম। দশবার বলার পরও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখলাম দূর সমুদ্র। অপরূপ শোভা। তারপর নেমে আসলাম। এত শাস্তি এত নিয়ম শৃঙ্খলা সব মিলিয়ে পরে বুঝেছি। এ সবের দরকার ছিল; এ জন্যেই যে এক এক জন এক এক পরিবেশ থেকে এসেছে। তাই এ দলাই মলাই আর ঝাকুনিতে সব ভুলে এক হয়ে যাওয়া।
৮ মে রাওয়া ক্লাবে আমরা সবাই এক হয়ে পুরানো সব স্মৃতি হাতরালাম। আমাদের সাথে চারজন প্যালেস্টেনিয়ান ক্যাডেট ছিল। আমরা আমাদের ১৬ জন কোর্স মেট চিরকালের জন্য হারিয়েছি। সিদ্ধান্ত নিলাম আগামী বছরের ৮ মে মিলব আবার এক সাথেই। আমাদের সবারই বয়স হয়েছে। এখন পুরান দিনের কথাগুলো হল বড় সম্পদ।
স্মৃতিসুখ আর কষ্ট; সব নিজ নিজ ভল্টে থেকে যায়। বয়স এর কাছে হার মানতেই হবে। ৪৭ বছর পার হল বিএমএ সেই সময়ের তরতাজা টগবগে দিনের স্মৃতি জাগানিয়া গল্পে গল্পে। হারকিউলিস ট্রাইড ইন ভেইন ট্যু ওভার কাম ওল্ড এজ। লিখতে লিখতে মনে মনে গেল রবীঠাকুরের গানের কয়েকটি কলি—
যখন পরবে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে,...
তখন আমায় নাইবা মনে রাখলে,
তারার পানে চেয়ে চেয়ে নাইবা আমায় ডাকলে।’
লেখক : সাবেক হকি অধিনায়ক জাতীয় এবং সেনাবাহিনী দল, জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার জয়ী এবং কলামিস্ট
পথরেখা/আসো