অনিন্দ্য আরিফ দিব্য : মাছে-ভাতে বাঙালি। সেই বাঙালির জন্য নিত্য-নতুন ধানের উৎপাদন নিয়ে গবেষণা করছেন একঝাক নিবেদিতপ্রাণ বিজ্ঞানী। গবেষণা শেষে তারা বিভিন্ন জাতের ধান বীজ তুলে দিচ্ছেন কৃষকের হাতে। তাতেই বাংলাদেশের কৃষকরা ধান আবাদে ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেছে। সোনার ধানে ভরে উঠছে সোনার বাঙলা। এই ধান বীজ উৎপাদন নিয়ে যারা নিরন্তর পরিশ্রম করে যাচ্ছেন তারা আরো কম সময়ে সহজভাবে ধান উদ্ভাবন, উৎপাদন বৃদ্ধি করা নিয়ে গবেষণা অব্যাহত রেখেছেন। তাদের নানা গবেষণা কার্যক্রম নিয়ে তাই মাঠ দিবস, সেমিনার-সিম্পোজিয়াম করাই স্বাভাবিক। নানা আয়োজন সামনে রেখে তারা মাঠ দিবস উদযাপন করছে। তারই অংশ হিসেবে গাজীপুরস্থ বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সীর কন্ট্রোল ফার্মের ২০২১-২০২২ রবি মৌসুমের বোরো বীজ ফসলের ‘প্রি পোস্ট কন্ট্রোল গ্রো আউট টেস্ট’ শিরোনামে এক মাঠ দিবসের আয়োজন করা হয়।
অনুষ্ঠানের শুরুতে স্বাগত বক্তব্য প্রদান করেন বীজ প্রত্যয়ন কার্যক্রম জোরদারকরণ প্রকল্পের পরিচালক কৃষিবিদ ড. মো. সাদিকুর রহমান। তিনি সংক্ষিপ্তভাবে প্রি পোস্ট গ্রো আউট টেস্ট এর তাৎপর্য সবার সামনে তুলে ধরেন এবং সকল স্টকহোল্ডারের অংশগ্রহণের জন্য ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। ১০ মে অনুষ্ঠিত দিনব্যাপী এই মাঠ দিবসে সভাপতি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সীর সম্মানিত পরিচালক কৃষিবিদ মো. আমিনুল ইসলাম। তিনি বলেন, প্রজনন, ভিত্তি ও প্রত্যায়িত বীজ উৎপাদনে গবেষণা প্রতিষ্ঠানের ব্রিডারগণ অত্যন্ত দক্ষতার সাথে এ বিষয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। ২০২১-২০২২ রবি মৌসুমে বোরো বীজ ফসলের ‘‘প্রি পোস্ট গ্রো আউট টেস্ট” মাঠ দিবসে ব্রিডার বীজের বেশ কিছু প্লটে বিজাতীয় বীজ পাওয়া গেছে, যা কোনভাবেই কাম্য নয়। এ বিষয়ে তিনি ব্রিডারদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এ ছাড়া ধান প্রসেসিং যেমন ধান কাটা, মাড়াই, ঝাড়াই এবং প্যাকেজিং প্রক্রিয়ায় কোথাও কোন সমস্যা আছে কিনা সে ব্যাপারেও সচেতন হবার তাগিদ দেন।
মাঠ দিবসে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বীজ প্রত্যায়ন এজেন্সীর অতিরিক্ত পরিচালক, প্রশাসন ও অর্থ, মুহাম্মদ এমদাদুল হক পিএইচডি, কৃষিবিদ মো. আশরাফ উদ্দিন অতিরিক্ত পরিচালক, মাঠ প্রশাসন, পরিকল্পনা ও মনিটরিং ও বিএডিসির যুগ্ম পরিচালক মো. ওবায়দুল ইসলাম। মাঠ দিবসে আরো অংশ গ্রহণ করেছেন ব্রি, বারি, বিনা, বিএমডি এর গবেষণা প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তাবৃন্দ, বিভিন্ন কোম্পানীর প্রতিনিধি, বীজ ডিলারগণ, সাংবাদিকবৃন্দ, এআইএস এর প্রতিনিধি এবং বীজ প্রত্যায়ন এজেন্সীর আঞ্চলিক এবং জেলা পর্যায়ের কর্মকর্তাবৃন্দ। মাঠ দিবসে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সীর মান নিয়ন্ত্রণ বিভাগের উপ পরিচালক কৃষিবিদ মোহাম্মদ এনায়েত-ই-রাব্বি। তিনি প্রি পোস্ট কন্ট্রোল গ্রো আউট টেস্ট এর ৫৭৮ টি বোরো বীজ ফসলের ফলাফল উপস্থাপন করেন এবং এ কাজে সংশ্লিষ্ট সকলের আন্তরিক সহযোগিতার জন্য কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন।
উক্ত মাঠ দিবসে মুহাম্মদ এমদাদুল হক পিএইচডি দুর্যোগপ্রবণ আবহাওয়া থাকার পরও সবাই উপস্থিত থাকার জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে বলেন ‘আমাদের একসাথে কাজ করতে হবে। বীজের বিশুদ্ধতা নিশ্চিত করতে হবে। এর সাথে সংশ্লিষ্ট সবাইকে সচেতন হতে হবে। সম্মিলিত এবং আন্তরিকভাবে কাজ করলে বীজ সেক্টরে দেশের উন্নতি অবশ্যম্ভাবী। বিএডিসি’র যুগ্ম পরিচালক মো. ওবায়দুল ইসলাম বলেন, ‘প্রি পোস্ট কন্ট্রোল গ্রো আউট টেস্ট হলো বীজ উৎপাদনের একটি কর্মদক্ষতার পরীক্ষা। যে সব প্লটে মিশ্রণ থাকে সেই প্লটগুলোর বীজ কোথাও বিতরণ করা ঠিক না। শতভাগ মানসম্পন্ন বীজ কৃষককে দিতে হবে। কৃষক যাতে প্রতারিত না হয় সেদিকে সবাইকে খেয়াল রাখতে হবে।’ ঢাকার আঞ্চলিক বীজ প্রত্যয়ন অফিসার আহমেদ শাফী বলেন, ‘প্রতিটি ব্রিডার প্লটের বীজ উৎপাদনের সাথে ব্রিডারের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে। বীজের উৎস ভালভাবে যাচাই করতে হবে, বিশেষ করে ব্রিডার বীজের ক্ষেত্রে নিউক্লিয়াস বীজ যাচাই করতে হবে। এ ব্যাপারে তিনি জেলা বীজ প্রত্যয়ন অফিসারদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।’
মুক্ত আলোচনা পর্বে ব্রি’র প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মীর শরফ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘কোন বীজ বছরের পর বছর উৎপাদন করতে হলে অবশ্যই সে বীজের কৌলিক বিশুদ্ধতা বজায় রাখতে হবে। ব্রিডার বীজের ক্ষেত্রে অবশ্যই বীজের মাঠমান বজায় রাখতে হবে। কোন কোন জাত কৌলিকভাবে বিশুদ্ধ নয় তা আরো খতিয়ে দেখতে হবে।’ তিনি আরো বলেন, ‘ব্রি ধান২৮ এখন ব্লাস্ট রোগের প্রতি সংবেদনশীল কিন্তু ২০ বছর পর ব্লাস্ট এর প্রতি সংবেদনশীল থাকবে কিনা জানা নাই। এজন্য ব্রি ধান২৮ এর বীজ উৎপাদন বন্ধ করে দিলে জাতটি বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।’ ব্রি’র উর্দ্ধতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. ইবনে সৈয়দ মো. হারুনুর রশীদ বলেন, ‘ব্রিডার বীজের কৌলিক বিশুদ্ধতা নিয়ে কোন আপোস নেই।’ ব্রি’র জৈব প্রযুক্তি বিভাগের উর্দ্ধতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন, ‘যে সব প্রতিষ্ঠান বা ডিলার বীজ নমুনা নিচ্ছে তারাও গার্ড স্যাম্পল সংরক্ষণ করতে পারে যাতে বীজের অভিন্নতা না থাকলে পরবর্তীতে নিয়ন্ত্রণ করা যায়।’
বিনার উর্দ্ধতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. সিফাতে রাব্বানা খানম বলেন, ‘ব্রিডার বীজের সমস্যা কোনভাবেই আপোস করার সুযোগ নেই। বিনার সদর দপ্তরে জমির স্বল্পতা থাকায় বিনার উপকেন্দ্রগুলোতে ব্রিডার বীজের পরীক্ষামূলক প্লট করা হয়। এর ফলে সমস্যা হতে পারে। ভবিষ্যতে যাতে এ সমস্যা না হয় এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট ব্রিডার এবং কর্তৃপক্ষকে অবহিত করার হবে।’ নেত্রকোনা জেলা বীজ প্রত্যয়ন অফিসার সালমা লাইজু বলেন, ‘এই জেলায় ব্রিডার বীজে প্রচুর মিশ্রণ পাওয়া গেছে। যেখানে ব্রিডার বীজ হয় সেসব জায়গায় এসসিএ’র প্রতিনিধি নেই। বীজ পরীক্ষার ক্ষেত্রে বীজের সজীবতা এবং সতেজতা পরীক্ষা অন্তর্ভুক্ত করা হলে বীজের মান উন্নত হবে।’
জামালপুর জেলা বীজ প্রত্যয়ন অফিসার মো. সাইফুল আজম বলেন, ‘বিনাধান-১৪ সমশ্রেণীভুক্ত প্লট থেকে কেটে নিয়ে পরবর্তীতে বীজ উৎপাদন করার পরও মিশ্রণ পাওয়া গেছে। জামালপুরে ব্রিডার বীজ ব্যবহার করে ২ একর জমিতে বীজ করা হয়েছে। কিন্তু মিশ্রণ পাওয়ায় ফলে প্লট বাতিল করা হয়েছে।’ বারির বীজ প্রযুক্তি বিভাগের মূখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা সারওয়ার জাহান বলেন, ‘সংশ্লিষ্ট সবাইকে সতর্ক হয়ে কাজ করতে হবে। সকল শ্রেনীর বীজের ক্ষেত্রে তদারকি বাড়াতে হবে।’
মাঠ দিবসের এক পর্বে অংশগ্রহণকারীরা সরেজমিনে নির্দিষ্ট ধানের প্লটগুলোও পরিদর্শন করেন। পরিশেষে সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে মাঠ দিবসের সমাপ্তি ঘোষণা করেন অনুষ্ঠানের সভাপতি মহোদয়।
দেশকন্ঠ/অআ