বিশেষ প্রতিবেদন : ঢাকার মণিপুরিপাড়ার যে বাসায় মুর্তজা বশীর থাকতেন, শিল্পীর মৃত্যুর পর সেই ফ্ল্যাটটিকে সংরক্ষণ করা হয়েছে স্মৃতি জাদুঘর হিসেবে। গবেষণার প্রয়োজনে অনুমতি সাপেক্ষে সেটি ব্যবহার করা যাবে, এছাড়া প্রতি মাসে একদিন সর্বসাধারণের জন্য সংগ্রহশালাটি উন্মুক্ত রাখা হবে বলে জানিয়েছেন তার বড় মেয়ে মুনীরা বশীর। ঢাকার মণিপুরিপাড়ার যে বাসায় মুর্তজা বশীর থাকতেন, শিল্পীর মৃত্যুর পর সেই ফ্ল্যাটটিকে সংরক্ষণ করা হয়েছে স্মৃতি জাদুঘর হিসেবে। তবে পর্যাপ্ত জনবল ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো না থাকায় সেটি এখনো সবার জন্য উন্মুক্ত করা সম্ভব হয়নি বলে জানিয়েছেন মুর্তজা বশীরের বড় মেয়ে মুনীরা বশীর।
গবেষণার প্রয়োজনে অনুমতি সাপেক্ষে সেটি ব্যবহার করা যাবে বলেও জানান তিনি। এছাড়া প্রতি মাসে একদিন সর্বসাধারণের জন্য সংগ্রহশালাটি উন্মুক্ত রাখা হবে। মুর্তজা বশীরকে যারা জানতে চান, তাদের জন্য এ শিল্পীর বিচিত্র সংগ্রহশালার একাংশ প্রতি মাসের বিশেষ দিনে প্রদর্শন করাসহ নানা পরিকল্পনা করছে মুর্তজা বশীর ট্রাস্ট। বৃহস্পতিবার শিল্পী মুর্তজা বশীরের ৯১তম জন্মদিনে তার ব্যক্তিগত সংগ্রহ আর বিভিন্ন শিল্পকর্মের প্রদর্শনী করা হয়। এছাড়া শিল্পীর ঘনিষ্ঠ বন্ধু আর স্বজনদের নিয়ে আয়োজন করা হয় প্রীতি সম্মেলন। বহুভাষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর কনিষ্ঠ সন্তান মুর্তজা বশীরের জন্ম ১৯৩২ সালের ১ ৭ অগাস্ট। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ২০২০ সালের ১৫ অগাস্ট তিনি চিরবিদায় নেন।
তার মৃত্যুর পর ওই বছরের ডিসেম্বরে প্রতিষ্ঠিত হয় মুর্তজা বশীর ট্রাস্ট। এছাড়া পারিবারিক অর্থায়নে 'আল্ট্রামেরীন' নামে আরেকটি উদ্যেগও গ্রহণ করা হয়। যেখান থেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগে প্রতি বছর মেধাবৃত্তি দেওয়া হচ্ছে। ‘আলট্রামেরীন’ এর পরিচালক মুর্তজা বশীরের আরেক মেয়ে মুনিজা বশির বলেন, আলট্রামেরীন অলাভজনক পারিবারিক উদ্যোগ, যেখান থেকে স্মৃতিপদক চারজনকে দেওয়া হয়। এছাড়া বিভিন্ন জনহিতকর কাজ করাটাই আমাদের লক্ষ্য। আলট্রামেরীন হলো শিল্পী মুর্তজা বশীর স্মৃতি রক্ষার্থে ব্যক্তিগত তহবিলে পরিচালিত একটি অলাভজনক ও কল্যাণমুখী উদ্যোগ। মুনীরা বশীর বলেন, বাবা এই ফ্ল্যাটে ২০০৩-১৩ সাল পর্যন্ত থাকতেন। বাবা মারা যাওয়ার পর ফ্ল্যাটে বাবার যত সংগ্রহ ছিল, সেগুলো যত্ন করে রেখেছি। প্রথম বছর আমরা ঠিক গুছিয়ে উঠতে পারিনি। গেলো বছর জন্মদিনে উন্মুক্ত করেছি। এ বছর থেকে কেউ চাইলে অনুমতি নিয়ে গবেষণার জন্য সংগ্রহশালাটি ব্যবহার করতে পারবেন। সংগ্রহশালায় স্থান পেয়েছে শিল্পীর আঁকা একশর বেশি আত্মপ্রতিকৃতি, তার সংগ্রহ করা পাঁচ শতাধিক চাবির রিং, দুর্লভ মুদ্রা, ডাক টিকেট, পুঁথি, ভাস্কর্য, চিত্রকর্ম আর শিল্পীর ব্যবহৃত আসবাবপত্র, রঙ তুলি ও আঁকার সরঞ্জাম। এছাড়া মুর্তজা বশীর ও তারা বাবা ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর লেখা বিভিন্ন চিঠিসহ নানা সংগ্রহ প্রদর্শন করা হয়।
মুনীরা বলেন, বাবার প্রচুর সংগ্রহ রয়েছে। সরকারের উচিত নতুন প্রজন্মের জন্য বাবার স্মৃতিচিহ্ন এবং শিল্পকর্ম সংরক্ষণ করা। এক সময় আমরা থাকব না, কিন্তু ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কেউ যদি মুর্তজা বশীর এবং ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহকে নিয়ে কাজ করতে চায়, তবে তাদেরকে এখানে স্বাগতম। বাসাটিতে প্রবেশ করেই দেখা গেল ছোট্ট একটি ব্যানারে লেখা আধুনিক চিত্রের মতোই আমার ছেলে দুর্বোধ্য। ছেলে মুর্তজা বশীর প্রসঙ্গে পিতা ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর উক্তি এটি। এই ব্যানারের পাশে বসেই মুর্তজা বশীরকে নিয়ে নানা স্মৃতিচারণায় মেতে উঠেন তার স্বজন আর কাছের মানুষেরা। অনানুষ্ঠানিক কথোপকথনে উঠে আসে মুর্তজা বশীরের বর্ণিল জীবনের নানা স্মৃতি।
অধ্যাপক নিসার হোসেন বলেন, সবাই সাধারণত পারিবারিক পরিচয়টাকে সামনে রেখে এগিয়ে যেতে চান। মুর্তজা বশীর ব্যতিক্রম। উনার বাবা ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ দেশের খ্যাতিমান একজন মানুষ। কিন্তু মুর্তজা বশীর বাবার পরিচয়কে আড়াল করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এটা খুবই কঠিন কাজ, পিতার পরিচয় থেকে সরে এসে নিজের আত্মবিশ্বাস থেকে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, আবার নিজেকেই তিনি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছেন। আলোকচিত্রী নাসির আলী মামুন বলেন, সব সময় সক্রিয় থাকা সবাই পারে না। বশীর ভাই সক্রিয় থাকতেন। নিজের প্রচুর আত্মপ্রতিকৃতি এঁকেছেন, অন্যদেরও অনেক প্রতিকৃতি এঁকেছেন।
বক্তব্য দেন লেখক হাসনাত আব্দুল হাই, লুভা নাহিদ চৌধুরী, আলোকচিত্রী নাসির আলী মামুন, অধ্যাপক নিসার হোসেন, শিল্পী মোস্তফা জামানসহ অনেকে। উপস্থিত ছিলেন প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান। হাসনাত আব্দুল হাই বলেন, এই বাড়িতে আমি অনেক এসেছি, এখানে বসে আমরা অনেক আলাপ করেছি। তার যে সংগ্রহের শখ ছিল, কত বিষয়ে যে তার শখ ছিল। জীবনকে ভালোবেসেছেন, জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা মানুষকেও ভালোবেসেছেন। তার যে ডক্যুমেন্টশন, সেটা আমাদের সমৃদ্ধ করেছে। তার কাছ থেকে অনেক বই ধার নিয়ে পড়েছি। তার নিজের আত্মপ্রতিকৃতি নিয়ে একটা একক প্রদর্শনী করেছিলেন। কোনো শিল্পী এত আত্মপ্রতিকৃতি এঁকেছেন, আর এত বৈচিত্রপূর্ণ অভিব্যক্তি, সেটা খুব বেশি নেই।" মুর্তজা বশীর অমর হতে চাইতেন উল্লেখ করে হাসনাত আব্দুল হাই বলেন, প্রায়ই একটা কথা বলতেন, আমার মৃত্যুর পর মানু্ষ আমাকে মনে রাখবে তো? আমি অমর হব তো? এখানে এসে ভালো লাগছে যে মুর্তজা বশীরকে সবাই মনে রেখেছে। লুভা নাহিদ চৌধুরী বলেন, গবেষকরা যেন এখানে এসে কাজ করতে উৎসাহী হয়, তার জন্য মুর্তজা বশীরের স্মৃতি সংগ্রহশালার ভাবতে হবে। এর জন্য সরকারের উচিত সহযোগিতা করা।
পথরেখা/আসো