দেশকন্ঠ প্রতিবেদন : ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাব পড়েছে উপকূলীয় অঞ্চলের সর্বত্র। প্রাণ হারিয়েছেন অনেকে। ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে ফসলের। তাণ্ডব চালিয়ে চলে গেছে সিত্রাং। তবে কৃষি অবকাঠামোয় করে গেছে ক্ষত। যদিও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, যেরকম আশঙ্কা ছিলো সেরকম ক্ষতি হয়নি। এ জন্য শুকরিয়াও আদায় করে তিনি জানান, ৬ হাজার হেক্টর কৃষিজমি ও ১ হাজার চিংড়ির খামারও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। চিংড়ি চাষিদের সুদমুক্ত ঋণ দেওয়া হবে বলেও জানান তিনি।
ফরিদপুরে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের কারণে প্লাবিত হয়েছে নিম্নাঞ্চল। ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে ফসলের। গতকাল মঙ্গলবার জেলার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. জিয়াউল হক জানান, ফরিদপুরে কৃষিক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে নিম্নাঞ্চলের সদর, চরভদ্রাসন, ভাঙ্গা ও সদরপুর উপজেলার কৃষিক্ষেতে। এসব এলাকার আমন ধানসহ বিভিন্ন ধরনের ডালক্ষেত ও শাক-সবজির ক্ষতি হয়েছে বলে আমরা প্রাথমিকভাবে জানতে পেরেছি। আমাদের কৃষি কর্মকর্তারা সরেজমিনে গিয়ে ক্ষতি নিরূপণের কাজ শুরু করেছেন।
সিরাজগঞ্জের বিভিন্ন জায়গায় আমন ধান মাটিতে নুয়ে পড়েছে। ধানের পাশাপাশি ভেসে গেছে পুকুর ও ঘেরের মাছ। বৃষ্টি ও ঝড়ো হাওয়ায় শীতের আগাম সবজিও ক্ষতির মুখে পড়েছে। কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, জেলার ৯ উপজেলায় ৭২ হাজার ৬৩০ হেক্টর জমিতে এবার রোপা আমনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে হাইব্রিড জাতের ১ হাজার ৫৭৫ হেক্টর, উফশী জাতের ৬৬ হাজার ৩২৫ হেক্টর এবং স্থানীয় জাতের ৪ হাজার ৭৩০ হেক্টর জমি রয়েছে।
কৃষকরা বলছেন, অনেকে বর্গা নিয়ে জমি চাষ করেছেন। তবে মাটিতে নুয়ে পড়েছে ধান। তাদের ধানে যেনো ঝড় বৃষ্টি মই দিয়েছে। এতে ফলন কম হওয়ার আশঙ্কা করছেন তারা। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. শামিনুর ইসলাম বলেন, ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে সিরাজগঞ্জ সদরে ৫৮, রায়গঞ্জ ৩১৯, তাড়াশ ১২৬, কাজিপুর ১৫, উল্লাপাড়া ২৮ ও চৌহালীর ৬৩ হেক্টর জমির আমন ধানসহ বিভিন্ন সবজি হেলে পড়েছে বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে। বাকি উপজেলার তথ্য গুলো এখনও পাওয়া যায়নি। তবে কৃষি কর্মকর্তারা তথ্য সংগ্রহের জন্য মাঠ পর্যায়ে কাজ করছেন।
খুলনায় ভারী বৃষ্টি ও দমকা হাওয়ার কারণে কিছু এলাকার আমন ধান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ১৮ হাজার ৪৮৩ হেক্টর জমির নানা ধরেনর ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, এ বছর খুলনায় ৯৩ হাজার ১৮৫ হেক্টর জমিতে ধানের আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে ১৭ হাজার ৯৪২ হেক্টর জমির ধান সিত্রাংয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সবজি আবাদ হয়েছে ৯৭০ হেক্টর জমিতে; ক্ষতিগ্রস্ত ২৯৩ হেক্টর। কলা আবাদ হয়েছে ৫৩৭ হেক্টরে; ক্ষতিগ্রস্ত ১৩৪ হেক্টর। পেঁপে চাষ হয়েছে ৩৭৫ হেক্টরে; ক্ষতিগ্রস্ত ৯৫ হেক্টর। পান চাষ হয়েছে ৮৫৮ হেক্টরে; ক্ষতিগ্রস্ত ৫ হেক্টর। মরিচ আবাদ হয়েছে ২০ হেক্টর; ক্ষতিগ্রস্ত ৬ হেক্টর। এছাড়া ধনিয়া ১ হেক্টর, মাসকলাই ৪ হেক্টর ও সরিষা ৩ হেক্টর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। খুলনা জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা রনজিৎ কুমার সরকার বলেছেন, প্রাথমিকভাবে জেলার ক্ষয়ক্ষতি নির্ণয় করা হয়েছে। জেলার মৎস্য ও কৃষিতেও ক্ষতি হয়েছে। তবে তার পরিমাণ খুবই কম। স্ব-স্ব দপ্তর সেগুলো নির্ণয় করছে। পূর্ণাঙ্গ ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ণয় করতে ২ থেকে ৩ দিন সময় লেগে যাবে।
বাগেরহাটে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে কৃষি ও মৎস্য খাতে। মৎস্য বিভাগের প্রাথমিক হিসেবে, ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ে অবিরাম বর্ষণ ও জলোচ্ছাসে ভেসে গেছে জেলার ৫টি উপজেলার ৫২৫টি মাছের ঘের (মাছের খামার) ও ২২৫টি পুকুরের মাছ। প্রাথমিক ভাবে মৎস্য খাতে ক্ষতির পরিমাণ ৮৭ লাখ ২০ হাজার টাকা বলে জানিয়েছে জেলা মৎস্য বিভাগ। কৃষি বিভাগ প্রাথমিক হিসেবে বলছে, ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ে জেলার ৯টি উপজেলায় ১ হাজার ৩৮৫ হেক্টর জমির ধান, ফলসহ রবি-শস্যের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এর মধ্যে রোপা আমন ৮৫০ হেক্টর, সব্জী ৩৭৫ হেক্টর, কলা ১১০ হেক্টর, মরিচ ২০ হেক্টর, পান ১৭ হেক্টর, পেপেসহ অন্যন্য ১৩ হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে।
সুন্দরবন বিভাগের প্রাথমিক তথ্য মতে, ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ে ৭টি পুকুরের পাড় ভেঙে লবন পানি ঢুকে মিঠা পানির উৎস নষ্ট হয়েছে। দুবলা, কটকা, শ্যালা, কোকিলমুনিসহ সুন্দরবনের ৭টি পুকুরে লবণ পানি প্রবেশ করায় বন্যপ্রানীর খাবার পানির উৎস নষ্ট হয়েছে।
মাগুরার শালিখায় জলাবদ্ধ হয়ে আছে নিন্মাঞ্চলের ফসলি জমি। এ অবস্থায় চরম বিপাকে পড়েছেন চাষিরা। প্রবল বৃষ্টিতে শালিখা উপজেলার সেওজগাতি, আড়পাড়া, কালিবাড়ী, থৈপাড়া, ধনেশ্বরগাতি, শতখালী, শালিখা, গঙ্গারামপুর, বুনাগাতি, বরইচারা নোরোপ্রতিসহ বিভিন্ন এলাকায় পাকা ও আধাপাকা ধান জমিতে নুয়ে পড়েছে। জমিতেই ভাসছে কৃষকের পাকা ধান। শীতকালীন সবজি, পালংশাকের ছোট ছোট চারা, ফুলকপি, বাধাকপি, টমেটো এবং মুলাসহ বিভিন্ন সবজির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সদ্য লাগানো পালংশাক এর চারা পানিতে ডুবে গেছে। এতে ব্যাপক ক্ষতি ও চরম হতাশায় পড়েছেন কৃষকরা। উপজেলার সেওজগাতি গ্রামের মহেন্দ্র নাথ মিত্র জানান, ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে পাকা ধানের ক্ষেত জমির পানিতে নুয়ে পড়েছে। এতে কৃষকের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। তালখড়ি গ্রামের ময়েন গাজী জানান, সিত্রাং ঝড় ও বৃষ্টির কারণে পাকা ধান জমিতে ভাসছে। সরিষা ক্ষেতও পানিতে ভাসছে। ধানসহ বিভিন্ন সবজির ক্ষেত পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে।
ঝিনাইদহে কলাবাগান ও ধানের ক্ষতি হয়েছে। শীষভরা ধান মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে। ধানের ক্ষতি কিছুটা কম হলেও কলাবাগানে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। বিশেষ করে সদর ও শৈলকুপা উপজেলা ক্ষতির পরিমাণ বেশি। তবে ক্ষতির পরিমাণ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর এখনও জানাতে পারেনি। ধান ও কলাবাগান নষ্ট হওয়ায় এবার উৎপাদন নিয়ে চিন্তিত কৃষকরা।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ঝড়ের কারণে জেলার চলতি আমন ধানসহ সবজির ক্ষতি হয়েছে। কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, জেলায় চলতি মৌসুমে ৯৪৯ হেক্টর জমিতে শীতকালীন বিভিন্ন সবজির আবাদ হয়েছিল। ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের কারণে মাসকলাই, ফুলকপি, বাঁধাকপিসহ ৮৩ হেক্টর বিভিন্ন রকম শাক-সবজির জমি আক্রান্ত হয়েছে। এ ছাড়াও চলতি আমন মৌসুমে ৫৪ হাজার ৫০৬ হেক্টর জমিতে আমনের আবাদ হয়েছে।
কিন্তু ঘূর্ণিঝড়টির কারণে কোনো কোনো স্থানে জমির ধানি গাছ কিছুটা হেলে পড়েছে। এতে আমন উৎপাদনে কোনো বিরুপ প্রভাব পড়বে না বলে মনে করছেন তারা।কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপপরিচালক শস্য মুন্সী তোফায়েল হোসেন জানান, আমন ফসল ঘরে তুলতে আরো দুই সপ্তাহ সময়ে লাগবে। তবে যেসব জমির ধান ৮০ ভাগ পেকেছে সেসব ধান কর্তনের জন্য ব্লক সুপারভাইজারদের মাধ্যমে কৃষকদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। যেসব কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হবে প্রণোদনা পাওয়া গেলে তাদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সার্বিক সহযোগিতা করা হবে।
গাইবান্ধায় কৃষকের রোপা আমন ধান, শাক-সবজি ও কলাবাগানসহ বিভিন্ন ফসলের ক্ষতি হয়েছে। এসব ফসল ঘরে তোলার সম্ভাবনায় মুহূর্তে অপূরণীয় ক্ষতিতে দুশ্চিন্তায় ভুগছেন কৃষক। কৃষকদের এমন ক্ষতি হলেও মাঠে নেই কৃষি কর্মকর্তারা। জানা যায়, কৃষি নির্ভরশীল গাইবান্ধায় চলতি রবি মৌসুমে আমন ধান, কলাবাগান ও শাক-সবজিসহ প্রায় ২ লক্ষাধিক হেক্টর জমিতে এসব চাষাবাদ করা হয়েছে। আর কিছুদিন পরেই মাঠের ফসল ঘরে তুলে দিনবদলের স্বপ্ন দেখছিলেন কৃষকরা। বৈরী এই আবহাওয়ায় পানির ওপর নুয়ে পড়ে কৃষকের আধাপাকা ধান। শুধু ধানই নয়, কলাবাগানসহ শাক-সবিজরও ক্ষতি হয়। কৃষকরা ধারণা করছে, গাইবান্ধার সাত উপজেলায় প্রায় ৪ হাজার হেক্টর ফসলের ক্ষতি হয়েছে।
টানা বৃষ্টিপাতের কারণে তলিয়ে গেছে প্রায় ১০ হাজার হেক্টর জমির পাকা রুপা আমন ধানের ক্ষেত। ভেসে গেছে পেঁয়াজের বীজতলা। সেই সাথে মুড়িকাটা পেঁয়াজের ক্ষেতও গেছে তলিয়ে। ঝড়ের বাতাসে ভেঙ্গে হেলে পড়েছে প্রায় ১৭শ হেক্টর জমির পাকা ধানের গাছ। সালথা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা জীবাংশু দাস বলেন, সিত্রাংয়ে সারাদেশের মত সালথায়ও আক্রান্ত।
আমরা ইতোমধ্যে বিভিন্ন ফসলী জমি পরিদর্শন করেছি। এখানে কলা, শাক-সবজি, পেঁয়াজের বীজতলা ও রুপা আমন ধান আক্রান্ত হয়েছে। এরমধ্যে ১৭৫০ হেক্টর রুপা আমন ধানের ক্ষেত আক্রান্ত হয়েছে ও ৫ হেক্টর জমির পেঁয়াজের বীজতলার ক্ষতি হয়েছে। আমরা কৃষকদের পরামর্শ দিয়েছি, যেসব জায়গায় পানি জমে আছে, সেসব জায়গা থেকে পানি বের করে ফেলার জন্য। তবে আশার বিষয় হচ্ছে, আবহাওয়া এখনও অনুকূলে, তাই বেশি ক্ষতির আশঙ্কা নেই।
দেশকণ্ঠ/রাসু