দেশকণ্ঠ প্রতিবেদক : নতুন জাতের ফল ও সবজি এবং বিদেশি ফসল চাষে কিছুটা ঝুঁকি থাকে। তাই ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ভয়ে অধিকাংশ কৃষক এ ঝুঁকি নিতে চান না। তবে এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম বদু মিয়া। দেশে একাধিক জাতের ফসল প্রথম আবাদ করে সাড়া ফেলেছেন। তার উৎপাদিত ফল ও ফসল পেয়েছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা। বিভিন্ন দেশে রপ্তানিও করছেন। পেয়েছেন একাধিক জাতীয় পুরস্কার। তার প্রেরণায় কৃষিতে নেমেছেন অসংখ্য মানুষ। পাচ্ছেন সফলতাও। অনেকেই পতিত জমি আবাদ করছেন।
সরেজমিন ঘুরে জানা যায়, কৃষক বদুর প্রকৃত নাম আব্দুল বাছির বদু। কিন্তু পরিচিতি পেয়েছেন ‘কৃষক বদু মিয়া’ নামেই। বাড়ি হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলার বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তবর্তী কমলপুর গ্রামে। পড়াশোনা খুব বেশিদূর এগোয়নি। স্কুলে পড়া অবস্থায় ১৯৮৮ সাল থেকেই তিনি পারিবারিক কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। অষ্টম শ্রেণির পাঠ চুকিয়েই পুরোপুরি কৃষক হয়ে ওঠেন। বলতে গেলে নেশা থেকেই কৃষিকে পেশা হিসেবে বেছে নেন তিনি। ২০০১ সালে পারিবারিক এবং কিছু জমি লিজ নিয়ে চাষাবাদ শুরু করেন কৃষক বদু মিয়া। খুব অল্প দিনেই পেয়ে যান সফলতা। একের পর এক নতুন নতুন ফল ও ফসল উৎপাদন করে ব্যাপক পরিচিতি পান। দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে খ্যাতি।
২০১৪ সালে কৃষি মন্ত্রণালয়ের ‘দেশসেরা’ কৃষক হিসেবে প্রথম পুরস্কার পান। এরপর ২০১৭ সালে বিশ্ব খাদ্য দিবসের প্রথম পুরস্কার, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে ২০১৯ সালে জাতীয় সবজি মেলায় প্রথম পুরস্কার, ২০২২ সালে দ্বিতীয় পুরস্কার, ২০১৯ সালে জাতীয় ফল প্রদর্শনীতে দ্বিতীয় পুরস্কার, ২০২০ সালে দীপ্ত কৃষি এবং ২০২৩ সালে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক ও চ্যানেল আইয়ের এগ্রো অ্যাওয়ার্ড পান বদু মিয়া। ২০০৮ সালে হলুদ তরমুজ আবাদ করে আলোচনায় আসেন কৃষক বদু মিয়া। রাতারাতি দেশব্যাপী ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায় এ ফল। ওপরে হলুদ, ভেতরে লাল এ তরমুজ অত্যন্ত সুস্বাদু। এসব তরমুজ একেকটা ৫-৭ কেজি পর্যন্ত ওজন হয়।
তবে সবচেয়ে বেশি সাড়া ফেলেছেন থাইল্যান্ডের ফল সাম্মাম আবাদ করে। সাম্মাম একেকটি এক থেকে দেড় কেজি পর্যন্ত হয়। প্রতি কেজি পাইকারি বিক্রি হয় ১৫০-২০০ টাকায়। তবে খুচরা এক কেজি বিক্রি হয় ৪০০-৪৫০ টাকায়। গত বছর থেকে কিছু জমিতে আবাদ করছেন লাল ও কালো ধান। এটিও দেশে একেবারেই নতুন। এ ধানের চাল মূলত ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য। শরীরের জন্য অত্যন্ত উপকারী এ চালের ভাত খেলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকে। খুবই লাভজনক এ চাল বিক্রি হয় প্রতি কেজি ১৫০-২০০ টাকায়।
শুধু বিদেশি ফল নয়, সবজি চাষেও রয়েছে তার ব্যাপক সফলতা। তিনি আবাদ করেন টমেটো, ক্যাপসিকাম, ব্রকলি, কাঁচামরিচ, শসা, শিম, আলু ও জিংক আলু। কয়েক বছর এসব ফল ও সবজি সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করেছেন। তবে কয়েক বছর ধরে সেটি বন্ধ। কৃষিকে পেশা হিসেবে নিয়ে সংসার খরচ চালিয়েও এ পর্যন্ত অন্তত ৫০ লাখ টাকা সঞ্চয় করেছেন কৃষক বদু মিয়া। তার দুই ছেলে ও এক মেয়ে। মেয়ে এইচএসসি পাস করেছেন। বড় ছেলে এইচএসসি ও ছোট ছেলে এসএসসি পরীক্ষার্থী। কৃষক বদু মিয়া বলেন, ‘একসময় আমার কৃষিপণ্য বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করেছি। তবে যারা আমার পণ্য নিতেন তারা ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছেন। তাই রপ্তানিও বন্ধ। সরকার যদি উদ্যোগ নেয় তাহলে আবারও আমার পণ্য বিদেশে রপ্তানি করতে পারবো। এতে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব।’
তাবিদুর রহমান নামের এক ব্যক্তি বলেন, ‘শুনেছি বদু মিয়া সাম্মাম নামের এক জাতের বিদেশি ফল উৎপাদন করছেন। সেটি দেখার জন্যই মূলত এসেছি। এটি কী ধরনের ফল আগে জানতাম না। এসে দেখি তিনি দেশীয় সবজি ছাড়াও বিভিন্ন জাতের বিদেশি সবজি চাষ করছেন।’
কথা হয় স্থানীয় কৃষক মো. মহিউদ্দিনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘তাকে (বদু মিয়া) দেখেই আমরা কৃষিতে উদ্বুদ্ধ হচ্ছি। আমাদের এলাকার অনেকেই এখন তাকে দেখে কৃষিতে সফল হচ্ছেন। কৃষিতে কোনো সমস্যা হলেই আমরা বদু চাচার কাছে ছুটে যাই। তার পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করি। সফলতাও পাই।’
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. নূরে আলম সিদ্দিকী বলেন, বদু মিয়া একজন সফল কৃষক। আমরা তাকে সব বিষয়ে সর্বাত্মক সহযোগিতা করছি। তাকে দিয়েই মূলত আমরা নতুন নতুন জাতের ফসল উৎপাদন করি। পুরোনো কৃষক হওয়ায় তিনি ঝুঁকি নিতে চান।
দেশকণ্ঠ/রাসু