দেশকন্ঠ প্রতিবেদন : সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে বাঙালি জাতির অপেক্ষার অবিশ্বাস্য স্বপ্নের দুয়ার খুলে যাওয়ার কাছাকাছি বাংলাদেশ। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী জুন মাসের শেষ সপ্তাহের সুবিধাজনক দিনে প্রধানমন্ত্রী ১৬ কোটি মানুষের আবেগের স্থাপনা পদ্মা সেতু যান চলাচলের জন্য খুলে দেবেন। অপেক্ষা এখন কয়েকটি দিনের। মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। জানা গেছে, ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর শরীয়তপুরের জাজিরা পয়েন্টে পদ্মা সেতুর ৩৭ ও ৩৮ নম্বর পিলারের ওপর বসানো হয়েছে সেতুর প্রথম স্প্যান। ওই দিন সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের উপস্থিতিতে বসানো হয় স্প্যানটি। বর্তমানের মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম ছিলেন সে সময় সেতু বিভাগের সচিব। পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা নদীর আববাহিকায় ৪২টি পিলারের ওপর ১৫০ মিটার দৈর্ঘ্যের ৪১টি স্প্যান বসানোর মধ্য দিয়ে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য এবং ১৮ দশমিক ১০ মিটার প্রস্থের দেশের সবচেয়ে বড় এই সেতু এখন প্রস্তুত। এটির প্রয়োজনে অধিগ্রহণ করা হয়েছে ৯১৮ হেক্টর জমি। সেতুর পুরো কাজ শেষ হওয়ার পর সংযোগসহ এর দৈর্ঘ্য দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৮৭ কিলোমিটার। শুরুতে বিশ্লেষকরা ধারণা করেছিলেন, এটি নির্মিত হলে বাংলাদেশের জিডিপিতে এর অবদান হবে ১ দশমিক ২ শতাংশ। কিন্তু খুলে দেওয়ার প্রাক্কালে অর্থনীতিবিদদের বিশ্লেষণে জিডিপিতে পদ্মা সেতুর অবদান দাঁড়াবে প্রায় ২ শতাংশ। মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলামও এমনটাই জানিয়েছেন।
পদ্মা সেতু প্রকল্পের পরিচালক প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম জানিয়েছেন, প্রমত্তা পদ্মার প্রবল স্রোত ও ঢেউয়ের সঙ্গে লড়াই করে চলেছে এর নির্মাণযজ্ঞ। নদীর তলদেশে মাটির স্তরের গঠন নিয়ে জটিলতা কাটিয়ে বর্ষায় নদীর প্রবল স্রোতকে উপেক্ষা করে এ নির্মাণকাজ চালানো হয়েছে। মূল নদীর মধ্যে ১৫০ মিটার পর পর ৪২টি পিলারের প্রতিটি পিলারে ৬টি করে মোট ২৫২টি পাইল থাকছে। তিনি জানান, পদ্মা সেতুর রঙ হবে সোনালি। তবে রাতে সেতুটিতে জ্বলবে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার আদলে লাল ও সবুজ বাতি। সেভাবেই সেট করা হয়েছে বাতিগুলো। পদ্মা নদীর পানির স্তর থেকে ৫০ ফুট উঁচুতে বসানো হয়েছে প্রতিটি স্প্যান। পদ্মা সেতু কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, স্বপ্নের পদ্মা সেতু নির্মাণ করতে গিয়ে প্রমত্তা পদ্মার বুকে খুঁটি বসাতে হয়েছে ৪০টি। এর ১৮টিতে ছয়টি করে পাইল সাজিয়ে খুঁটি নির্মাণ করা হয়েছে। আর ২২টি খুঁটিতে সাতটি করে পাইল গাঁথা হয়েছে। দুই পাড়ে রয়েছে মূল সেতুর আরও দু’টি খুঁটি। সব মিলিয়ে ৪২টি খুঁটির ওপর বসেছে মূল পদ্মা সেতু। তবে সড়কের সঙ্গে সংযোগ ঘটাতে দুই পাশের আরও অনেক খুঁটিই রয়েছে। সব মিলিয়ে পদ্মা সেতুতে খুঁটির সংখ্যা ১৩৩টি। মূল সেতুর দৈর্ঘ্য ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার। তবে দু’পাশে সড়কের সঙ্গে সংযোগ মিলিয়ে সেতুটি সাড়ে ৯ কিলোমিটার লম্বা।
সূত্র জানিয়েছে, এই সেতু তৈরিতে যে পাথর ব্যবহৃত হচ্ছে, তার একেকটির ওজন এক টন। পাথরগুলো ভারতের ঝাড়খণ্ড রাজ্যের পাকুর নামক স্থান থেকে আনা হয়েছে। মাত্র ১৫ টুকরো পাথরে ভরে যায় একটি বড় ট্রাক। পদ্মা সেতুর সড়ক হবে চার লেনের। প্রস্থ ২২ মিটার। নিচে যে রেললাইন থাকছে, সেটি সিঙ্গেল লাইন। তবে মিটারগেজ ও ব্রডগেজ দুই ধরনের ট্রেন চলার উপযোগী পথই থাকবে এই সেতুতে। পদ্মা সেতুর একেকটি খুঁটি ৮০ মিটার থেকে ১২২ মিটার গভীরে নেওয়া হয়েছে। নদীর তলদেশে এর কাঠামো এতই শক্তিশালী যে, এর একেকটি কাঠামো ৪০ তলা ভবনের সমান। এক খুঁটি থেকে আরেক খুঁটির দূরত্ব ১৫০ মিটার। সে হিসাবে একেকটি স্প্যানের দৈর্ঘ্য ১৫০ মিটার। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এই সেতু মুন্সীগঞ্জের লৌহজংকে শরীয়তপুর ও মাদারীপুর জেলার সঙ্গে যুক্ত করেছে। ফলে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশের সঙ্গে উত্তর-পূর্ব অংশের সংযোগ ঘটছে এই সেতুর মাধ্যমে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য পদ্মা সেতু হতে যাচ্ছে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জিং নির্মাণ প্রকল্প। দুই স্তরবিশিষ্ট স্টিল ও কংক্রিট নির্মিত ট্রাস ব্রিজটির ওপরের স্তরে রয়েছে চার লেনের সড়ক পথ এবং নিচের স্তরটিতে রয়েছে একটি একক রেলপথ।
এদিকে অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, গত ২০০৬-২০০৭ সালে প্রকল্প প্রস্তুতির সঙ্গে যুক্ত কিছু লোকের দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় বিশ্বব্যাংক তার প্রতিশ্রুতি প্রত্যাহার করে নেয়। অন্যান্য দাতারাও সেটি অনুসরণ করে। এ ঘটনায় তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে মন্ত্রিসভা থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। সংশ্লিষ্ট সচিব মোশারেফ হোসেন ভূঁইয়াকে জেলেও যেতে হয়েছিল। পরে এমন কোনও অভিযোগ প্রমাণ না পাওয়ায় কানাডিয়ান আদালত মামলাটি বাতিল করে দেয়। দুর্নীতির অভিযোগ পরে আদালতে খণ্ডিত হয়। সর্বশেষে প্রকল্পটি বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব সম্পদ থেকে অর্থায়ন করা হয়েছে। এইসিওএম এর নকশায় পদ্মা নদীর ওপর বহুমুখী আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন প্রকল্প ‘পদ্মা বহুমুখী সেতুর’ নির্মাণকাজ শুরু হওয়ার কথা ছিল ২০১১ সালে। শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০১৩ সালে। মূল প্রকল্পের পরিকল্পনা করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকার ২০০৭ সালের ২৮ আগস্ট। সে সময় ১০ হাজার ১৬১ কোটি টাকার বহুল আলোচিত পদ্মা সেতু প্রকল্প পাস করা হয়। পরে আওয়ামী লীগ সরকার এসে রেলপথ সংযুক্ত করে ২০১১ সালের ১১ জানুয়ারি প্রথম দফায় সেতুর ব্যয় সংশোধন করে। তখন এর ব্যয় ধরা হয়েছিল ২০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা। পদ্মা সেতুর ব্যয় আরও আট হাজার কোটি টাকা বাড়ানো হয়। ফলে পদ্মা সেতুর ব্যয় দাঁড়িয়েছে সব মিলিয়ে ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা। তবে পদ্মা সেতু নির্মাণে মোট খরচ করা হচ্ছে ৩০ হাজার ১৯৩ দশমিক ৩৯ কোটি টাকা। এসব খরচের মধ্যে রয়েছে সেতুর অবকাঠামো তৈরি, নদী শাসন, সংযোগ সড়ক, ভূমি অধিগ্রহণ, পুনর্বাসন ও পরিবেশ, বেতন-ভাতা ইত্যাদি। বাংলাদেশের অর্থ বিভাগের সঙ্গে সেতু বিভাগের চুক্তি অনুযায়ী, সেতু নির্মাণে ২৯ হাজার ৮৯৩ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে সরকার। ১ শতাংশ সুদ হারে ৩৫ বছরের মধ্যে সেটি পরিশোধ করবে সেতু কর্তৃপক্ষ।
ইতোমধ্যে সেতু বিভাগ পদ্মা সেতুর টোল নির্ধারণ করেছে। টোলের স্ট্যান্ডার্ড হলো ফেরি পারাপারের যে রেট তার দেড়গুণ (১ দশমিক ৫ শতাংশ। যেমন: ফেরিতে ১০০ টাকা হলে ব্রিজে ১৫০ টাকা) ধরা হয়েছে। এটি বেশি নয় বলে জানিয়েছেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম। তিনি জানান, বঙ্গবন্ধু সেতুর দৈর্ঘ্য হলো ৫ কিলোমিটার, আর পদ্মা সেতুর ৯ দশমিক ৮৬ কিলোমিটার। প্রায় দ্বিগুণ। তিনি আরও জানিয়েছেন, পদ্মা সেতুর টাকা সেতু কর্তৃপক্ষকে ১ শতাংশ হারে সুদ সহকারে সরকারকে ফেরত দিতে হবে। সুতরাং সেতু কর্তৃপক্ষকে ওই জায়গা থেকে টাকা উপার্জন করতে হবে। মন্ত্রিপরিষদ সচিব জানিয়েছেন, পৃথিবীর কোথাও এ ধরনের স্থাপনার ভেতর দিয়ে যাওয়ার সময় পয়সা না দিয়ে যাওয়ার কোনও সিস্টেম নেই। ফিজিবিলিটি স্টাডিতে যেমন ছিল, সেতুর নির্মাণ ব্যয় ২৪ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে উঠে আসবে। এখন মনে হচ্ছে তা ১৬-১৭ বছরের বেশি লাগবে না। মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, ‘ধারণা ছিল পদ্মা সেতু ১ দশমিক ৩ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি আনবে। এখন মনে হচ্ছে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে এটা ২-এর কাছাকাছি চলে যাবে।
দেশকন্ঠ/অআ