বিশেষ প্রতিবেদন : একটা সময় মাল্টিলেভেল মার্কেটিং বা এমএলএম ব্যবসার ফাঁদ পেতে যুবক, ডেসটিনি, ইউনিপেটুইউর মতো প্রতিষ্ঠান দেশের সাধারণ মানুষের হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে। বাড়তি মুনাফার লোভে হুমড়ি খেয়ে পড়ে তখন সর্বস্বান্ত হয়েছেন হাজারো বেকার-যুবক। যুবক-ডেসটিনির মতো ওই এমএলএম ব্যবসা এখন আর নেই। তবে এখন অনলাইনে ডিজিটাল এমএলএমের ফাঁদ পেতে লুটে নেওয়া হচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা।
ঘরে শুয়ে-বসে অল্প সময়ে লাখ লাখ টাকা আয়ের প্রলোভন দিয়ে আকৃষ্ট করা হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। আর সাধারণ মানুষ ভালো-মন্দ যাচাই-বাছাই না করে ‘হঠাৎ আঙুল ফুলে কলাগাছ’ হওয়ার লোভে ঝাঁপিয়ে পড়ছে অনলাইন বিনিয়োগে। যখন লাখ লাখ টাকা খুঁইয়ে নিঃস্ব হচ্ছেন তখন হা-হুতাশ ও চোখের পানি ফেলা ছাড়া আর কিছুই করার থাকছে না। এই অনলাইন প্রতারক চক্র দেশের সাধারণ মানুষের টাকা এভাবে লুট করে হুন্ডির মাধ্যমে পাচারও করে দিচ্ছে বিশে^র বিভিন্ন দেশে। ফলে দেশের টাকা চলে যাচ্ছে বিদেশে।
জানা গেছে, মহামারি করোনার মধ্যে ২০২০ সালের পর থেকে এই অনলাইন বেটিংয়ের নামে প্রতারণার ফাঁদ পাতা হয়। গত তিন বছরে এর ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। একেক সময় একেক রকম চটকদার অনলাইন ট্রেডিং গ্রুপ খুলে অর্থ লোপাট করা হচ্ছে। সবশেষ এমটিএফই নামের একটি প্রতিষ্ঠান অনলাইন ট্রেডিংয়ের নামে বাংলাদেশিদের কাছ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে টাকা তোলার সুযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। এখন আর তাদের কোনো হদিস মিলছে না।
জানা গেছে, বাংলাদেশ থেকে মোট ৮ লাখ অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে এমটিএফইর অ্যাপে। শুধু বাংলাদেশ নয়-দুবাই, ওমান, কাতার, সৌদি আরবের মতো দেশগুলোতে কর্মরত বাংলাদেশিরাও এমটিএফইতে বিপুল পরিমাণের অর্থ বিনিয়োগ করেছে। তবে বাংলাদেশে এদের কোনো অফিস নেই। এমটিএফই হচ্ছে মেটাভার্স ফরেন এক্সচেঞ্জ গ্রুপ নামে একটি ক্রিপ্টোকারেন্সি (যেমন-বিট কয়েন) ট্রেডিং প্ল্যাটফর্ম। এখানে বিনিয়োগকারীদের উচ্চ মুনাফার প্রলোভন দেখিয়ে অ্যাকাউন্ট খোলানো হয়। ক্রিপ্টো ট্রেডিং বাংলাদেশে নিষিদ্ধ হলেও এমটিএফইতে ক্রিপ্টো ট্রেডিং করে মুনাফা লাভের পাশাপাশি আরেকটি প্রলোভন দেখানো হয়। একজন গ্রাহক যদি নতুন কাউকে এখানে বিনিয়োগে উদ্বুদ্ধ করেন, তা হলে তিনি নতুন গ্রাহকের বিনিয়োগ থেকেও স্বয়ংক্রিয়ভাবে অতিরিক্ত আয় করতে পারবেন। ডেসটিনির মতো এটিও একটি এমএলএম কোম্পানি।
অনলাইন প্ল্যাটফর্মে থাকলেও এমটিএফই নিজেদের কানাডিয়ান কোম্পানি দাবি করে, যার প্রতিষ্ঠাকাল ২০০৫ সালে। তবে বাংলাদেশে এ বছরের জানুয়ারি মাসে তাদের কার্যক্রম পুরোদমে শুরু হয়েছে। এমটিএফইর বিরুদ্ধে কানাডিয়ান সিকিউরিটিজ অ্যাডমিনিস্ট্রেটরসের (সিএসএ) কাছে প্রতারণার বেশ কয়েকটি অভিযোগও রয়েছে।
শুরু থেকে অস্বাভাবিক মুনাফা দিয়ে আকৃষ্ট করে ভুয়া এই প্রতিষ্ঠানটি। এতদিন ঠিকমতো মুনাফা দিলেও আগস্টের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকেই বিভিন্ন গ্রুপে এমটিএফইর গ্রাহকরা অভিযোগ করছিলেন যে, তাদের অ্যাকাউন্টে ডলার থাকলেও তারা উত্তোলন করতে পারছেন না। সবশেষ বৃহস্পতিবার পর্যন্ত চেষ্টা করেও কোনো লাভ হয়নি। প্রতিষ্ঠানটির কোনো কাস্টমার কেয়ার নেই বা যোগাযোগের মতো কোনো অফিস নেই। তাই সবাই এ বিষয়ে ফেসবুকে লেখালেখি শুরু করেন। কিন্তু বৃহস্পতিবার রাতে অনেকের ওয়ালেটের ডলারের পরিমাণ শূন্য এবং ঋণাত্মক হয়ে যায়। তখন তারা বুঝতে পারেন যে তারা প্রতারিত হয়েছেন।
এমটিএফইর মাধ্যমে এ পর্যন্ত কত টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে তা না জানা গেলেও বিভিন্ন অসমর্থিত সূত্রে বলা হচ্ছে, প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার মতো পাচার হয়েছে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক বা সাইবার পুলিশ এ বিষয়ে কোনো তথ্য দিতে পারেনি। বারবার এভাবে প্রতারিত হওয়ার পরও কেন এই অনলাইন ট্রেডিংয়ের প্রতি ঝুঁকে পড়ছেন সাধারণ মানুষ? এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ও মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, ‘অতিলোভ ও হঠাৎ করে বড় লোক হওয়ার মনোভাবেই ঠকার পরও আবার আসছে এই লাইনে।’
জানা গেছে, এমটিএফই বাংলাদেশে কার্যক্রম শুরু করে ২০২১ সালে। তিন বছরে এমটিএফইতে শুধু বাংলাদেশ থেকেই ৪২ লাখ মানুষ যুক্ত হয়েছেন। প্রাথমিক অবস্থায় এমটিএফই অ্যাপে যুক্ত প্রত্যেকেই ৬১, ২০১, ৫০১, ৯০১ ও ২ হাজার ডলার ডিপোজিট করেন। বেশি টাকা আয় করতে কেউ কেউ ৫ হাজার ডলারের বেশিও বিনিয়োগ করেছেন। এর মধ্যে কেউ জমানো টাকা, কেউবা এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে আবার কেউ জমি বন্ধক রেখে বিনিয়োগ করেছিলেন। প্রথমে গত ৭ আগস্ট সিস্টেম আপগ্রেডের কথা বলে গ্রাহকদের টাকা উত্তোলন সেবা বন্ধ করে এমটিএফই। এরপর গত বৃহস্পতিবার (১৭ আগস্ট) রাতে হুট করে প্রায় সব গ্রাহকের ভার্চুয়াল অ্যাকাউন্ট ঋণাত্মক দেখানো শুরু করে অ্যাপটি। প্রতিষ্ঠানটির দাবি, তাদের ব্যবসায় লোকসান হয়েছে। এজন্য উল্টো গ্রাহকদের কাছ থেকেই তারা টাকা পাবে। ফলে প্রতিষ্ঠানটিতে বিনিয়োগ করা গ্রাহকরা লাভের গুড় তো পায়নি বরং তাদের ঘাড়ে আরও ঋণের বোঝা চেপেছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, এমটিএফই’র প্রতারণা নিয়ে বিভিন্ন আলোচনা ও তথ্য পেলেও এখনও লিখিত কোনো অভিযোগ কিংবা মামলা হয়নি। তবে মামলা না পেলেও এ বিষয়ে ছায়াতদন্ত চলছে। এমটিএফই’র কার্যক্রম সম্পূর্ণ বায়বীয় হলেও বাংলাদেশে তাদের অনেক রিপ্রেজেনটেটিভ এবং ৪০০’র মতো সিইও’র সন্ধান পাওয়া গেছে। তাদের বিষয়ে গোয়েন্দা নজরদারি ও তথ্য সংগ্রহ বাড়িয়েছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংশ্লিষ্টরা। এসব সিইওদের আটক করতে একাধিক সংস্থা কাজ করছে।
পুলিশের কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, এমটিএফই’র গ্রাহকদের অধিকাংশই অ্যাপটির বিষয়ে জানতো না। তারা স্থানীয় সিইওদের সভা-সেমিনারে অংশগ্রহণ করে অ্যাপটির বিষয়ে জানতে পারেন। এরপর প্রলোভিত হয়ে বিনিয়োগ করেন। এই দায় সিইওরা এড়াতে পারে না। তাই তাদের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। যদিও এমটিএফই’র প্রতারণার বিষয়ে এখনও কোনো লিখিত অভিযোগ পাওয়া যায়নি। তবে আমরা আমাদের কাজ করছি। এখন পর্যন্ত ৪০০ জন্য সিইও’র বিষয়ে তথ্য পাওয়া গেছে। গোয়েন্দা নজরদারির মাধ্যমে তাদের বিরুদ্ধে আরও তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে।
সিআইডির সাইবার ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড রিস্ক ম্যানেজমেন্ট বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার রেজাউল মাসুদ বলেন, বাংলাদেশে এমটিএফই’র যারা পরিবেশক বা প্রচারণার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তাদেরকে আইনের আওতায় আনা হবে। এ ছাড়া কেউ যদি অভিযোগ দেয় সে তাদের আমরা আইনের আওতায় আনব। এ ছাড়া কেউ যদি অভিযোগ দেন, সে বিষয়েও আমরা ব্যবস্থা নেব। এমটিএফই একটি ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম চক্র। তাদের কার্যক্রম ছিল সম্পূর্ণ বায়বীয়।
এ বিষয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শাহীন মোল্লাহ সময়ের আলোকে বলেন, ‘এখন ডিজিটাল যুগ। সবার হাতে হাতে স্মার্ট ফোন। সবসময় পড়ে থাকে অনলাইনে। অনলাইনের এই বিশাল ভুবনে কখন, কোথায় কি ঘটছে তা মুহূর্তের মধ্যেই নজরে চলে আসছে। ঠিক তেমনি অনলাইনে ট্রেডিংয়ের মাধ্যমে যে শর্টকাট লাখ লাখ টাকা আয় করা যায় সেটিও যুব সমাজের নজর এড়াচ্ছে না। চটকদার বিজ্ঞাপন দেখে তারা ঝুঁকে পড়ছে এর প্রতি। দেখা যাচ্ছে শিক্ষিত বেকার এবং কলেজ-বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্ররাই এতে আকৃষ্ট হচ্ছে বেশি। হয়তো প্রথমে একজন এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। প্রথমে সে বেশ মোটা অঙ্কের টাকা কামাচ্ছে। পরে সে হয়তো বন্ধুদের সামনে গল্প করছে বা বন্ধুদের জানাচ্ছে। পরে তার দেখে অন্যরাও আসছে।’
তিনি বলেন, ‘আসলে এভাবে অনলাইনে বিনিয়োগ করে অনেকেই নিঃস্ব হচ্ছে, কিন্তু আবারও বিনিয়োগ করছে বা অন্যরাও এ থেকে শিক্ষা না নিয়ে তারাও বিনিয়োগ করছে। শর্টকার্ট বড় লোক হওয়ার লোভেই তারা এর প্রতি ঝুঁকে পড়ছেন। তা ছাড়া সমাজে এখন শিক্ষিত ও ভালো মানুষের কোনো কদর নেই, সম্মান নেই। যার টাকা বেশি, যে বেশি সম্পদশালী তারই সম্মান বেশি। যদিও সে লোক মূর্খও হয়-তাও টাকার কারণে সবাই তাকে সম্মান দেয়। এই যুগের যুবকদের মনে এই বিষয়টি বেশ নাড়া দেয়। তারাও অল্প সময়ে বেশি টাকা আয় করে সমাজে একটা অবস্থান করে নিতে চায়। এই উচ্চাকাক্সক্ষা তাদের অনলাইন ট্রেডিংয়ের দিকে ধাবিত করছে।
এদিকে অর্থনীতিবিদ ও পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর এ বিষয়ে সময়ের আলোকে বলেন, ‘অনলাইন ট্রেডিংয়ে যুব সমাজের ঝুঁকে পড়ার পেছনে অতিলোভ যেমন কাজ করে, তেমনি এর পেছনে বেকারত্বও অনেকাংশে দায়ী। কারণ, অনেক শিক্ষিত বেকার কোনো চাকরি পাচ্ছে না। বেকার বসে আছে, পরিবারের বোঝা হয়ে আছে। শেষ পর্যন্ত অনেকে ধারদেনা করে হলেও এই পথে নামছে। অনলাইনে ব্যবসা করতে এসে আরও নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে। কাজেই দেশে কর্মসংস্থান বাড়ানোর বিকল্প নেই। বেকার যুবকদের কর্মসংস্থান করা গেলে এই ঝুঁকির পথে পা বাড়াবে না।
পথরেখা/আসো