পথরেখা অনলাইন : আজাদ আজমীর (৩) জ্বর ছিল। সাথে শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়। আজাদের মা ভেবে পান না কি করবেন। শেষ পর্যন্ত তাকে হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক কিছুক্ষণ পরীক্ষার পর বুঝতে পারেন, আজাদের নিউমোনিয়া হয়েছে। সম্প্রতি ‘আইসিডিডিআরবি’-এর এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, ‘বাংলাদেশে প্রতি বছর শিশুমৃত্যুর (পাঁচ বছর বয়সের নিচে) শতকরা ২৮ ভাগ ঘটছে নিউমোনিয়ার কারণে।’
‘নিউমোনিয়া’ হলো ফুসফুসের এক ধরণের সংক্রমণ। যাতে অ্যালভিওলাই নামে ফুসফুসের ক্ষুদ্র বায়ুভরা থলিগুলোতে তরল ও পুঁজ জমা হয়। এই সংক্রমণের ফলে ফুসফুস ফুলে ওঠে এবং নিঃশ্বাস নেওয়ার ক্ষমতাকে কমিয়ে দেয়।ফলে, অক্সিজেন গ্রহণে সমস্যা হয়। এই রোগ মূলত শিশু এবং বয়স্কদের বেশি দেখা যায়। কেন না, এই বয়সে তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে বলে সহজেই এই রোগ আক্রমণ করে। শীতে এই রোগ বেশি হলেও বছরব্যাপী এটা হয়ে থাকে।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের শিশু বিভাগের সহযোগি অধ্যাপক ডা. আল আমিন মৃধা বলেন, ‘সব সর্দি-কাশিই নিউমোনিয়া নয়। যখন জ্বর এবং এর সাথে কফ ও শ্বাসকষ্ট থাকে তখন শ্বাসতন্ত্রের প্রদাহ হয়েছে বলে ধরা হয়। দুই মাসের নিচের শিশুর শ্বাস-প্রশ্বাসের হার মিনিটে ৬০ বারের বেশি, এক বছরের নিচে ৫০ বা এর বেশি এবং ১-৫ বছর বয়সের শিশুর ৪০ বার বা এর বেশি শ্বাস-প্রশ্বাস হলে তাকে শ্বাসকষ্ট বলে। তাই জ্বর-কাশিতে আক্রান্ত শিশু এ রকম ঘন ঘন শ্বাস নিলে বা শ্বাসের সাথে বুক বা পাঁজর নিচে দেবে যেতে থাকলে তাকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘শিশুর শ্বাসকষ্ট বেশি হলে,খাবারের পর সবকিছু বমি করে দিলে, খিঁচুনি হলে বা অজ্ঞান হলেও দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে। দুই-তিন সপ্তাহের মধ্যে এ রোগ সেরে যায়। দুই বছরের নিচে শিশুকে এ সময় বুকের দুধ দেয়া বন্ধ করা যাবে না।’ ডা. মৃধা পরামর্শ দেন, ‘এ সময় শিশুকে চুলার ধোঁয়া, মশার কয়েল ও সিগারেটের ধোঁয়া থেকে দূরে রাখতে হবে।’
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে ডিরেক্টরেট জেনারেল অব হেলথ সার্ভিসের হেলপ লাইন ডিরেক্টর শামসুল হক ডা. হক বলেন, ‘সরকার ইতিমধ্যে নিউমোনিয়ায় শিশু মৃত্যুর হার কমানোর জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। যেমন, নিউমোনিয়ার টিকা ইপিআই টিকার সাথে দেওয়া হচ্ছে।
‘হেল্পিং বেবি’স ব্রেথ’ নামে একটি কর্মসূচি আছে, যাতে শিশু জন্মের এক মিনিটের মধ্যে তার নিঃশ্বাস নেয়ার জন্য প্রয়োজনীয় কাজ করা হয়। মায়ের দুধ শিশুর জন্য সবচেয়ে পুষ্টিকর এবং সঠিক খাবার। এ বিষয়েও মায়েদের সচেতন করা হয়। মায়ের ত্বকের সংস্পর্শে থাকলে শিশু ভালো থাকে। এজন্য শিশুর কোনো সমস্যা হলে একটানা ২০ ঘণ্টা মায়ের সাথে তাকে বেধে রাখা হয়। দুই কেজি ওজনের কম ওজন নিয়ে শিশু জন্মালে তাকে মায়ের বুকের সাথে বেধে রাখা হয় (এ পদ্ধতিটি ‘ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার’ বা ‘কেএমসি’ নামে পরিচিত)। এ ছাড়া যেসব শিশু ৭০০-৯০০ গ্রাম ওজন নিয়ে জন্মায় তাদেরকে ‘কেনো’ নামে একটি বিশেষ চিকিৎসা সেবার আওতায় নেয়া হয়। এ সব কিছুই শিশুর শ্বাসকষ্ট বা নিউমোনিয়ার সাথে সম্পর্কিত এবং এগুলো কার্যকর পদ্ধতি।
তিনি আরও বলেন, ‘শিশুর শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে কিনা কিংবা সে মায়ের দুধ টেনে খেতে পারে কিনা ইত্যাদি পর্যবেক্ষণ করে বাড়ি বাড়ি গিয়েও নিউমোনিয়ার ঝুঁকি সনাক্ত করছে স্বাস্থ্যকর্মীরা। নিউমোনিয়ায় শিশুমৃত্যুর হার কমানোর জন্য সরকার এভাবে স্বাস্থ্যকর্মী, নার্স এবং চিকিৎসকদেরও প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতেও বিনামূল্যে ওষুধ ও চিকিৎসা দেওয়া হয়। সেখানেও অক্সিজেন ও নেবুলাইজারের ব্যবস্থা রয়েছে।’
সরকারের এতো উদ্যোগ থাকা সত্ত্বেও নিউমোনিয়ায় শিশুমৃত্যুর হার কেনো কমছে না- জানতে চাইলে ‘সেভ দ্যা চিলড্রেন, বাংলাদেশ’-এর সিনিয়র অ্যাডভাইজার (স্বাস্থ্য ও পুষ্টি) ডা. গোলাম মোতাব্বির তার মাঠ পর্যায়ের অভিজ্ঞতায় দুটি বিষয় পর্যবেক্ষণ করেছেন বলে জানান। ‘এক. মানুষ চিকিৎসা দেরিতে শুরু করেন। সামান্য সর্দি-কাশিকে গুরুত্ব দেন না। হয়তো এর ‘ডেনজার সাইন’গুলো জানতেন, কিন্তু ওই সময় ভুলে গেছেন। যখন সমস্যা ‘ক্রিটিক্যাল’ হয়, তখন গুরুত্ব দেন। দুই. মানুষ এর সঠিক চিকিৎসা বাছাই করতেও ভুল করেন। শুরুতে অনেকে তেল মালিশ, কবিরাজি বা ওষুধের দোকান থেকে ওষুধ নিয়ে চিকিৎসা করেন। এর যে ভালো ওষুধ, চিকিৎসা ও সেবা হাসপাতালগুলোতে রয়েছে, সেখানে তারা সময় মতো যান না।’
‘সব ধরণের মানুষের মাঝেই সচেতনতার অভাব রয়েছে। এটা শহর বা গ্রামের সমস্যা নয়। এটি একটি পরিবেশগত সমস্যা। হয়তো শিশুর ঠান্ডা লেগেছে। তার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। কিন্তত্মু মা বা অন্যান্যরা তা খেয়াল করেননি। চিকিৎসা নিতে দেরি করেছেন। এজন্য মানুষকে সচেতন হওয়া প্রয়োজন। তাহলে নিউমোনিয়ায় শিশুমৃত্যুর হার অনেক কমে যাবে’ বলে ডা. শামসুল হক এবং ডা. মোতাব্বির দু’জনেই একমত পোষণ করেন।
পথরেখা/এআর