আরিফ সোহেল
পদ্মা সেতু— আর মাত্র কয়েক ঘন্টার অপেক্ষা; তারপর স্বপ্ন নয়, সব সত্যি। সারাদেশের মানুষ ছাপিয়ে সারা বিশ্ব পদ্মা সেতু উদ্বোধনের মহেন্দ্রক্ষণের অপেক্ষায়। অথচ ৯ বছর আগেও পদ্মায় সেতু নিয়ে সন্দেহের বেড়াজালে খাবি খেয়েছিল বিএনপি-জামাত-বামগোছের অনেক রাজনৈতিক নেতা এবং তাদের দোসর পক্ষভুক্ত বিশেষজ্ঞ দল। তাদের সঙ্গে সুখী সুধী সমাজ এবং তথাকথিত বিশুদ্ধ ঘরানার জ্ঞানীরাও সুর মিলিয়ে হুক্কাহুড়া স্বরে; বলেছিলেন— ‘হবে না; হবে না। আগে ইজ্জত বাঁচান।’
অসত্য ভিত্তিহীন দুর্নীতির অভিযোগের আড়ালে ২০১৩ সালে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন করবে না বলে সরে দাঁড়ায়। ওই সময়ে সমালোচকরা কুরুটিপূর্ণ ভাষায় আওয়ামী লীগ সরকারকে তিরস্কার করেছিল। কিন্তু থেমে যাননি একজন; তার নাম শেখ হাসিনা। যিনি নিশ্চিত মরণ যেনো বাংলাদেশের এসেছিলেন সাহসী বীরাঙ্গণাবেশে। সব আপদ-বিপদ পায়ে দলে যিনি প্রমাণ করেছেন— তিনি এসেছেন জয় করতে; করলেনও। তারপরও একে একে অনেক ইতিহাস। সেই তিনি জনগণের নেত্রী শেখ হাসিনা সাহসী উচ্চারণে ঘোষণা করেছিলেন— নিজস্ব অর্থায়নেই পদ্মা সেতু নির্মাণ করা হবে। মাত্র ৯ বছরের ব্যবধানে নিজস্ব অর্থ-শক্তিতে প্রমত্ত পদ্মার বুকে জেগে উঠেছে বাংলাদেশের গর্বিত অহংকার পদ্মা সেতু। বিস্মিত বিশ্ববাসী অভিনন্দনে অভিনন্দনে ভাসিয়ে দিয়েছেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের রূপকার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা যোগ্য উত্তরসূরি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে।
সব ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে স্বপ্ন এখন বাস্তব। পদ্মা সেতু যাতে না হয় সে জন্য বিদেশে ষড়যন্ত্রকারীদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন দেশেরও অনেকে। কয়েকটি সংবাদপত্রে দিনের পর দিন পদ্মা সেতুর কল্পিত দুর্নীতি নিয়ে মনগড়া গল্প প্রকাশ হয়েছে। তবে বিচারিক প্রক্রিয়া শেষে কানাডার আদালত বলেছে, এই মামলায় যেসব তথ্য দেওয়া হয়েছে, তা অনুমানভিত্তিক, গালগল্প এবং গুজবের বেশি কিছু নয়।
২০০৯ সালের ১৯ জানুয়ারি নকশা ও পুনর্বাসনের কাজ শুরু হয়। ২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর প্রকল্পের কাজ আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধনের সময় ১২০০ থেকে ২০০০ কর্মী যুক্ত হয়েছিল পদ্ম সেতুতে। সেতু বিভাগের তথ্যানুযায়ী, ২০১৬ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত প্রতি মাসে ২০ হাজার কর্মী কাজ করেছেন। এরপর কাজের চাপ কমে যাওয়ায় কর্মীর সংখ্যাও কমতে থাকে। ২০১৯ সাল থেকে এখন পর্যন্ত মাসে সাড়ে ৪ হাজার কর্মী কাজ করছেন। তাদের মধ্যে ৪ হাজার জনই বাংলাদেশি। বাকি ৫০০ কর্মী ইউরোপের বিভিন্ন দেশসহ বিশ্বের ২২টি দেশের নাগরিক। দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, কলম্বিয়া, চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, ভারত, নিউজিল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস, নেপাল এবং আফ্রিকার দেশ তানজানিয়া। বিদেশি কর্মী-কর্মকর্তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি রয়েছে চীনের।
পদ্মা সেতুর পিলার ও স্ল্যাব তৈরির জন্য স্টোন চিপ আনা হয়েছে দুবাই ও ভারত থেকে। আর রড, সিমেন্ট, বালু তার সবটাই বাংলাদেশ। মূল সেতুর ৬-৩৮ নম্বর পিলারগুলোর যেকোনো ফাঁকা জায়গা দিয়ে নৌযান চলাচল করতে পারবে। এর প্রত্যেকটি পিলারের পাইল ক্যাপ থেকে সেতু পর্যন্ত উচ্চতা ১৮ দশমিক ৩ মিটার। দুই পিলারের মাঝের দূরত্ব ১৩১ মিটার। বর্ষা মৌসুমে পানির স্তর পাইল ক্যাপের নিচেই থাকে। আর ১৮ দশমিক ৩ মিটার উচ্চতার বেশি কোনো নৌযান নেই বাংলাদেশে। ২০০৭ সালের আগস্টে প্রকল্পটি অনুমোদন দেয় তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার, ব্যয় ধরা হয়েছিল ১০ হাজার ১৬১ কোটি টাকা। সর্বশেষ ব্যয় ধরা হয়েছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। পদ্মায় মূল সেতু নির্মাণের কাজ করছে চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেড। ২০১৫ সালে ৭ নম্বর পিলার বসানোর মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিক কাজ শুরু হয়। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় এই সেতুর কাজ আরও আগেই শেষ হওয়ার কথা থাকলেও করোনা মহামারি ও প্রবল বন্যায় কাজের ব্যাঘাত হওয়ায় ২ বছর বাড়ে প্রকল্পের মেয়াদ।
পদ্মা সেতু দক্ষিণের ১৯ জেলার সঙ্গে রাজধানী ঢাকাসহ পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন হয়েছে। এর ফলে দেশের দ্বিতীয় সমুদ্রবন্দর মোংলা বন্দরটি চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করার সুযোগ সৃষ্টি হবে। ঢাকা ও চট্টগ্রামের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হবে বেনাপোল স্থলবন্দরেরও। ফলে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ১ দশমিক ২৩ শতাংশ বাড়ার আশা বিশেষজ্ঞদের।
পদ্মা সেতু প্রকল্পের অধীনে যান চলাচল ও ট্রেনের লাইন হচ্ছে। পদ্মা সেতু রেলসংযোগ প্রকল্পের নামে দুই পাড়ের সঙ্গে রেলসংযোগ স্থাপনের কাজ করছে রেলপথ মন্ত্রণালয়। রাজধানী ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে যশোর পর্যন্ত ১৭২ কিলোমিটার রেললাইন হচ্ছে। প্রকল্পটির প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৯ কোটি ২৪৬ কোটি ৮০ লাখ টাকা। বাস্তবায়নের সময় ২ বছর বাড়িয়ে করা হয়েছে ২০২৪ সাল পর্যন্ত। রেলপথটি দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ২১টি জেলায় প্রথম রেলসংযোগ স্থাপন করবে। পদ্মা সেতুর কারণে কমে যাবে এই অঞ্চলে পদ্মায় ফেরির প্রয়োজনীয়তা। এর মধ্যেই এই রুটে ফেরির সংখ্যা অনেকটা কমিয়ে আনা হয়েছে।
ভায়াডাক্টসহ পদ্মা সেতুর দৈর্ঘ ৯ দশমিক ৩ কিলোমিটার। আর মূল সেতুর দৈর্ঘ ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার। পদ্মা সেতুতে গাড়ির সর্বোচ্চ গতিসীমা হবে ঘণ্টায় ৬০ কিলোমিটার। সেই হিসাবে পদ্মা পাড়ি দিতে সময় লাগবে কমবেশি ৯ মিনিট। আর আগে এই পথে ফেরি পাড়ি দিতেই পেরিয়ে যায় ঘণ্টা দেড়েক; সঙ্গে ওঠা-নামা-অপেক্ষায় আরো এক দেড় ঘণ্টা।
২৫ জুন আনুষ্ঠানিক পদ্মা সেতু উদ্বোধন ঘোষণা করা হবে। এই সেতু উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রাখা হয়েছে সমাবেশ কর্মসূচিও। এরই মধ্যে এ নিয়ে নানা আয়োজন সম্পন্ন হয়েছে। স্বপ্নের পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পরদিন ২৬ জুন সকাল থেকে চলবে সব ধরনের যানবাহন। ২৫ জুন সকাল ১০টায় মুন্সীগঞ্জের মাওয়া প্রান্তে সেতুটি উদ্বোধন করে গাড়িতে করে সেতুর ওপর দিয়ে শরীয়তপুরের জাজিরা প্রান্তে যাবেন প্রধানমন্ত্রী।
পদ্মা সেতু উদ্বোধন উপলক্ষে ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েসহ শ্রীনগর, সিরাজদিখান, লৌহজং উপজেলার রাস্তাঘাট ও অলিগলি বিলবোর্ড, ব্যানার, ফেস্টুন ও পোস্টারে ছেয়ে গেছে। শিমুলিয়া ঘাট এলাকায় রাস্তার পাশে শোভা পাচ্ছে বড় বড় বিলবোর্ড ফেস্টুন ও ব্যানার। শিমুলিয়া ঘাটে মুন্সীগঞ্জ জেলা প্রশাসনের আয়োজনে আওয়ামী লীগের সহযোগিতায় ৩ দিনব্যাপী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়েজন করা হয়েছে। এই অনুষ্ঠানের পাশেও বড় বড় ব্যানার ফেস্টুন টাঙানো হয়েছে। জাজিরা প্রান্তের একই চিত্রের জমজমাট আয়োজন। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ৭৩তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর শুভ লগ্ন না পেরুতেই পদ্মা সেতুর উদ্বোধন বাংলাদেশের জন্য এক বিরল ইতিহাস হয়েই থাকবে। আর সোনার অক্ষরে বাধাই করা থাকবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নাম।
দেশকণ্ঠ/আসো