দর্পণ কবীর, নিউইয়র্ক থেকে : নিউইয়র্ক বইমেলার কারণে বাংলা সাহিত্যের বরেণ্য লেখক-কবিদের সঙ্গে পরিচয় হবার সুযোগ হয়েছে আমার। যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত অন্যান্য লেখক-কবিসহ পাঠক ও সাহিত্যানুরাগীরা এই সুযোগটি পাচ্ছেন। এই বইমেলাকে কেন্দ্র করে প্রতিবছর লেখক-প্রকাশক-পাঠক ও সাহিত্যানুরাগীদের ‘মহামিলন মেলা’ দেখা যায় নিউইয়র্ক শহরে। এমন আয়োজন করার জন্য মুক্তধারা ফাউন্ডেশনকে ভালবাসা ও শ্রদ্ধার অর্ঘ্য নীরবে অর্পণ করি প্রতিবছর। বইমেলায় সমেবেত হই এবং স্টলে বা আড্ডায় থাকার চেষ্টা করি। নিউইয়র্ক বইমেলায় দেশের অনেক প্রতিথযশা লেখক-কবি এসেছিলেন। আমি এই লেখায় আমি প্রিয় দুই উপন্যাসিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এবং (সদ্য প্রয়াত) সমরেশ মজুমদারের কথা তুলে ধরছি।
২০০৪ সালে নিউইয়র্ক বইমেলায় অতিথি হিসাবে যোগ দিয়েছিলেন বরেণ্য উপন্যাসিক শীর্ষেন্দু মুখেপাধ্যায়। আমি তখন নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক ‘কাগজ’ পত্রিকার বার্তা সম্পাদক। আমি শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ভীষণ গুণমুগ্ধ পাঠক বলে তাঁর একটি সাক্ষাৎকার নিতে দ্বারস্থ হয়েছিলাম মুক্তধারা ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা বিশ্বজিৎ সাহার। তিনি আমার অনুরোধে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের সাক্ষাতকার গ্রহণের অভূতপূর্ব সুযোগ করে দেন অকৃত্রিম আন্তরিকতায়। বিশ্বজিৎ সাহার জ্যাকসন হাইটসের বাড়িতে আমি নিজের কন্যা এথিনাকে নিয়ে হাজির হই এবং শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের মুখোমুখি কয়েক ঘন্টা সময় অতিবাহিত করি। আড্ডা-আলোচনার মধ্য দিয়ে একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করি তাঁর। এ সময় বিশ্বজিৎ সাহা’র (মাতা রুমা চৌধুরী) কন্যা বহতা সাহা এবং পুত্র বিপ্রজিৎ সাহাও ছিল।
সেদিন আড্ডা-আলাপে শীর্ষেন্দু মুখেপাধ্যায়ও আমার কাছ থেকে জানতে চাইছিলেন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশি প্রবাসীদের জীবন-যাপনের কথা। অনেকরকম কথা আমাদের আলোচনায় উঠেছিল। একটি প্রসঙ্গে আমি প্রিয় লেখককে জানালাম যে, নিউইয়র্ক থেকে বাংলাদেশিদের এক ডজনের বেশি পত্রিকা বের হয়, কিন্তু তা মান সম্পন্ন নয়। তিনি আমাকে বললেন, বাংলাদেশিরা বাংলা ভাষায় পত্রিকার বের করছে, এটাই তো বড় কথা। ভাষার প্রতি এটাই ভালবাসা। এখন মান সম্পন্ন হচ্ছে না, একটা সময় মান সম্পন্ন হবে। কিন্তু পশ্চিম বাংলার বাঙালিরা কি পত্রিকা বের করছেন? আমি তাঁর এই প্রশ্নের জবাবে ‘না’ বলি। ঐ সময় নিজে বাংলাদেশি বলে তখন আমার অনুভবে মিহিনধারায় ‘গর্ব’ ছড়িয়ে যাচ্ছিল। যাক, সেদিন আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘কষ্টের ধারাপাত’ তুলে দিয়েছিলাম শীর্ষেন্দু মুখেপাধ্যায়ের হাতে। তিনি আমার সামনে মনযোগ দিয়ে বইটি দেখেন এবং একাধিক কবিতা পাঠও করেন। এদিন শীর্ষেন্দু মুখেপাধ্যায়ের খুব সাধারণ আচরণ এবং তাঁর মধ্যে যে বিনয় দেখেছি, এরপর থেকে তাঁর প্রতি অতল শ্রদ্ধা আরো বেড়ে যায়।
২০০৬ সালে পরিচয় হয় বাংলা সাহিত্যের আরেক বরেণ্য উপন্যাসিক সমরেশ মজুমদারের সঙ্গে। তিনিও ঐ বছর এসেছিলেন নিউইয়র্ক বইমেলায়। ঐ বছর তাঁর লেখা উপন্যাস (অনুবাদ) লিভস অফ ব্লাড এবং স্কাই ওভার দ্য মাউনটেন নামে দুটি বই বের হয় যুক্তরাষ্ট্রে। মার্কিন প্রকাশনী সংস্থ-এ ওয়ার্ল্ডহাউজ পাবলিকেসন্স থেকে বই দুটি বের হয়। এই বই দুটির প্রকাশনা অনুষ্ঠান হয়েছিল ম্যানহাটানে নিউইয়র্ক প্রেসক্লাব মিলনায়তনে। মূলধারার সাংবাদিকদের জন্য এই প্রকাশনী অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন মুক্তধারা’র বিশ্বজিৎ সাহা। আমি তখন যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রচারিত বাংলাদেশিদের প্রথম স্যাটালাইট টিভি-এসটিভি ইউএস-এর প্রধান বার্তা সম্পাদক। আকস্মিকভাবে সমরেশ মজুমদার হাজির হলেন এসটিভি ইউএস-এর হেড অফিসে (বর্নান ব্লুভার্ড, এস্টোরিয়া, নিউইয়র্ক)। তাঁর সঙ্গে বিশ্বজিৎ সাহা এবং আরো কয়েকজন বাংলাদেশি। যাঁর উপন্যাস পাঠ করে বড় হয়েছি এবং নিজের মধ্যে লেখক হবার ঘোর তৈরি করেছি, সেই উপন্যাসিক আমার টেবিলের সামনে চেয়ারে এসে বসেন আমার মুখোমুখি! এখানে বলতে হচ্ছে, আমি তাঁর উপন্যাস কালবেলা’র অনিমেষ হতে চেয়েছি বারবার এবং মাধবীলতার প্রেম পাব, এমন স্বপ্নেই বিভোর থাকতাম। সেই ‘চরিত্র’ সৃষ্টির স্রষ্টা আমার সামনে এসে বসেন। সমরেশ মজুমদারের ইংরেজী অনুবাদের বই প্রকাশনা অনুষ্ঠানে যেন আমি আরো সাংবাদিক নিয়ে যাই-এটাই ছিল তাঁর প্রত্যাশা। পাশ থেকে কেউ একজন বলেছিলেন, পশ্চিম বাংলার প্রবাসী বাঙালিরা কাজ ফেলে ঐ অনুষ্ঠানে যাবেন না বলে তিনি বাংলাদেশিদের উপস্থিতি কামনা করছেন। আমি এসটিভি ইউএস-এর সহকর্মীসহ আরো কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে ম্যানহাটানে নিউইয়র্ক প্রেসক্লাবে গিয়েছিলাম এবং ঐ সংবাদ ফলাও করে এসটিভি ইউএস-তে প্রচার করেছিলাম। এ ঘটনার পরও জ্যাকসন হাইটসে (পিএস ৬৯ মিলনায়তনে) অনুষ্ঠিত বইমেলায় প্রিয় এই লেখককের সঙ্গে আড্ডা হয়েছে। তিনি ছিলেন রাশভারী স্বভাবের। কথা বলতেন কম। প্রথমে দেখলে মনে হবে খুব বুঝি গম্ভীর টাইপ। মিশলে তাঁর ভেতরের খরস্রোতা নদীটা দেখা যেত। ঐ বছর বইমেলায় নিউইয়র্ক প্রবাসী সাংবাদিক মাহমুদ খান তাসের বইমেলা প্রাঙ্গনে তাঁকে অনেক প্রশ্ন করেন। কয়েকটি প্রশ্ন ছিল বেমক্কা টাইপের। আমি তাঁদের কথা শুনছিলাম। সমরেশ মজুমদার স্থান ত্যাগ করলে আমি তাসের ভাইকে এমন প্রশ্ন করার কারন কি-জানতে চাইলে তিনি সমরেশ মজুমদারের গম্ভীর (তার ভাষায় ভাব নিয়ে থাকা) চরিত্রকে চটকে দিতে এসব প্রশ্ন করেছেন বলে হেসে জানান।
সমরেশ মজুমদার অকালে পরপারে চলে না গেলে এ বছর তাঁকে হয়তো দেখা যেত, নিউইয়র্কে-বইমেলায়। তাঁর প্রয়াণ আমাদের বাকরুদ্ধ বিষাদে তলিয়ে দিয়েছে। আমরা শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়কে আরো একবার নিউইয়র্কে দেখতে চাই। তাঁর যে আলো ছড়িয়ে গেছেন, তা দিয়েই নিউইয়র্ক বইমেলায় আলোকিত, গৌরাম্বিত এবং সুবর্ণ ইতিহাসের বর্ণিল আলো ছড়িয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। সকল প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করে বইমেলার পরিধি আরো বাড়তে থাকুক বইপ্রেমিদের শক্তি নিয়ে।
বই সর্বোত্তম বন্ধু! বই আলোর দিশারী।বই কিনে কেউ ঠকেন না, বই পড়লে জ্ঞান অর্জন হয়। আর বইমেলা মানে, সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি আড্ডা। নিউইয়র্কের জামাইকা পারফর্মিং আর্ট সেন্টার ৩২তম বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়েছে ১৪ জুলাই থেকে ১৭ জুলাই।
[ছবিঋণ : ২০০৪ সালে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের হাতে আমার কাব্যগ্রন্থ। উপন্যাসিকের পাশে বহতা সাহা, বিপ্রজিৎ সাহা ও দিমিত্রা দর্পণ এথিনা]
পথরেখা/আসো