দেশকন্ঠ প্রতিবেদন : পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন বন্ধ করার যে অভিযোগ প্রধানমন্ত্রী করেছেন, তা কল্পনাপ্রসূত বলে দাবি করেছে ‘ইউনূস সেন্টার’। এটি মূলত ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সামাজিক কার্যক্রমের প্রচারণার ফেসবুক ভেরিফায়েড পেজ। ২৯ জুন রাত ১০টা নাগাদ পেজটিতে এ সংক্রান্ত একটি নিবন্ধ প্রকাশ করে তারা। যখন ২০১১ সালে এ বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন তোলা হলো এবং প্রফেসর ইউনূসকে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে পদত্যাগ করতে বলা হলো, তখন ব্যাংকটির মৌলিক আইনি মর্যাদা হুমকির মুখে পড়ে গেল যা প্রফেসর ইউনূস ক্রমাগতভাবে সব সরকারের সমর্থন নিয়েই গড়ে তুলেছিলেন। এখন অপসারণের নির্দেশের কারণে সম্পূর্ণ নতুন একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো। তিনি চেয়েছিলেন মহামান্য হাইকোর্ট ব্যাংকটির আইনি মর্যাদা সমুন্নত রাখুন। বিষয়টির আইনগত দিকগুলি পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য তিনি হাইকোর্টে রিট পিটিশন করেন। প্রফেসর ইউনূস তার ব্যবস্থাপনা পরিচালকের চাকরি রক্ষার জন্য মরিয়া হয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে শত্রুভাবাপন্ন আচরণ করেছেন, যেমনটি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বার বার অভিযোগ করছেন - বিষয়টি মোটেই তা নয়। প্রফেসর ইউনূস যা নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন, তা ছিল ব্যাংকটির আইনি মর্যাদা রক্ষা। কেননা তিনি সব সময় বিশ্বাস করতেন, যে আইনি কাঠামোয় তিনি বিগত সব সরকারের সহায়তায় গ্রামীণ ব্যাংক গড়ে তুলেছিলেন, তা দারিদ্র্য নিরসনে একটি কার্যকর হাতিয়ার হিসেবে ব্যাংকটিকে সফল করে তুলতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
তার চাকরি বিষয়ে বলতে হয়, প্রফেসর ইউনূস ৬০ বছর বয়সে পদার্পণের পর তিনি কয়েকবারই পদত্যাগ করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু পরিচালনা পরিষদ প্রতিবারই তাকে দায়িত্ব পালন করে যেতে বলেছিলেন। ২০১০ সালে প্রফেসর ইউনূস তার একজন উত্তরসূরি খোঁজার প্রক্রিয়া শুরু করতে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী এ এম এ মুহিত সাহেবকে অনুরোধ করেছিলেন। যেহেতু তিনি নিজেই একজন যোগ্য উত্তরসূরির কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ ছেড়ে দিতে চাইছিলেন। এ এম এ মুহিতকে লেখা প্রফেসর ইউনূসের এ চিঠি সে সময়ে দেশের সব সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছিল, যেহেতু মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ আঁকড়ে রাখার জন্য প্রফেসর ইউনূসের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছিলেন। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, প্রফেসর ইউনূসের বয়স ৬০ বছর অতিক্রম করে আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথম মেয়াদে ২০০১ সালে। কিন্তু সে সময়ে সরকার কখনোই তার বয়স নিয়ে কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করেনি। পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংকও এ-নিয়ে কোনো প্রশ্ন করেনি। প্রফেসর ইউনূস ব্যাংকের আইনি মর্যাদা সমুন্নত রাখতে হাইকোর্টে যান। তিনি হাইকোর্টে একটি রিট পিটিশন দায়ের করেন। ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে তার চাকরি ধরে রাখার সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই।
হাইকোর্ট এ কারণ দেখিয়ে প্রফেসর ইউনূসের পিটিশন শুনানির জন্য গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানান যে এ বিষয়ে তার কোনো “Locus Standi” নেই অর্থাৎ এ বিষয়ে পিটিশন দাখিল করার কোনো এখতিয়ার তার নেই। এরপর তিনি আপিল বিভাগে যান এবং আপিল বিভাগও একই যুক্তিতে তার আবেদন গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানান। এরপর প্রফেসর ইউনূস মে ১২, ২০১১ তারিখে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে পদত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেন। প্রধানমন্ত্রীর অভিযোগ: বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশ যখন এলো, ইউনূস তখন বাংলাদেশ ব্যাংকের বিরুদ্ধে এবং আমাদের সরকারের বিরদ্ধে মামলা করল। কিন্তু প্রত্যেকটা মামলায়ই তিনি হেরে গেল, কারণ আইন তো তাকে কভার দিতে পারে না… আইন তো তার বয়স কমাতে পারে না। কোর্ট তো আর তার বয়স কমাতে পারেন না। হেরে যেয়ে আরও ক্ষেপে গেল। হিলারি ক্লিনটনকে দিয়ে আমাকে ফোন করিয়েছে, টনি ব্লেয়ারের স্ত্রী শেরি ব্লেয়ার, তাকে দিয়ে ফোন করিয়েছে, তারপর একজন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টের প্রতিনিধি আসছে ... সবাই কি ... ইউনূসকে ব্যাংকের এমডি রাখতে হবে। মাননীয় স্পিকার, আমি জাতির কাছেই প্রশ্ন করি, ব্যাংকের এমডিতে কি এত মধু ছিল যে ওইটুকু ওনার না হলে চলত না? সে তো নোবেল প্রাইজ পেয়েছে। তো আমি জিজ্ঞেস করলাম নোবেল প্রাইজ যে পায়, সে এমডি পদের জন্য এত লালায়িত কেন? সেটা আমার মনে হয় সবার একটু চিন্তা করে দেখা উচিত। এবং ওয়ার্ল্ড ব্যাংক যাতে টাকাটা বন্ধ করে, তার জন্য বারবার ইমেইল পাঠানোম হিলারির সঙ্গে দেখা করা, এর ফাঁকে দিয়ে ইমেইল পাঠানো এবং তার সঙ্গে আমাদের একজন সম্পাদকও খুব ভালোভাবে জড়িত ছিল। কাজেই একটা কথা হচ্ছে যে এদের মধ্যে কি কোনো দেশপ্রেম আছে?
আমাদের জবাব: গ্রামীণ ব্যাংক থেকে প্রফেসর ইউনূসের অপসারণের সংবাদটি বিশ্বব্যাপী সংবাদে পরিণত হয়েছিল। তবে তা এ কারণে নয় যে তিনি এ পদে থাকতে চেয়েছিলেন। বরং এ কারণে যে বিশ্বব্যাপী গ্রামীণ দর্শন ও এর কর্মপদ্ধতির অনুরাগী ও অনুসরণকারীদের বিশাল কমিউনিটির কাছে এটি ছিল অত্যন্ত অবিশ্বাস্য ও হতবুদ্ধিকর একটি ঘটনা। তারা বিভিন্নভাবে তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করছিলেন। তারা প্রফেসর ইউনূসকে তার পদে ফিরিয়ে আনার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিচ্ছিলেন না, তারা এটা দেখতে চাইছিলেন যে গ্রামীণ কর্মসূচিগুলির অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকুক। দরিদ্রদের আশার স্থল হিসেবে বিশ্বজুড়ে গ্রামীণকে কী দৃষ্টিতে দেখা হয়, এটি ছিল তারই একটি বহিঃপ্রকাশ মাত্র।
প্রফেসর ইউনূসকে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে অপসারণের ঘটনায় বিশ্বব্যাপী যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়, তা একটি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র কাহিনী। দুর্নীতির কারণে পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন বন্ধে বিশ্ব ব্যাংকের সতর্কতা সংকেতের ঘটনা একই সময়ে ঘটেছিল। একই সময়ে চলমান দুটি আলোচনার বিষয়কে মিশিয়ে ফেলে একটা সম্পূর্ণ ভিন্ন কাহিনী সৃষ্টি করা হয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলছেন যে হিলারি ক্লিনটনের সঙ্গে চক্রান্ত করে প্রফেসর ইউনূস বিশ্ব ব্যাংকের ওপর চাপ সৃষ্টি করায় পদ্মা সেতুতে বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়ন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। পদ্মা সেতুতে বিশ্ব বাংকের অর্থায়ন বন্ধে প্রফেসর ইউনূস চাপ প্রয়োগ করেছেন, এ বিষয়টি প্রথমবার যখন উল্লেখ করা হয়, তখনই প্রফেসর ইউনূস এ বিষয়ে একটি সুস্পষ্ট বক্তব্য দেন। তিনি জোর দিয়ে বলেন যে পদ্মা সেতু বাংলাদেশের সব মানুষের দীর্ঘদিনের একটি স্বপ্ন-- এবং তিনিও এ স্বপ্নে বিশ্বাসী। এ স্বপ্ন বাস্তবায়নে বাধা সৃষ্টির কোনো প্রশ্নই আসে না। প্রফেসর ইউনূস বলেন "আজ পদ্মা সেতুর নির্মাণ সমাপ্ত হওয়ায় দেশের মানুষ আনন্দে উদ্বেলিত। দেশের সব মানুষের সঙ্গে আমিও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে এ ঐতিহাসিক সাফল্যের জন্য অভিনন্দন জানাচ্ছি। এ কাহিনীতে বলা হয়েছে যে প্রধানমন্ত্রীর প্রতি বিদ্বেষপরায়ণ হয়ে প্রফেসর ইউনূস পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন বন্ধে তার “বিশাল প্রভাব” কাজে লাগিয়েছেন। প্রফেসর ইউনূস বিশ্ব ব্যাংকের ওপর সরাসরি চাপ প্রয়োগ না করলেও তিনি তার বন্ধু হিলারি ক্লিনটনের মাধ্যমে তা করিয়েছেন। অন্য কথায়, বিশ্ব ব্যাংক কর্তৃক চুক্তি বাতিলের ঘটনায় তার কোনো না কোনো সংযোগ নিশ্চয়ই আছে। প্রধানমন্ত্রী আরও বলেছেন যে একটি নামকরা সংবাদপত্রের এক সম্পাদক অর্থায়ন বন্ধে বিশ্ব ব্যাংকের প্রেসিডেন্টকে প্ররোচিত করতে বিশ্ব ব্যাংক কার্যালয়ে তার সঙ্গে দেখাও করেছেন। আন্তর্জাতিক সিদ্ধান্ত-গ্রহণের কঠিন জগৎ দুই বন্ধুর খেয়াল-খুশি বা একজন পত্রিকা সম্পাদকের সাক্ষাৎ করতে যাওয়ার ওপর নির্ভর করে না। প্রফেসর ইউনূস যত “গুরুত্বপূর্ণ” ব্যক্তিই হোন না কেন, তার যত “প্রভাবশালী বন্ধুই” থাকুক না কেন, একটি ৩০০ কোটি ডলারের প্রকল্প শুধু এ কারণে বন্ধ হয়ে যেতে পারে না যে তিনি চাইছিলেন এটা বাতিল হয়ে যাক। অভিযোগের জবাবে আবার বলতে হচ্ছে যে প্রফেসর ইউনূস পদ্মা সেতু বিষয়ে বিশ্বব্যাংক বা অন্য কোনো সংস্থা বা ব্যক্তির কাছে কখনও কোনো অভিযোগ বা অনু্যোগ জানাননি। সুতরাং বিষয়টি নিতান্তই কল্পনাপ্রসূত।
দেশকন্ঠ/অআ