• কৃষিবিদ মোঃ সুনাইন বিন জামান
কয়েক বছর ধরে চলমান করোনা মহামারির কারণে বিশ্বব্যাপী খাদ্যশস্যের উৎপাদন বিঘ্নিত হয়েছে। তার উপর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে খাদ্য সরবরাহ হ্রাস পেয়েছে। খাদ্যশস্যের আমদানি মূল্য হু হু করে বেড়ে চলেছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো আগত বছরে বিশাল এক খাদ্য ঘাটতি ও দুর্ভিক্ষের আশংকা করছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা দেশের কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির উপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করে বলেছেন, এক ইঞ্চি জমিও যেন অনাবাদি না থাকে।’ তিনি বলেছেন, ‘দরকার হলে অনাবাদি জমিতে একটা ফল, সবজি বা কাঁচামরিচের গাছ লাগান। সেখান থেকেও কিন্তু অল্প কিছু হলেও পাওয়া যাবে।, প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য থেকেই স্পষ্ট যে সামনের বছরগুলোতে আগত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রতি ইঞ্চি জমির সদ্ব্যব্যবহার আমাদের নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু আমাদের কৃষি ব্যবস্থার বহুবিধ সমস্যার একটি অন্যতম সমস্যা হলো কৃষি জমির ক্ষুদ্রায়তন ও খন্ড-বিখন্ডতা। প্রতি বছরই তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন আইল। কথিত আছে, বাংলাদেশের সকল কৃষি জমির আইল একত্রিত করলে তার আয়তন গিয়ে দাঁড়াবে সমগ্র বগুড়া জেলার সমান। যদি তাই হয়, তাহলে হিসাব মতে প্রায় ২ লক্ষ ৯২ হাজার হেক্টর জমি অনাবাদি অবস্থায় পড়ে রয়েছে (বগুড়া জেলার আয়তন ২৯২০ বর্গ কিমি, ১ বর্গ কিমি=১০০ হেক্টর, অতএব ২,৯২০০০ হেক্টর) যা একটু সচেষ্ট হলেই আবাদের আওতায় আনা সম্ভব হবে আইল ফসল চাষ করার মাধ্যমে। এক্ষত্রে খেতের চতুর্পাশ্বের আইলের মধ্যে যেটা সচারচর হাঁটা চলায় ব্যবহৃত হয় তা রেখে অন্য তিন পাশের আইলে বিভিন্ন ফসল চাষ করা যেতে পারে। ক্ষেতের আইলে যে ফসল চাষ করা হয় তাই আইল ফসল।
আইল ফসল চাষ
প্রতি ইঞ্চি জমির সঠিক ও সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করা সম্ভব হবে; পারিবারিক পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে; উৎপাদন বাড়বে; স্বল্প খরচে কৃষক বাড়তি আয় ঘরে তুলতে পারবে; আইলে ফসল চাষ করার মাধ্যমে মূল ফসলের রোগ ও পোকার বিকল্প পোষক কমানো যাবে; কৃষক নিয়মিত জমি পরিদর্শনে উৎসাহিত হবে; আইল ফসল জমির বেড়া হিসেবে কাজ করবে যা মূল জমির মধ্য দিয়ে মানুষ, গরু, ছাগলের অনাকাক্ষিত বিচরণ বন্ধ করবে; আইল সুগঠিত হওয়ায় খেতে ব্যবহারকৃত উপকরণের (সেচ, সার) সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত হবে; নিয়মিত আইল ফসল চাষ করলে মূল জমিতে ইঁদুরের উৎপাত কমবে; উপকারি পোকামাকড়ের আশ্রয়স্থল, সংরক্ষণ ও বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে; আইল ফসলে পোকা খেকো পাখি বসতে পারবে এবং ক্ষতিকর পোকামাকড় ধরে খাবে; জমিতে উপকারি পরভোজী ও পরজীবী পোকার সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে যার ফলে রাসায়নিক বালাইনাশকের ব্যবহার কমানো যাবে।
আইলে চাষ করার জন্য নির্বাচিত ফসলসমূহের যেসব বৈশিষ্ট্য থাকা বাঞ্ছনীয় তা হলো : ১. স্বল্প জীবনকাল বিশিষ্ট হবে। ২. দ্রুত বর্ধনশীল হবে যেন মূল ফসলের পূর্বেই সংগ্রহ করা যায়। ৩. অবশ্যই রঙিন ফুল বিশিষ্ট হবে। ৪. কম ছায়াদানকারী হবে যেন মূল ফসলের ক্ষতি না হয়। এ ছাড়াও খেতের আইলে চাষ উপযোগী ফসলসমূহের বর্ষপঞ্জি টেবিল দ্রষ্টব্য।
ক্ষেতের মূল ফসলের সাথে মিল রেখে আইলে চাষ উপযোগী ফসল নির্বাচন করে বপন/রোপণ করতে হবে। উদাহরণসরূপ-
ক) মূল ফসল ধান হলে আইল ফসল হিসেবে মূল ফসলের সাথে মিল রেখে : বোরো মৌসুমে- শিম, টমেটো, বেগুন, শসা, লালশাক, পালংশাক, ধনিয়া প্রভৃতি ফসলের চাষ করা যেতে পারে; রোপা আউশ মৌসুমে- লাউ, মিষ্টিকুমড়া, করলা, কাঁকরোল, ঝিঙ্গা, বরবটি, ঢ়েঁড়স, বেগুন প্রভৃতি ফসলের চাষ করা যেতে পারে; রোপা আমন মৌসুমে- মিষ্টিকুমড়া, চালকুমড়া, করলা, বরবটি, ঢ়েঁড়স, আগাম শিম, আগাম টমেটো প্রভৃতি ফসলের চাষ করা যেতে পারে।
খ) মূল ফসল সবজি হলে আইল ফসল হিসেবে মূল ফসলের সাথে মিল রেখে : শীত মৌসুমে- শিম, টমেটো, বেগুন, লাউ, শসা, সরিষা, করলা প্রভৃতি ফসলের চাষ করা যেতে পারে; গ্রীষ্ম মৌসুমে- করলা, কাঁকরোল, ঝিঙা, বরবটি, ঢ়েঁড়স, বেগুন প্রভৃতি ফসলের চাষ করা যেতে পারে।
আইল ফসল চাষের পদ্ধতি/নিয়মাবলি : খেতের উঁচু থেকে মাঝারি উঁচু আইল নির্বাচন করতে হবে; আইল চিকন হলে বা নিচু হলে বাইরে থেকে নরম কাদামাটি ব্যবহার করে আইল উঁচু ও চওড়া করে নিতে হবে; আইলের গঠন ঠিক রেখে উপরের মাটি ভালোভাবে কুপিয়ে ঝুরঝুরে করে নিতে হবে; আইল ফসলের বীজ আইলে ছিটিয়ে বপন করা যাবে অথবা পলিব্যাগে চারা উৎপাদন করে নিয়ে রোপণ করতে হবে; নির্দিষ্ট দূরত্ব ও আকার বজায় রেখে মাদায়/গর্তে সুস্থ-সবল চারা রোপণ করতে হবে; মাদায়/গর্তে সুপারিশকৃত জৈব ও অজৈব সার ব্যবহার করতে হবে।
আন্তঃপরিচর্যা : সময়ে সময়ে ফসল মাত্রানুযায়ী জৈব ও অজৈব সার প্রয়োগ করতে হবে; আইলে ঘাসসহ অন্যান্য আগাছা হওয়ার প্রবণতা বেশি থাকে তাই নিয়মিত আগাছা পরিষ্কার করতে হবে; প্রয়োজন অনুযায়ী পরিমিত সেচের ব্যবস্থা করতে হবে। পানির অপচয় রোধে মাদায় লাগানো ফসলের গোড়া ঝাঁঝরি দিয়ে ভিজিয়ে দেয়া যেতে পারে। এ ছাড়া মাটির আর্দ্রতা সংরক্ষণে খড়, কচুরিপানা, চটের বস্তা মালচিং হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে; লতানো সবজির ক্ষেত্রে চারা ১.৫-২ ফুট লম্বা হওয়ার পর খুঁটি/মাচা/বাউনি/জাংলা স্থাপন করতে হবে। খুঁটি বা মাচায় গাছ ভালোভাবে বাড়তে পারে, পর্যাপ্ত আলো-বাতাস পায় এবং পরিচর্যা করা সহজ হয় যার ফলে ফলন ভালো হয়। জাবপোকা, থ্রিপস, মাছি পোকা, ফলছিদ্রকারী পোকা এবং ছত্রাকজনিত ও ভাইরাসজনিত বিভিন্ন রোগ দেখা দিলে সবজির জমিতে যে পদ্ধতিতে বালাই দমন করা হয় একইভাবে আইল ফসলেও সেই পদ্ধতি প্রয়োগ করা যেতে পারে। তাছাড়া পোকা দমনে হলুদ আঠালো ফাঁদ, বিষটোপ, নিম তেলের ব্যবহার এবং রোগ দমনে ভেজষ বালাইনাশক যেমন পেঁয়াজের নির্যাস (ঢলে পড়া রোগ দমনে), পেঁপে পাতার নির্যাস (পাউডারি মিলডিউ রোগ দমনে), গাঁদা ফুলের শিকড়ের নির্যাস (কৃমি দমনসহ পোকা বিতারণে) ব্যবহার করা যেতে পারে।
অধিকাংশ আইল ফসল বীজ বপন বা চারা রোপণের ৫০-৫৫ দিনের পর থেকে সংগ্রহ করা শুরু হয়। যেমন বরবটি, করলার বীজ বপনের ৫০-৬০ দিন পর থেকেই ফল সংগ্রহ করা যায়। আবার লাউ, মিষ্টিকুমড়ার ফুল পরাগায়নের ২০-২৫ দিনের মধ্যে ফল সংগ্রহ করা যায়। জাতভেদে শসার বীজ বপনের ৩০-৩৫ দিনের মধ্যে গাছে ফুল আসতে শুরু করে এবং ফুল ফোটার ১৫-২০ দিনের মধ্যেই ফল আহরণের উপযুক্ত হয়ে যায়। সাধারণত জাতভেদে প্রতি ২০ মিটারের আইল থেকে ২০-১২০ কেজি পর্যন্ত বা এর চেয়েও বেশি ফলন পাওয়া যেতে পারে। যেমন- লাউ/মিষ্টিকুমড়ার ক্ষেত্রে একটি ২০ মিটারের আইলে ২ মিটার পর পর মোট ১০টি লাউ গাছ লাগানো সম্ভব। জাতভেদে প্রতিটি লাউ গাছে গড়ে ১০-১২টি করে মোট লাউ পাওয়া যাবে ১০০-১২০টি। প্রতিটি লাউয়ের ওজন গড়ে ১.২ কেজি করে হলে ২০ মিটারের একটি আইল থেকে গড়ে ৩-৩.৫ মন ফলন পাওয়া সম্ভব। একই পরিমাণ আইল থেকে মিষ্টিকুমড়ার ফলন (গাছ প্রতি গড়ে ৮টি করে ধরলে) প্রায় ৫.৫-৬ মন পাওয়া সম্ভব।
অনুরূপভাবে করলার ক্ষেত্রে একটি ২০ মিটারের আইলে ১.৫ মিটার পর পর প্রায় ১৩-১৪ টি করলার চারা লাগানো সম্ভব। প্রতিটি করলা গাছে জাতভেদে গড়ে ২৫-৩০টি করে করলা ধরে এবং পাশাপাশি ফলের মাছি পোকার আক্রমণ প্রতিহত করতে পারলে ১৩টি গাছ থেকে ২৫-৩০ কেজি ফলন পাওয়া সম্ভব। বরবটির ক্ষেত্রে একটি ২০ মিটারের আইলে ৭০ সেমি পর পর প্রায় ৩০টি মাদা করা যাবে এবং প্রতি মাদায় ৩টি করে বরবটির চারা রোপণ করা যাবে। জাতভেদে প্রতিটি বরবটি গাছ থেকে ৬০-৭০টি করে বরবটি পাওয়া যাবে। ৫০-৬০ দিন পর থেকে বরবটি সংগ্রহ শুরু করে ২.৫-৩ মাস পর্যন্ত ফল সংগ্রহ করা যায়। প্রতি ২০ মিটারে প্রায় ৫০-৬০ কেজি বরবটির ফলন পাওয়া যায়। পরিশেষে বলা যায়, মূল ফসল এবং মৌসুম ঠিক রেখে খেতের আইলে চাষ করার জন্য পূর্ব থেকেই ফসল নির্বাচন করে নিতে হবে। এক্ষেত্রে পলিব্যাগে চারা তৈরি করে নেয়া যেতে পারে। ১৫-২০ দিনের চারা সহজেই আইলে মাদা করে লাগানো যাবে। আইল ফসলের জন্য মূল ফসলের কোন ক্ষতি হয় না উপরন্ত জমিতে উপকারী পোকামাকড়ের সংখ্যা বৃদ্ধি পায় যা মূল ফসলের পরাগায়ন থেকে শুরু করে ক্ষতিকর বালাইয়ের উপস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। সুতরাং জমির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিতকল্পে এবং কৃষকের আয়বর্ধনে সময়মতো, সঠিক পদ্ধতিতে আইল ফসল চাষ করা বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে অতীব জরুরি।
লেখক : কৃষি সম্প্রসারণ অফিসার, শিবগঞ্জ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। মোবাইল : ০১৭৪৭০২৫১২৬
পথরেখা/রাসু