• নিতাই চন্দ্র রায়
আখ বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের একটি অর্থকরী ফসল। একে বীমাকৃত ফসল বললেও ভুল হবে না। খরা, বন্যা, ঝড়, জলোচ্ছ্বাস এবং রোগ-পোকার আক্রমণের সাথে সংগ্রাম করে ভালোভাবে মাঠে টিকে থাকতে পারে এই ঘাতসহিষ্ণু ফসল। আমাদের মনে রাখা উচিত, ১৯৮৭ ও ১৯৮৮ সালের বন্যায় সারা দেশের বাড়িঘর, রাস্তাঘাট ও মাঠের ফসল পানির নিচে তলিয়ে গেলেও একমাত্র আখই বন্যার ঘোলা জলের উপর মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে ছিল। বন্যার পানি সরে যাওয়ার সাথে সাথে কৃষক আখ মাড়াই ও নতুন গুড় বিক্রি করে বিক্রয়লব্ধ অর্থ দিয়ে বাড়িঘর ও কৃষি যন্ত্রপাতি মেরামত করে। রবি ফসলের চাষ করে বন্যার ক্ষতি পুষিয়ে আবার ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হন। বন্যার সময় পশুখাদ্যের তীব্র অভাবও অনেকটা মেটানো হয়। ওই ভয়াবহ বন্যায় অনেক গরিব মানুষ সারাদিনে এক খন্ড আখ চিবিয়ে খেয়েও জীবন রক্ষা করে। আখের কোনো কিছুই ফেলানা যায় না। আখের মুথা জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আখের সবুজ পাতা পশুর প্রিয় খাদ্য। ছোবড়া থেকে কাগজের ম- তৈরি করা হয়। শুকনা পাতা ঘর ছাওয়ার কাজে ব্যবহার করা হয়।
দেশে বার্ষিক চিনির চাহিদা প্রায় ১৮ লাখ টন। গুড়ের চাহিদা কম করে হলেও ৯ লাখ টন। বর্তমানে দেশে গুড় উৎপাদিত হয় আনুমানিক ৩ থেকে ৪ লাখ টন। বছরে গুড়ের ঘাটতি প্রায় সাড়ে ৫ থেকে ৬ লাখ টন। গুড়ের এই বিশাল ঘাটতি পূরণে মিল বহির্ভূত এলাকায় আখ চাষ বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই। তাই শুধু শীতকালে নয়; গ্রীষ্মকালেও আধুনিক পদ্ধতিতে রোপা আখের চাষ করতে হবে এবং চাষ এলাকাও ফলন বাড়াতে হবে। বিশুদ্ধ বীজ ব্যবহারের মাধ্যমে আখের ফলন শতকরা ১৫ থেকে ২০ ভাগ বাড়ানো যায়। তাই গ্রীষ্মকালীন রোপা আখের জন্য উন্নত জাতের উচ্চফলনশীল, রোগ-পোকামাকড় মুক্ত, প্রজনন বিশুদ্ধ, আর্দ্র গরমপানিতে শোধিত বীজ ব্যবহার করা উচিত। বীজের বয়স হওয়া উচিত ৯ থেকে ১০ মাস। গুড় ও লাল চিনি তৈরিতে গ্রীষ্মকালীন রোপা আখের জন্য উপযুক্ত জাতগুলোর মধ্যে রয়েছে- ঈশ^রদী ২/৫৪. লতারিজবা-সি, ঈশ^রদী-৩৪, ঈশ^রদী-৩৭, ঈশ^রদী-৩৮, ঈশ^রদী-৩৯ ও মিশ্রিমালা উল্লেখযোগ্য। চিবিয়ে খাওয়ার জন্য বনপাড়া গেন্ডারি, কিউ-৬৯, বিএসআরআই আখ-৪১, বিএসআরআই আখ-৪২ (রঙবিলাস) ও বিএসআরআই আখ ৪৭ জাত নির্বাচন করা যেতে পারে। গ্রীষ্মকালীন রোপা আখ চাষে জন্য অবশ্যই উঁচু দো-আঁশ ও বেলে দো-আঁশ মাটি নির্বাচন করতে হবে।
রোপা আখ চাষে বীজতলা ও পলিব্যাগ পদ্ধতি ছাড়াও -১. গাছ চারা পদ্ধতি; ২. পাশর্^কুশি (লেটারাল) পদ্ধতি; ৩. স্টকলেস চারা ও ৪. চোখ চারা পদ্ধতি থাকলেও কৃষকের কাছে সাধারণ বীজতলা পদ্ধতিই অধিক জনপ্রিয়। চৈত্রের মাঝামাঝি থেকে বৈশাখ মাসে ময়মনসিংহ জেলার ফুলবাড়িয়া, মল্লিকবাড়ি ও শ্রীপুর চাষিরা বীজতলায় আখের চারা তৈরি করেন। ৭.২ মিটার দৈর্ঘ ১.২ মিটার প্রস্থের ৮টি বীজতলার চারা দিয়ে এক এক জমিতে রোপা আখের চাষ করা যায়। প্রতিটি বীজতলার মাটি ভালোভাবে চাষ করে ঝুরঝুরা করতে হবে। সুস্থ ও পোকামুক্ত চারার জন্য প্রতিটি বীজতলাতে ৭৫ কেজি পচা গোবর, ৫০০ গ্রাম ইউরিয়া, ৫০০ গ্রাম টিএসপিও ২৫০ গ্রাম এমওপি এবং ২০০ গ্রাম রিজেন্ট-৩ জিআর প্রয়োগ করতে হবে। রোগের আক্রমণ হতে চারা আখ রক্ষার জন্য বীজখ-গুলো একটি মাটির পাত্রে ২৫ লিটার পানিতে ২৫ গ্রাম এমকোজিম মিশিয়ে তাতে বীজখ-গুলো ২৫ মিনিটি শোধন করতে হবে। এতে আখ লাল পচা, কালো শীষ, ঢলে পড়া, আনারসগন্ধ প্রভৃতি রোগ হতে রক্ষা পেতে পারে। বীজতলায় আখের চোখ পাশাপাশি রেখে ছত্রাক শোধিতকৃত বীজখ-গুলো মাটির সমান্তরালে এমনভাবে স্থাপন করতে হবে যাতে প্রত্যেকটি বীজ খ-ের মাঝখানে কানি আঙুল পরিমাণ ফাঁকা থাকে। তারপর বীজখ-গুলোর ওপর বেড প্রতি ২০০ গ্রাম রিজেন্ট-৩ জিআর ছিটিয়ে আধা ইঞ্চি মাটি দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। এতে উঁই পোকার আক্রমণ থেকে বীজখ-গুলো রক্ষা পাবে। তারপর বীজতলার ওপর হালকা করে আখের শুকনা পাতা বিছিয়ে সামান্য মাটি আধা ইঞ্চি মাটি দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। চারাগুলো গরু ছাগলের উপদ্রব থেকে রক্ষা করার জন্য বীজতলার চার দিকে পলিথিনের জাল দিয়ে বেড়া দিতে হবে।
ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া, মল্লিকবাড়ি ও শ্রীপুর এলাকায় আমন ধান কাটার পর কৃষকের তেমন কাজ থাকে না। এ সময় তারা আখ থেকে লাল চিনি ও গুড় তৈরি শুরু করেন। আখের ওপরের দিকের ৩০ থেকে ৪৫ সেন্টিমিটার পরিমাণ অংশ কেটে আঁটি বেঁধে মাটির গর্তে সংরক্ষণ করেন। মাঝে মধ্যে সামান্য পানির ছিটা দিলে ১০ থেকে ২০ দিনের মধ্যে আখের চোখ ফোটতে শুরু করে। তখন মাটির গর্তে জাগ দেয়া মাথার বীজখ-ের পাতা ছড়িয়ে ধারালো দা দিয়ে দু’চোখ করে কেটে বীজখ- তৈরি করা হয়। সাধারণত ময়মনসিংহ ও শ্রীপুর অঞ্চলে মধ্য বৈশাখ থেকে মধ্য জ্যৈষ্ঠে বৃষ্টিপাত শুরু হলে গ্রীষ্মকালীন রোপা আখের চারা মূল জমিতে রোপণ করা হয়। এ সময় মাঝে মধ্যে বৃষ্টি হয় বলে সেচের তেমন প্রয়োজন হয় না বললেই চলে। মূল জমিতে চারা রোপণের জন্য ৬০ সেন্টিমিটার দূরে কোদাল দ্বারা নালা তৈরি করতে হবে। নালায় একর প্রতি ৫ টন পচা গোবার বা আবর্জনা পচা সার প্রয়োগ করতে হবে। ১১০কেজি টিএসপি, ৬৬ কেজি জিপসাম ও ৩ কেজি দস্তা সার প্রয়োগ করে নালার মাটির সাথে কুপিয়ে উত্তমরূপে মিশিয়ে দিতে হবে। তারপর নালায় সেচ দিয়ে মাটি কাদাময় করে ধানের চারার মতো ১৫ সেন্টিমিটার দূরে দূরে আখের চারা লাগাতে হবে। উঁইপোকা আক্রমণের হাত থেকে রক্ষার জন্য একর প্রতি ৬.৬ কেজি হারে রিজেন্ট-৩ জিআর নালার মাটিতে চারা রোপণের আগেই সারের সাথে ব্যবহার করতে হবে। বীজতলার এক কোনায় ফাঁকা স্থান পূরণের জন্য একর প্রতি ১ হাজার চারা রেখে দিতে হবে। চারা রোপণের ৭ দিন পর আর একটি সেচ দিতে হবে। প্রতিটি সেচের পর জমির মাটি আলগা করে দিতে হবে। চারা রোপণের ১০ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে মৃত চারার ফাঁকা স্থান বীজতলার রেখে দেয়া চারা দিয়ে পূরণ করতে হবে। ফাঁকা স্থান পূরণের সময় চারার ২/৩ অংশ অবশ্যই কেটে দিতে হবে।
ভালো চারার জন্য যেসব যত্ন করতে হবে তার মধ্যে রয়েছে- ১) রসের অভাব হলে মাঝে মধ্যে বীজকলায় সেচ দিতে হবে। ২) বীজতলায় রোগাক্রান্ত চারা দেখা দিলে সাথে সাথে তা তুলে ফেলতে হবে। চারাগুলো ৩/৪ পাতা বিশিষ্ট হলে ৭ দিন পর পর চারার পাতা ২ থেকে ৩ বার কেটে দিতে হবে। চারা রোপণের ২৫ থেকে ৩০ দিন পর একর প্রতি ৫৫ কেজি ইউরিয়া ও ৩৩ কেজি এমওপি সার ও ১৩ কেজি রিজেন্ট ৩ জিআর চারার চারদিকে রিং পদ্ধতিতে প্রয়োগ করে চারার গোড়ার মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। বাকি ৫৫ কেজি ইউরিয়া ৩৩ কেজি এমওপি সার চারার চারদিকে একই পদ্ধতিতে প্রয়োগ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, সার উপরিপ্রয়োগের সময় জমিতে জো অবস্থা থাকতে সেচ প্রয়োগ করার পর জো অবস্থা সৃষ্টি হলেই সার উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। আখের ভালো ফলনের জন্য সময় মতো আগাছা দমন, মাটি আলগাকরণ, রোগবালাই ও পোকামাকড় দমন, সার উপরিপ্রয়োগ, কুশি ব্যবস্থাপনা, আখের গোড়ায় মাটি দেয়া, শুকনা পাতা ছাড়ানো ও আখ বাঁধার মতো কাজগুলো যথাসময়ে সম্পন্ন করতে হবে।
ফুলবাড়িয়া উপজেলার কৃষকগণ লাল চিনি ও গুড় উৎপাদন করেন। তাদের একজন বলেন, প্রতি একর জমির আখ থেকে ১ হাজার ৯২০ কেজি লাল চিনি উৎপাদিত হয়। প্রতি কেজি লাল চিনির বর্তমানে ১২০ টাকা কেজি পাইকারি দরে বিক্রি হচ্ছে। সে হিসেবে প্রতি একর জমির উৎপাদিত লাল চিনি বিক্রি করে কৃষকের আয় হয় ২ লাখ ৩০ হাজার ৪০০ টন। উৎপাদন খরচ ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা বাদ দিলে কৃষকের নিট লাভ দাঁড়ায় ৭০ হাজার ৪০০ টাকা, যা অন্য কোনো মাঠ ফসলে সম্ভব নয়। এ কারণে দিন দিন বাড়ছে ফুলবাড়িয়া, মল্লিকবাড়ি, গৌরিপুর, শ্রীপুর, মধুপুরের গড়অঞ্চল এবং গফরগাঁয়ের চর এলাকাসহ বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলে আখের চাষ, লালচিনি ও গুড় উৎপাদন।
আমাদের মনে রাখতে হবে, মেধাবী জাতি গঠনে মিষ্টিজাতীয় খাবারের কোনো বিকল্প নেই। তাই মিল বহির্ভূত এলাকা বিশেষ করে বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলে গ্রীষ্মকালীন রোপা আখ চাষ, লাল চিনি ও গুড় উৎপাদন বৃদ্ধি কল্পে নিম্নলিখিত সুপারিশমালাগুলো জরুরি ভিত্তিতে কার্যকর করা উচিত। সুপারিশগুলো হলো- ১) পূর্বের ন্যায় মিল বহির্ভূত এলাকায় আখ চাষ জোরদারকরণ প্রকল্প চালু করা যেতে পারে। ২) মিল জোন এলাকার মতো রোপা ও মুড়ি আখ চাষের ওপর কৃষকদের সমপরিমাণ ভর্তুকি দেয়া প্রয়োজন। এই ভর্র্তুকির টাকা যাতে প্রকৃত আখ উৎপাদনকারীগণ পান তাও নিশ্চিত করতে হবে। ৩) মিল বহির্ভূত লাল চিনি ও গুড় উৎপাদন এলাকার আখ ও গুড় উৎপাদকারী কৃষক, উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তাদের আখ চাষের উন্নত প্রযুক্তি, নিরাপদ লাল চিনি-গুড় উৎপাদন, সংরক্ষণ ও বাজারজাতকরণের ওপর প্রতি বছর পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ দিতে হবে। ৪) মিল বহির্ভূত এলাকায় আর্দ্রগরম বাতাস শোধিত ভিত্তি বীজ উৎপাদন, বর্ধন ও বিতরণের জন্য বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন ও বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সির সহায়তার প্রয়োজন রয়েছে। কারণ নিয়মিত লাইন থেকে লাইন বীজ ক্ষেত পরিদর্শন ও রোগিং ছাড়া বীজক্ষেতের কোনো মূল্য নেই। ৫) দেশের গুড় উৎপাদন এলাকাগুলোতে ছোটছোট গুড় মিল স্থাপনের ব্যাপারে বিএসআরআয়ের কৃষি প্রকৌশল বিভাগকে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি উৎপাদন করার উদ্যোগ নিতে হবে। ৬) কৃষি যন্ত্রপাতির মতো বিএসআরআই উদ্ভাবিত বিদ্যুৎ চালিত উন্নত আখ মাড়াই যন্ত্রের ওপর শতকরা ৭০ ভাগ ভর্তুকি দেয়া যেতে পারে। ৭) গুড় এলাকায় বিষাক্ত হাইড্রোজের ব্যবহার বন্ধের জন্য ব্যাপক ভিত্তিতে বন ঢেঁড়স ও ঘৃত কুমারির চাষ এবং উলটকম্বল ও শিমুল গাছের চারা রোপণ করতে হবে। ৮) মিল এলাকার মতো গুড় এলাকার আখ চাষিদের মধ্যে অবশ্যই স্বল্প সুদে কৃষি ঋণ প্রদান করা যেতে পারে। ৯) ভেজাল গুড় উৎপাদন ও বিপণন বন্ধে নিরাপদ খাদ্য অধিদপ্তরের ম্যাজিস্ট্রেটগণের সহাতায় নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করতে হবে এবং দোষিদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
লেখক : সাবেক মহাব্যবস্থাপক (কৃষি), বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন, পরিচালক (যোগাযোগ) কৃষাণ সীডস্, মফিজ উদ্দিন ইনডেক্স প্লাজা, ছোট বাজার, ময়মনসিংহ। মোবাইল: ০১৭২২৬৯৬৩৮৭;
পথরেখা/রাসু