দেশকন্ঠ প্রতিবেদন : দেশের প্রধানতম নদীর একটি পদ্মা। রাজধানী ঢাকা থেকে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলাকে পৃথক করে রেখেছিল প্রমত্তা পদ্মা নদী। রাজধানী ঢাকায় পৌঁছাতে হলে দেশের অন্যতম দুটি নৌপথ মাদারীপুর-মুন্সীগঞ্জের বাংলাবাজার-শিমুলিয়া এবং রাজবাড়ী-মানিকগঞ্জের দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া পার হয়েই দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার মানুষ এবং যানবাহন ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করত। এছাড়া ফরিদপুরের চরভদ্রাসনের মৈনট ঘাট পার হয়েও রাজধানীতে পৌঁছানো যায়। ওই ঘাট পার হতে হলেও পদ্মা নদীকেই অতিক্রম করতে হয়। তবে যোগাযোগ ব্যবস্থা তেমন ভালো না হওয়ায় দূরবর্তী জেলার যাত্রীরা ওই রুটটি ব্যবহার থেকে বিরত থাকেন। অর্থাৎ দক্ষিণাঞ্চলকে রাজধানী ঢাকা থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল একমাত্র পদ্মা নদীই। দিন গুনতে গুনতে অবশেষে আজ অপেক্ষার পালা শেষে হলো দক্ষিণাঞ্চলবাসীর।
২৫ জুন উদ্বোধন হলো স্বপ্নের পদ্মাসেতু। ২৬ জুন সকাল থেকেই সাধারণ যাত্রীরা নৌরুটটি ব্যবহার করতে পারবেন। আর এই পদ্মা সেতুর মাধ্যমেই রাজধানীর দুয়ারে পৌঁছে যাবে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ২১টি জেলা! এই সেতু বন্ধনের মধ্য দিয়ে যোগাযোগ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন হয়ে গেল। একই সঙ্গে উন্নয়ন-অগ্রগতির পালে হাওয়াও লাগলো। ঢাকায় যেতে এতোদিন যেখানে নানান হিসাব-নিকাশ করতে হতো, এখন কোনো বাঁধাই থাকলো না আর। দিনের ২৪ ঘণ্টাই যেকোন স্থান থেকে রাজধানীতে পৌঁছাতে পারবে এই অঞ্চলের সাধারণ মানুষ। যোগাযোগ ব্যবস্থার এই অভূতপূর্ব পরিবর্তনের ফলে অর্থনৈতিক বড় ধরনের পরিবর্তনও ঘটবে বলে মনে করে ব্যবসায়ীসহ নানা শ্রেণীপেশার মানুষ। সাধারণ মানুষের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, পদ্মা সেতুর ফলে এই অঞ্চলের মানুষের ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ঢাকাকেন্দ্রিক একটি বাজার তৈরি হবে। দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন জেলা থেকে উৎপাদিত পণ্য সামগ্রী সহজেই ঢাকা পৌঁছানো যাবে। আবার ঢাকা থেকে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি গ্রামাঞ্চলে নিয়ে আসা যাবে। সেতুর ফলে সময়ও যেমন বাঁচবে তেমনি খরচও কমে আসবে। এতে করে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে পদ্মাপাড়ের এই অঞ্চলে। তাতে করে বাড়বে জীবনযাত্রার মানও।
মাদারীপুর জেলার শিবচরের উৎরাইল নয়াবাজারের ব্যবসায়ী মো. সোহাগ হাওলাদার বলেন, উৎরাইল হাট থেকে রসুনসহ নানা শস্য কিনে ঢাকার টঙ্গীতে পাঠাই। সপ্তাহে দুই/তিনদিন ঢাকা যেতে হয়। ভোরে গিয়ে আবার তাড়াহুড়া করে বিকেলে রওনা দিয়ে বাড়ি ফিরি। ঝড়-বৃষ্টি হলে ঘাটে আটকে থাকতে হয়। অনেক সময় প্রয়োজন হলেও ঢাকা যেতে পারি না। সেতু চালু হলো এখন আর ঢাকা যাওয়া নিয়ে কোনো চিন্তা করতে হবে না। মালামাল পৌঁছাতেও কোনো সমস্যায় পরতে হবে না। সরাসরি মালামাল নিয়েই ঢাকায় যাওয়া যাবে। সময়ও কম লাগবে। ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারও হবে। তিনি আরও বলেন, আগে বরিশালের সঙ্গে ব্যবসায়িক যোগাযোগ ছিল। সেই যোগাযোগটি এখন ঢাকার সঙ্গে করেছি। সেতু চালু হলো আমাদের আর কোন ভোগান্তি থাকবে না। বরিশালের চেয়ে এখন ঢাকাই কাছে হয়ে গেল।
স্থানীয় শিক্ষক আজিজুল হক বলেন, এই পদ্মা নদী পার হতে গিয়েই পিনাক-৬ নামের একটি লঞ্চ ডুবে প্রাণহানি হয় অসংখ্য মানুষের। স্বজন হারা হয় অসংখ্য পরিবার। অনেকের মরদেহ শনাক্ত করতে পারেনি স্বজনেরা। পদ্মা নদী পার হতে গিয়ে স্পিডবোড ডুবে একসঙ্গে নারী-শিশুসহ ২৬ যাত্রীর মৃত্যু হয়েছে এই নৌরুটে। আজ পদ্মাসেতু চালু হচ্ছে। এ নৌরুটে দুর্ঘটনার শিকার হতে হবে না যাত্রীদের। পদ্মা সেতু শুধু সেতু নয়, পদ্মা সেতু আমাদের আবেগ। সহিদুজ্জামান সোহেল নামে শিবচরের এক ব্যক্তি বলেন, আমি ঢাকায় চাকরি করি। বাড়িতে মা থাকে। মাকে দেখতে যখন-তখন ছুটে আসতে মন চাইলেও পদ্মা নদী বাধার সৃষ্টি করে। বাড়ি আসতে চাইলেও হিসেব-নিকেশ করতে হয়। ফেরি পাবো কিনা, রাত হয়ে যাবে কিনা বা ঝড়-বৃষ্টি হলে তো নৌযান বন্ধ থাকবে। আমার যারা পদ্মার ওপারে বাস করি তাদের কাছে এই সেতুর গুরুত্ব অনেক! পদ্মা সেতুর উদ্বোধন দিনটি আমাদের কাছে স্মরণীয় দিন হয়ে থাকবে। আজ দুপুর ১২টায় উদ্বোধন হলো স্বপ্নের পদ্মা সেতু। উৎসবে মেতে উঠেছে পদ্মাপাড় এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার মানুষ। এ যেন রাজধানীর দুয়ারে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের হাতছানি!
দেশকন্ঠ/অআ