• মঙ্গলবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪
    ১০ পৌষ ১৪৩১
    ঢাকা সময়: ২২:১৪

অমরত্বের খোঁজে চিকিৎসাবিজ্ঞান

পথরেখা অনলাইন : বার্ধক্যজনিত রোগ অ্যালঝেইমারে আক্রান্ত আপনার মা ভর্তি হাসপাতালে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি ভুলে যাচ্ছেন সবকিছু। দিন দিন বেড়ে চলেছে মায়ের রোগের তীব্রতা। আপনাকে কিংবা পরিবারের কাউকেই চিনতে পারছেন না, মনে করতে পারছেন না নিজের নামও। অপরিচিতদের ভিড়ে সবসময় এক আতঙ্ক কাজ করছে তার মাঝে। হয়তো ডুকরে কেঁদে উঠছেন আবার হঠাৎ কখনো চিৎকার করে উঠছেন মা। কিংবা কোনো ভয়াবহ দুর্ঘটনায় আপনার সন্তানের শরীরের ভেতরের বেশ কিছু অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গেছে। তাকে বাঁচাতে প্রয়োজন অরগ্যান ট্রান্সপ্লান্টের কিন্তু আপনার সন্তানের সঙ্গে হুবহু মিলে যাচ্ছে এমন কোনো অরগ্যান ডোনার পাচ্ছেন না। মস্তিষ্কে আঘাত পাওয়ার কারণে স্মৃতিশক্তি কিংবা মোটর ফাংশন কাজ করছে না আর। সার্জারি না করতে পারলে সন্তান বেঁচে থাকবে কিন্তু সারা জীবন এসব প্রতিবন্ধকতা নিয়ে ঘুরে ফিরতে হবে তাকে। যদি বলা হয় আপনার জীবনের ঘড়ির কিছুটা সময় টেনে নিয়ে তার জীবনে প্রতিস্থাপন করা যাবে, কমে যাবে আপনার আয়ু, বিপরীতে বেড়ে যাবে তার জীবনের আয়ু এবং সুস্থ হয়ে উঠবে সে-এমন মুহূর্তে কী করবেন আপনি?
 
প্রিয় মানুষদের পিছে না ফেলে তাদের ভালোবাসায় এবং তাদের কাছ থেকে ভালোবাসা নিয়ে বেঁচে থাকার তীব্র আকাক্সক্ষা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। প্রিয় মানুষদের সঙ্গে নিয়ে সুখী দীর্ঘ জীবন কাটানোর স্বপ্ন আমরা সবাই দেখি। কিন্তু দুর্ঘটনা আর রোগে অকালমৃত্যু যেমন আসে, তেমনি জীবনের নিয়মে ঘনিয়ে আসে বার্ধক্য, আসে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, অস্টিওআর্থ্রাইটিস কিংবা আলঝেইমারের মতো বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন রোগ, দেয়াল তুলে দেয় সম্পর্কের মাঝে। দেয়াল ভাঙতে হলে অমরত্ব ছাড়া নেই কোনো পথ। প্রাগৈতিহাসিক সময় থেকেই দীর্ঘজীবন কিংবা অমরত্ব লাভের স্বপ্ন দেখেছে মানুষ। মেসোপটিয়ান পুরাণে যেমন গিলগামেশ ছুটেছিল অমরত্ব পদ্মের জন্য তেমনি হিন্দু ধর্মের পুরাণেও বলা হয়েছে অমরত্বের অমৃত নিয়ে দেবতা ও অসুরদের যুদ্ধের কথা। মানুষও সেই সঞ্জীবনী সুধা খুঁজেছে; যুগে যুগে বিজ্ঞানের সাহায্যে খোঁজ চলছে গিলগামশের সেই অমরত্ব পদ্মের খোঁজ কিংবা সাগরে ভেসে ওঠা অমৃতের। আর এই সম্পর্কের মাঝে হঠাৎ করে দাঁড়িয়ে যাওয়া দেয়াল ভেঙে ফেলতে কাজ করছে একদল গবেষক।
 
পুরাণ বা রূপকথার অমৃত মানুষ খুঁজে না পেলেও বিজ্ঞানের ওপর ভর করে দীর্ঘ জীবন লাভের নানা কৌশল উদ্ভাবন করে চলেছে। পৃথিবীর মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে। বার্ধক্যেও তরুণদের মতো ধারালো স্মৃতিশক্তি, টান টান ত্বক, নীরোগ দেহ নিয়ে বাঁচতে খাবার, ব্যায়াম ও নানা রকম ওষুধ ব্যবহার করছে মানুষ। এসব ছাড়াও জিনথেরাপি, অরগ্যান ট্রান্সপ্লান্ট, কোষ প্রতিস্থাপন, ব্লাড ইনফিউশন নানা রকম পদ্ধতিতে তারুণ্য ধরে রাখার চেষ্টা করছেন অনেকে। এ রকমই ভিন্ন আরেকটি কৌশল হেটেরোক্রনিক প্যারাবায়োসিস। সম্প্রতি একটি গবেষণার সুবাদে নতুন করে আলোচনায় এসেছে প্রক্রিয়াটি, গবেষণা সফল হলে মানুষের জন্য উন্মোচিত হবে নিরোগ ও দীর্ঘ জীবন লাভের নতুন দুয়ার।
 
প্যারাবায়োসিস আসলে বিশেষ এক ধরনের অস্ত্রোপচার। প্রায় দেড়শ বছর আগেই এই প্রক্রিয়াটি নিয়ে গবেষণা শুরু হয়। এই অস্ত্রোপচার মাধ্যমে দুটি প্রাণীর দেহের সংবহনতন্ত্র সংযুক্ত করা যায়। বহুকোষী প্রাণীর দেহে সংবহনের কাজে ব্যবহৃত অঙ্গগুলো মিলে যে তন্ত্র গড়ে ওঠে, তাকেই বলা হয় সংবহনতন্ত্র। যেমন-হৃৎপিণ্ড ও রক্তনালি নিয়ে গঠিত হয় বহুকোষী প্রাণীর রক্ত সংবহনতন্ত্র। প্যারাবায়োসিসের মাধ্যমে সংযুক্ত হওয়া দুটি প্রাণীই একে অপরের অঙ্গ এবং রক্ত-সংবহনতন্ত্র ব্যবহার করতে পারে, একের ধমনী বা শিরায় অন্যের রক্ত অনায়াসে বয়ে যেতে পারে। বার্ধক্যবিরোধী গবেষণায় এই প্রক্রিয়া দ্বারা সাধারণত একটি অল্পবয়স্ক প্রাণীর সঙ্গে একটি বৃদ্ধ প্রাণীকে জুড়ে দেওয়া হয়। তরুণ প্রাণীটির রক্ত বৃদ্ধ প্রাণীটির দেহে কোনো পরিবর্তন আনে কি না তা এই পরীক্ষা দ্বারা পর্যবেক্ষণ করেন গবেষকগণ।  
 
সম্প্রতি ডিউক হেলথ এবং হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের গবেষকদের একটি দল ইঁদুরদের ওপর প্যারাবায়োসিস পরীক্ষা চালিয়েছেন। বিজ্ঞানীদের দলটি কিছু অল্প বয়স্ক এবং বৃদ্ধ ইঁদুরের রক্ত সংবহন ব্যবস্থাকে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সংযুক্ত করেন। কিছুদিন পর দেখা গেল, বৃদ্ধ ইঁদুরগুলো আগের মতো বুড়িয়ে যাচ্ছে না, বার্ধক্যের গতি কমে  গেছে। এমনকি এই পরীক্ষার পরে বৃদ্ধ ইঁদুরগুলোর গড় আয়ু ছয় থেকে ১০ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। অবশ্য তরুণ ইঁদুরগুলো দ্রুত বুড়িয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু আলাদা হওয়ার পরে তাদের বয়স বেড়ে যাওয়ার গতিও স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে।
 
প্যারাবায়োসিস পরীক্ষাগুলো মাত্র এক মাস বা ৪৫ দিন স্থায়ী হয়। কিন্তু গবেষক দলটি প্রায় তিন মাস ইঁদুরগুলোকে এই অবস্থায় রাখেন। তিন মাস পর তারা ইঁদুরগুলোকে আবারও অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে বিচ্ছিন্ন করেন। এরপর প্রায় আরও দুমাস ধরে ইঁদুরদের  রক্তের বার্ধক্য নির্দেশকারী আণবিক মার্কারগুলো নিয়ে গবেষণা করেন। তারা দেখেন বয়স্ক ইঁদুরগুলোর লিভার টিস্যু এবং রক্তকণিকার স্থায়িত্ব বেড়ে গেছে। এর আগেও প্যারাবায়োসিস গবেষণায় দেখা গিয়েছিল, জিডিএফ-১১ নামের একটি বিশেষ প্রোটিন রয়েছে তরুণ ইঁদুরের রক্তে, যার প্রবাহ বয়স্ক ইঁদুরের দেহ ও মস্তিষ্কের স্টেম সেলের সংখ্যা বাড়িয়ে দিতে সক্ষম। স্টেম সেল হলো বহুকোষী প্রাণীর পেশি এবং মস্তিষ্কের সেইসব কোষ, যেগুলো দেহের অন্যান্য কোষের মতো বিভাজিত হয় না বা বৃদ্ধি পায় না।
 
তবে গবেষক দলটি এখনও বয়স্ক ইঁদুরের আয়ু বৃদ্ধির কারণ নিয়ে পুরোপুরি নিশ্চিত নন। তারা ধারণা করছেন রক্তে থাকা বিশেষ কোনো প্রোটিন বা কোনো মাইক্রো আরএনএ’এর কারণেই এমনটা ঘটছে। হার্ভার্ডের মেডিকেল স্কুলের অধ্যাপক ভাদাম এন গ্ল্যাডিশেড বলেন, ‘আমরা এখনো পুরোপুরি নিশ্চিত নই বিষয়টি নিয়ে। তবে,  বৃদ্ধ ইঁদুরের শরীরে তরুণ রক্তের প্রবাহই এর বার্ধক্য ধীরগতির হওয়ার একমাত্র কারণ নয় এ বিষয়ে নিশ্চিত আমরা।’ গবেষণার সময় কাল দুই মাস হওয়ায় ল্যাব র‍্যাটগুলোর শরীরে দীর্ঘমেয়াদি কোনো পাশর্^প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছিল কি না এ ব্যাপারে নিশ্চিত নন তারা। এছাড়া প্যারাবায়োসিসের স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পাশর্^প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে যথেষ্ট তথ্যও নেই এই গবেষকদের কাছে।
 
এই গবেষণা থেকে প্রাপ্ত ফলাফল অনেকের মনেই নতুন আশার জন্ম দিচ্ছে। ভাবা হচ্ছে, একজন ২৫ বছর বয়সি তরুণের রক্ত যদি ৮০ বছরের বৃদ্ধের দেহে প্রবেশ করানো হয়, তা হলে হয়তো বৃদ্ধ ব্যক্তিটির দেহ পুনরুজ্জীবিত করা সম্ভব। অনেকেই ভাবছেন, হয়তো এই প্যারাবায়োসিস প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই মানবমস্তিষ্কেও স্টেম সেল উৎপাদন সম্ভব, সম্ভব আলঝেইমার কিংবা পেশির নানা রোগের চিকিৎসা। কিন্তু মানুষের শরীর ইঁদুরের দেহের চেয়ে অনেক বেশি জটিল হওয়ায় এখন পর্যন্ত সুযোগ থেকে ঝুঁকির পরিমাণ অনেকটাই বেশি বলে ধারণা করেছেন গবেষকরা। তবে পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের পর ক্লিনিক্যাল টেস্টে যেতে পারলে চিকিৎসাবিজ্ঞানে খুলতে পারে আরেক সম্ভাবনার দুয়ার, বাস্তবে রূপ নিতে পারে পুরাণের ‘ফিলোসফার স্টোন’।
পথরেখা/আসো  

  মন্তব্য করুন
আরও সংবাদ
×

পথরেখা : আমাদের কথা

আমাদের পোর্টালের নাম— pathorekha.com; পথরোখা একটি অনলাইন নিউজ পোর্টাল। আমরা এই প্রতিষ্ঠানকে প্রতিদিনের সত্য-সংবাদের পথরেখা হিসেবে প্রমাণ করতে চাই। পথরেখা সারাদেশের পাঠকদের জন্য সঠিক ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ এবং মতামত প্রকাশ করবে। পথরোখা নিউজ পোর্টাল হিসেবে ২০২৩ সালের জুন মাসে যাত্রা শুরু করলো। অচিরেই পথরেখা অনলাইন মিডিয়া হিসেবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ে নিবন্ধনের প্রক্রিয়া শুরু করবে। পথরোখা  দেশ কমিউনিকেশনস-এর অঙ্গ প্রতিষ্ঠান।
 
পথরোখা জাতীয় সংবাদের উপর তো বটেই এর সঙ্গে রাজনীতি, আন্তর্জাতিক, খেলাধুলা, কৃষি, বিনোদন, অর্থনীতি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, তথ্য ও প্রযুক্তিসহ বিভিন্ন বিভাগকেও গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করে। মাল্টিমিডিয়া সাংবাদিকতা এবং চৌকস ফটোগ্রাফিকে বিশেষ বিবেচনায় রাখে।
 
পথরোখা’র সম্পাদক আরিফ সোহেল এই সেক্টরে একজন খুব পরিচিত ব্যক্তিত্ব। সাংবাদিক হিসেবে তার দীর্ঘ ৩০ বছর কর্মজীবনে তিনি দৈনিক বাংলাবাজার পত্রিকা, আজকের কাগজ, রিপোর্ট২৪ ডটকম প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন। এ ছাড়া তিনি সরকারী ক্রীড়া পাক্ষিক ‘ক্রীড়া জগত’ ও লাইফস্টাইল ম্যাগাজিক অপ্সরা নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন। তিনি জনপ্রিয় অনলাইন দেশকণ্ঠের নির্বাহী সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।
 
পথরেখা দেশের মৌলিক মূল্যবোধ, বিশেষ করে জাতীয় সার্বভৌমত্ব, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ। এছাড়াও, এটি দেশের নাগরিকের মানবিক ও নাগরিক অধিকারের পক্ষে কথা বলবে। ন্যায়পরায়ণতা, নির্ভুলতা এবং বস্তুনিষ্ঠতা বজায় রাখতে আমরা অঙ্গীকারাবদ্ধ। আমরা বিশ্বাস করি যে জনগণের বিশ্বাসযোগ্যতা আমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। পথরেখা রাজনৈতিক ইস্যুতে নির্দলীয় অবস্থান বজায় রাখবে। একটি নিরপক্ষ অনলাইন হিসেবে আমরা নিজেদের কর্মকাণ্ডে প্রমাণ করার শতভাগ প্রছেষ্টা করব। তবে সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করেও কিছু ভুল হতেই পারে। যা ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রাখছি সব মহলেই। সততা পথে অবিচল; আলোর পথে অবিরাম যাত্রায় আমাদের পাশে থাকুন; আমরা থাকব আপনাদের পাশে।
 
উল্লেখ্য, পথরেখা হিসেবে একটি প্রকাশনী দীর্ঘদিন থেকে প্রকাশিত হয়ে আসছে। এবার উদ্যোগ নেওয়া হলো অনলাইন অনলাইন নিউজ পোর্টাল হিসেবে প্রকাশ করার।