মোয়াজ্জেম হোসেন রাসেল : দ্বিতীয়বার ফাইনালে উঠেই শিরোপার স্বাদ পেয়েছে বাংলাদেশ। ২০১৬ সালে ভারতের কাছে হারলেও এবার আর হতাশ হতে হয়নি। নেপালকে তাদের মাটিতে ৩-১ গোলের বড় ব্যবধানে পরাজিত করে শেষ হাসি হেসেছে লাল সবুজ প্রতিনিধিরা। ১৯৯৯ সালে কাঠমান্ডুর দশরথ রঙ্গশালা স্টেডিয়ামে যে ইতিহাস গড়েযছিল জুয়েল রানার দল, এবার সেটি করে দেখাল সাবিনা খাতুনরা। অনেক হতাশা আর বঞ্চনার মাঝে দেশের ফুটবলে এক পশলা বৃষ্টি নিয়ে আসল মেয়েদের সাফ চ্যাম্পিয়নশীপের এই শিরোপা। এখন দেশে ফেরার অপেক্ষায় রয়েংছে বাংলার বাঘিনীরা। প্রথমবারের মতো দক্ষিন এশিয়ার সেরা হতে পারাটা অনেক বড় অর্জণ হিসেবে দেখা হচ্ছে। বিশেষ করে পুরো টুর্নামেন্টে অপরাজিত থেকে শিরোপা জয় ভবিষ্যতের জন্য দেখাচ্ছে বড় স্বপ্ন। এশিয়ার ফুটবলের সর্বোচ্চ স্থর এশিয়া কাপে আগেই খেলা হয়েছে। এবার এশিয়া সেরা আসরে ভাল আর বড় সাফল্যের প্রত্যাশা করছেন ফুটবলের সাথে সংশ্লিষ্টরা। বলা যায় একটা শিরোপাই পাল্টে দিয়েছে নারী ফুটবলের দিক।
এখন স্বপ্ন আর সম্ভাবনার ঠিক দারুণ একটা অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশের নারী ফুটবল। পুরো টুর্নামেন্ট কোন ম্যাচ না হারা পাশাপাশি মাত্র একটি গোলই হজম করেছে গোলাম রব্বানী ছোটনের শীষ্যরা। নান অপুর্ণতা ও অভাবের মধ্যে বেড়ে ওঠা এসকল ফুটবলারদের মধ্যে ভাল করার তাড়না আগে থেকেই ছিল। বিশেষ করে এশিয়ান ফুটবল কনফেডারেশনের (এএফসি) বয়সভিত্তিক টুর্নামেন্টগুলোতে একাধিকবার সাফল্য পেয়েছিল। তবে সাফের শিরোপা জেতাটা বড় বেশি প্রয়োজন ছিল। এবার সেটিও করে দেখাল মেয়েরা। আজকে বাংলাদেশে আসার পর জমকালোভাবে বিমান বন্দরে তাদের বরণ করে নেওয়ার পালা। এরপর ছাদখোলা বাসে চড়ে পুরো শহর প্রদক্ষিন করারও কথা রয়েছে। আজ ২১ সেপ্টেম্বর দুপুরে জন্মভিটায় পা রাখবে শিরোপাজয়ী মেয়েরা। দুপুর সোয়া বারটায় নেপালের কাঠমান্ডু থেকে রওনা দিয়ে দেড়টায় ঢাকায় পৌছার কথা রয়েছে তাদের। বিআরটিসি সুত্র জানায়, ৭৫ সিটের ডাবল ডেকার বাসের দুই তলায় ৮ থেকে ১০টি সিট তুলে ফেলা হয়েছে। পাশাপাশি বিআরটিসির মতিঝিল ডিপোর একটি ডাবল ডেকার বাসের ছাদ কাটা হচ্ছে। একই সঙ্গে বাসের গায়েও বিজয়ীদের স্টিকার লাগানো থাকবে। গতকাল রাত ৮টায় ছাদখোলা বাসটি প্রস্তুত করা হয়।
এদিকে মতিঝিল বাস ডিপোর ম্যানেজার মো. মাসুদ তালুকদার জানিয়েছেন, ’অনেকটা নতুন অভিজ্ঞতা নিয়ে বাসটি প্রস্তুত হচ্ছে। ডাবল ডেটার বাসের ছাদ কেটে ফেলাসহ ৮ থেকে ১০টি সিট খুলে ফেলা হয়েছে। এটা ৭৫ সিটের বাস। শুধু দুই তলার আসনগুলো খুলে ফেলা হয়েছে’। এর আগে ইতিহাস গড়েছেন বাংলাদেশের মেয়েরা। কাঠমান্ডুতে স্বাগতিক নেপালকে ৩-১ গোলে হারিয়ে প্রথমবারের মতো মেয়েদের সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ জিতেছে বাংলাদেশ। এই হারের ধাক্কা সামলাতে না পেরে পদত্যাগ করেছেন নেপাল নারী দলের কোচ কুমার থাপা। দলকে সাফল্য এনে দিতে ব্যর্থ হওয়াতেই পদ ছাড়ছেন বলে জানিয়েছেন তিনি। ফাইনালের আগে সবচেয়ে আলোচিত ছিল, সানজিদা আক্তারের ফেসবুক স্ট্যাটাস। ফাইনালে জেতার পর তার কথা, ’হ্যাঁ আমরা পেরেছি’। জীবনযুদ্ধে লড়াই করে বিজয়ী সানজিদা ফাইনাল শেষে পরলেন বিজয় মুকুট। নিজের ফেসবুক পোস্টটিতে সানজিদা লিখেছিলেন, ’পাহাড়ের কাছাকাছি স্থানে বাড়ি আমার। পাহাড়ি ভাইবোনদের লড়াকু মানসিকতা, গ্রাম বাংলার দরিদ্র ও খেটে খাওয়া মানুষদের হার না মানা জীবনের প্রতি পরত খুব কাছাকাছি থেকে দেখা আমার। ফাইনালে আমরা একজন ফুটবলারের চরিত্রে মাঠে লড়ব এমন নয়, এগারোজনের যোদ্ধাদল মাঠে থাকবে, যে দলের অনেকে এই পর্যন্ত এসেছে বাবাকে হারিয়ে, মায়ের শেষ সম্বল নিয়ে, বোনের অলংকার বিক্রি করে, অনেকে পরিবারের একমাত্র আয়ের অবলম্বন হয়ে। আমরা জীবনযুদ্ধেই লড়ে অভ্যস্ত’।
কথা রাখলেন সানজিদা। নেপালের বিপক্ষে ফাইনালে দুর্দান্ত ফুটবল উপহার দিল বাংলাদেশ। জয়ের নেশায় অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠা বাংলাদেশের সামনে হার মানতে বাধ্য হলো হিমালয় কন্যারা। ম্যাচ শেষে তাই সোশ্যাল সাইটে উচ্ছসিত সানজিদা লিখলেন, 'হ্যাঁ! আমরা পেরেছি ইতিহাস গড়তে এবং প্রথম সাফ শিরোপা জয় করতে। আমরা এখন দক্ষিণ এশিয়ার চ্যাম্পিয়ন। সমর্থনের জন্য ধন্যবাদ’। সানজিদারা সমর্থন তো পেয়েইছেন। এই ফাইনাল নিয়ে আজ গোটা বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়েছিল ফুটবল উন্মাদনা। অনেক সমস্যায় জর্জরিত দেশবাসীকে আনন্দের উপলক্ষ এনে দিলেন সানজিদা-কৃষ্ণা-শামসুন্নাহাররা। দুই হ্যাটট্রিক, আট গোল করে ’গোল্ডেন বুট’ জিতেছেন সাবিনা খাতুন। এবারের মেয়েদের সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে গোলের বন্যা বইয়ে দিয়েছেন বাংলাদেশ অধিনায়ক সাবিনা খাতুন। ফাইনালে গোল না পেলেও এর আগের চার ম্যাচে করেছেন ৮ গোল। এর মাঝে ২টি হ্যাটট্রিক। যা টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ। নেপালকে ৩-১ ব্যবধানে উড়িয়ে বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর সাবিনার হাতেই তুলে দেওয়া হয় গোল্ডেন বুট। লিগ পর্বে পাকিস্তানকে ৬-০ গোলে উড়িয়ে দেওয়ার ম্যাচে হ্যাটট্রিক করেন সাবিনা। এরপর সেমিফাইনালে ভুটানকে ৮-০ গোলে উড়িয়ে ফাইনালে উঠে বাংলাদেশ। ওই ম্যাচেও হ্যাটট্রিক করেন বাংলাদেশের গোলমেশিন খ্যাত সাবিনা। সাফের মঞ্চে গোলদাতার তালিকায় শীর্ষ স্থানটিও বাংলাদেশ অধিনায়কের। এখন পর্যন্ত সাফের ৬টি আসর খেলা খেলা সাবিনার গোলসংখ্যা ২২টি।
ফাইনাল ম্যাচের আগে নেপালের বিপক্ষে এর আগে আটবার খেলে ছয়বারই হারে বাংলাদেশের মেয়েরা। দুবার ড্র করে। এদিন নেপালের বিপক্ষে প্রথম জয়ের স্বাদ পেল বাংলাদেশ। সাফে দুবার ফাইনাল খেলেই চ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্বাদ পেল বাংলাদেশ। এর আগে ২০১৬ সালে সাফের ফাইনাল খেলে ভারতের কাছে পরাজিত হন সাবিনারা। সাফে মোট পাঁচবার ফাইনাল খেলেও শিরোপার স্বাদ পেল না নেপাল। বাংলাদেশের কাছে হারের আগে চারবার ফাইনালে ভারতের কাছে হেরেছে তারা। সাবিনা খাতুন ২০১৬ সালের নারী সাফেও ৮ গোল করেছিলেন। এবার ৮ গোল করে সেরা গোলদাতার পুরস্কার জিতলেন তিনি। সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে এক আসরে সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ড ভারতের বালা দেবীর। তিনি ২০১৪ সালে একাই করেছিলেন ১৬ গোল। আজকে ছাদ খোলা বাসে চড়ে নতুন এক ঢাকাকে দেখবেন সাবিনা খাতুনরা। এ যেন অন্যরকম আনন্দে ভেসে যাওয়া।
দেশকণ্ঠ/আসো