বিশেষ প্রতিবেদন : ঢাকাই শাড়ি কেন? শাড়িই যে পরতেই হবে এমনও নয়। কিন্তু গানের আত্মমগ্নতায় যেন কোনও ঘাটতি না থাকে। কেউ জিন্স পরেও গান করতে পারে রবীন্দ্রনাথের গানের কর্মশালা এবং কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় মেমোরিয়াল ট্রাস্টের উদ্যোগে আর্কাইভ নিয়ে আলোচনায় রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী রেজ়ওয়ানা চৌধুরী বন্যা শান্তিনিকেতন এবং কলকাতায় ঝটিকাসফরে। এক ফাঁকে কথা বললেন নানা বিষয়ে কথা। তাই এখানে উপস্থাপনা—
প্রশ্ন : বিভিন্ন রাজ্য থেকে আসা ছাত্রছাত্রীদের জন্য রবীন্দ্রনাথের গানের উপর একটি কর্মশালা পরিচালনা করলেন। গান শেখার ক্ষেত্রে কর্মশালা কতটা জরুরি?
রেজ়ওয়ানা : এই ধরনের কর্মশালা রবীন্দ্রসঙ্গীত শিক্ষায় পুরোপুরি কাজ করে না। একটা গান শিখে, তা নিয়ে চর্চা করা যায়, এইটুকুই। গান গুরুমুখী বিদ্যা। এখন সবাই দ্রুত সব কিছু শিখতে চায় বলে শিল্পের ক্ষেত্রে কর্মশালার প্রয়োজনীয়তা আরও বেড়েছে।
প্রশ্ন : এক মিনিটের গান, গানের রিল— এই ভাবনাগুলোকে কী চোখে দেখেন?
রেজওয়ানা : আমি কর্মে, মননে পুরনোপন্থী। এখন গতির সময়। দ্রুত গতি। সেখানে অস্থির মানুষ এক মিনিটের গান শুনে হয়তো আনন্দ পাচ্ছেন। কিন্তু এতে আমার মনে হয় না শিল্পীর স্থায়িত্ব তৈরি হচ্ছে। এক মিনিটের গানে, রিলে অনেক চমক আছে। মানুষ শুধু গান কেন, যে কোনও কিছুতেই চমক চাইছে। কিন্তু চমক দীর্ঘ সময়ের হয় না। রবীন্দ্রনাথের গান যেমন নিষ্ঠা আর ভালবাসার বিষয়। জানি না, সকলে আমার সঙ্গে একমত হবেন কি না।
প্রশ্ন : রেজ়ওয়ানা চৌধুরী বন্যা মানেই ঢাকাই শাড়ি, মাথায় ফুল…
রেজওয়ানা : দেখুন আমি মনে করি না যে, ঢাকাই শাড়ি, চুলে ফুল খুব একটা বড় ব্যাপার। যার যেমন রুচি, সে তেমন সাজবে। বড় ব্যাপার রবীন্দ্রানাথের গানকে আত্মস্থ করে উপস্থাপনা। মনে রাখতে হবে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, “শিল্প প্রাসঙ্গিক না হলে তা মৃত শিল্প।” রবীন্দ্রনাথের সময়ে যে ভাবে গান গাওয়া হত, তা আমাদের সময়ে বদলে গিয়েছিল। আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের ক্ষেত্রেও তা বদলাবে। ঢাকাই শাড়ি কেন? শাড়িই যে পরতে হবে এমনও নয়। কিন্তু গানের আত্মমগ্নতায় যেন কোনও ঘাটতি না থাকে। কেউ জিন্স পরেও গান করতে পারে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শ্রোতাদের চাহিদাও কিন্তু বদলাচ্ছে। তাঁরাও শিল্পীকে কিন্তু অন্য ভাবে দেখতে চাইতেই পারেন।
প্রশ্ন : ঢাকায় রবীন্দ্রসঙ্গীত বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি হল?
রেজ়ওয়ানা : একটু আগে থেকে বলি। ১৯৯২ সালে রবীন্দ্রসঙ্গীত শিক্ষার কাজ শুরু করি। ২০০৯ সালে ‘সুবিধা বঞ্চিত বাচ্চা’দের নিয়ে কাজ শুরু করি। ঢাকায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর স্তরে রবীন্দ্রনাথের গান পড়ানো হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় শুরু করেছি, ‘সৃজন কলা বিশ্ব বিদ্যালয়’।
প্রশ্ন : আজকের এই দ্রুত সময়ে অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে রবীন্দ্রনাথের গান মানুষ আর পুরো শুনতে চান না…
রেজ়ওয়ানা : তাতে কী-ই বা এসে যায়! রবীন্দ্রনাথের গানের মর্যাদা এত ঠুনকো নয়। যাঁরা রবীন্দ্রনাথকে ধারণ করেন তাঁদের আশ্রয় রবীন্দ্রনাথ, এ আমি আমার জীবন দিয়ে উপলব্ধি করেছি।
প্রশ্ন : মনখারাপ হলে রবীন্দ্রনাথের কোন গানকে আঁকড়ে ধরেন?
রেজ়ওয়ানা : বহু গান আছে। ‘তোমার অসীমে’, ‘আমার মাথা নত করে দাও’, ‘দুঃখ আমার অসীম পাথার’। গানই কঠিন সময়ে সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দেয়। মানুষ যতই ছুটে চলুক, এক দিন তার জীবন শ্লথ হবেই। একটা সময় তাকে রবীন্দ্রনাথের কাছে ফিরতেই হবে।
প্রশ্ন : আপনি একজন শিক্ষক। নতুন প্রজন্ম কোন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে রবীন্দ্রনাথকে দেখে?
রেজ়ওয়ানা : রবীন্দ্রনাথকে বোঝার বিষয় সময়ের সঙ্গে বদলেছে। এখন নতুন প্রজন্ম প্রযুক্তিগত ভাবে আত্মনির্ভর। তারা নিজেরাই সব পারে। এটা ভাল দিক। খারাপ দিক হল তাদের ওপর কোনও নিয়ন্ত্রণ চলে না।
প্রশ্ন : অনেকেই আপনাকে কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের যোগ্য উত্তরসূরি মনে করেন। মানেন?
রেজ়ওয়ানা : আমার সৌভাগ্য, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে আমার শেখার সুযোগ হয়েছে, স্নেহ পেয়েছি। গুটিকয়েক ছাত্রীদের মধ্যে আমি মোহরদির (কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডাক নাম) কাছে কেবল গান নয়, ওঁর হাত ধরেই রবীন্দ্রনাথকে চিনেছি। আমিও সেই ভাবে ছাত্রছাত্রীদের শেখাই। কে যোগ্য উত্তরসূরি তা সময় বলবে। আমি কে বলার?
প্রশ্ন : শান্তিনিকেতন থেকে ঘুরে এলেন? কতটা বদল চোখে পড়ে?
রেজ়ওয়ানা : শান্তিনিকেতন আশ্রম এত দ্রুত বদলে যাচ্ছে দেখে খুব কষ্ট হয়। ভাবতেই পারি না। অবশ্য এ বার ছিলাম প্রান্তিকের কাছে। সেই প্রান্তিক, যেখানে গান শিখতে এসে ধানক্ষেত দেখতাম। একটা-দুটো তাল গাছ থাকত। ওই সব জায়গাকে ‘তালতোড়’ বলা হত। এ বার ‘শালমঞ্জরী’তে বেশ লাগল। শান্তিনিকেতনের আবহ খুঁজে পেলাম। বেকায়দা লাগল না।
প্রশ্ন : রবীন্দ্রনাথের গানকে পেশা হিসেবে নেওয়া যায়?
রেজ়ওয়ানা : গান এমনই জিনিস, সেটা পেশা হিসেবে নেওয়া যাবে কি না, তা উপরওয়ালা নির্ধারণ করেন। এটা গান গাওয়ার মানের উপর নয়, ভাগ্যের উপর নির্ভর করে। তবে আগের থেকে রবীন্দ্রনাথের গান গেয়ে এখন জীবিকা অর্জন সহজতর। সারা পৃথিবীতে এই গানের এত প্রচার। এত শ্রোতা। তবে ভাগ্য সহায় না হলে কিছুই হবে না।
প্রশ্ন : ‘বাংলাদেশের রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী’ এই তকমায় জনপ্রিয় হওয়ার সুযোগ বেশি?
রেজ়ওয়ানা : শিল্পীকে ভাল লাগা তো শ্রোতাদের ওপর নির্ভর করে। বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। জাতীয় ভাষা বাংলা। রবীন্দ্রনাথ আমাদের জাতীয় সঙ্গীতের রচয়িতা। রবীন্দ্রনাথকে অনেক কষ্ট করে আমরা অর্জন করেছি। তাই তাঁর মর্যাদাও অনেক বেশি। রবীন্দ্রনাথ আমাদের কাছে সব রকম সংগ্রামের অস্ত্র। আর পশ্চিমবঙ্গ ভারতের প্রদেশ। প্রাদেশিক ভাষা বাংলা। সেই জায়গা থেকে বাংলাকে এগিয়ে নিয়ে চলা খুব কঠিন কাজ। যাঁরা করছেন তাদের কুর্নিশ জানাই। উঁচু মানের শিল্পী আসলে শ্রোতারা ঠিক করেন। ভাল গান গাইলেও অনেক সময় শিল্পী শ্রোতার প্রিয় হন না। আবার সাদামাঠা গান গাইছেন, এমন শিল্পীও শ্রোতার প্রিয়। শিল্পী পছন্দের ক্ষেত্রে ভৌগোলিক ভেদাভেদ ঘটে না।
পথরেখা/আসো # সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা