দেশকন্ঠ প্রতিবেদন : করোনা মহামারিতে স্বাস্থ্যখাতের অনেক অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি সামনে আসে। এসব কারণে বেশ কয়েকটি হাসপাতালে তখন অভিযানও পরিচালনা করা হয়। বিচারের মুখোমুখি হতে হয়েছে খোদ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদকে। করোনাকালে স্বাস্থ্যখাতের এসব দুর্নীতি ও অনিয়ম নিয়ে বেশ কয়েকটি মামলা হয়েছে। সেসব মামলার মধ্যে জেকেজি হেলথ কেয়ারের শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ১৯ জুলাই প্রথম রায় ঘোষণা করা হয়েছে। রায়ে জেকেজির সাবেক চেয়ারম্যান ও জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের বরখাস্ত চিকিৎসক ডা. সাবরিনা চৌধুরী এবং তার স্বামী ও প্রতিষ্ঠানটির সিইও আরিফুল হক চৌধুরীসহ ৮ আসামিকে ১১ বছর করে কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। এর মাধ্যমে করোনা মহামারিতে স্বাস্থ্যখাতে অনিয়মের জন্য হওয়া প্রথম কোনো মামলার রায় হলো। স্বাস্থ্য খাতের অনিয়ম রোধে এ রায় একটি দৃষ্টান্ত হিসেবে কাজ করবে বলে মনে করছে রাষ্ট্রপক্ষ। রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছেন, কোভিড-১৯ রাষ্ট্র এবং জনগণ সবার জন্যই ছিল একটা দুর্যোগ। সেই দুর্যোগ মোকাবিলায় সরকার কিছু হাসপাতালকে বিনামূল্যে করোনা পরীক্ষার দায়িত্ব দেয়। যেসব শর্তে করোনা পরীক্ষার দায়িত্ব পেয়েছে, জেকেজি হেলথ কেয়ার সেসব শর্ত লঙ্ঘণ করে লাভবান হতে প্রতারণা, জাল রিপোর্ট তৈরি এবং জাল প্রত্যয়নপত্রকে খাঁটি হিসেবে ব্যবহার করে দণ্ডবিধির ৪২০, ৪৬৬ ও ৪৭১ ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন। এরপর বিচারক তিনটি পৃথক ধারায় দণ্ড ঘোষণা করেন।
রায়ে দণ্ডবিধির ৪২০ ধারায় প্রত্যেককে ৩ বছর কারাদণ্ড ও ৩ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে তিন মাসের সশ্রম কারাদণ্ড, দণ্ডবিধির ৪৬৬ ধারায় প্রত্যেককে ৪ বছর কারাদণ্ড ও ৪ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে চার মাসের সশ্রম কারাদণ্ড এবং দণ্ডবিধির ৪৭১ ধারায় ৪ প্রত্যেককে ৪ বছর কারাদণ্ড ও ৪ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও চার মাসের সশ্রম কারাদণ্ড দেন আদালত। রাষ্ট্রপক্ষ এই রায়কে স্বাগত জানিয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ও সিএমএম আদালতের স্পেশাল পাবলিক প্রসিকিউটর আজাদ রহমান বলেন, রায়ে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী হিসেবে আমরা সন্তুষ্ট। তবে যেসব ধারায় দণ্ড হয়েছে তাতে আরও বেশি সাজা হতে পারতো। স্বাস্থ্যখাত নিয়ে এই রায়কে স্বাগত জানিয়ে রাষ্ট্রপক্ষের এই আইনজীবী বলেন, মহামারিতে মানুষের অসহায়ত্বকে কাজে লাগিয়ে যারা অনিয়ম করে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার চেষ্টা করেছে তারা আসলে দেশ ও জনগণের শত্রু। স্বাস্থ্যখাতে এমন অনিয়ম ও দুর্নীতি করার সাহস আর যাতে কেউ না পায়। এই রায়ের কারণে নিশ্চয়ই অন্যরাও এমন অপরাধের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকবে। এটা তাদের জন্য একটা সতর্ক বার্তা। তবে আসামিপক্ষের আইনজীবীরা এই রায়ে সংক্ষুব্ধ। রায়ে আসামিরা ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন বলে মনে করেন তারা। আসামিপক্ষের অন্যতম আইনজীবী ফারুক আহাম্মদ বলেন, এই মামলায় তিনটি ধারায় আলাদাভাবে সাজা দেয়া হয়েছে। সাধারণত, পৃথক অভিযোগে সাজা হলে সবচেয়ে বেশি মেয়াদের দণ্ড ভোগ করতে হয়। কিন্তু এখানে বলা হয়েছে সাজাগুলো একটার পর একটা চলবে, ফলে তাদের ১১ বছর সাজা ভোগ করতে হবে। এ ধরনের রায় আমরা আগে কখনও দেখিনি। তিনি আরও বলেন, সাক্ষ্য প্রমাণে আসছে জেকেজি বৈধ প্রতিষ্ঠান।
রায়ে বলা হয়েছে, প্রতিষ্ঠানটি করোনা পরীক্ষার জাল সনদ দিয়েছি। বাদীসহ ভুক্তভোগীরা জাল সনদের কোনো কপি আদালতে উপস্থাপন করতে পারেননি। তদন্তকারী কর্মকর্তা কিছু ফটোকপি জমা দিয়েছে। ফটোকপি তো সাক্ষ্য আইনে গ্রহণযোগ্য নয়। এখানে কোনো প্রমাণ না থাকা সত্বেও বিজ্ঞ আদালত আমাদের সাজা দিয়েছেন। আমরা মনে করি আমাদের প্রতি অন্যায় করা হয়েছে, অবিচার করা হয়েছে এবং একটা পক্ষকে খুশি করা হয়েছে। আমরা এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করব। সাবরিনা-আরিফুল ছাড়াও মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত অন্য আসামিরা হলেন— আবু সাঈদ চৌধুরী, হুমায়ূন কবির হিমু, তানজিলা পাটোয়ারী, বিপ্লব দাস, শফিকুল ইসলাম রোমিও ও জেবুন্নেসা। এই মামলায় গত ২৯ জুন উভয়পক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে একই আদালত রায়ের জন্য এই দিন ধার্য করেন। চার্জশিটভুক্ত ৪০ জন সাক্ষীর মধ্যে ২৬ জনের সাক্ষ্য নেন আদালত। এরপর ১১ মে এই মামলার ৮ আসামি নিজেদের নির্দোষ দাবি করে ন্যায়বিচার প্রার্থনা করেছেন। ওইদিন ডা. সাবরিনা ও তার স্বামী আরিফুল চৌধুরী লিখিত বক্তব্য জমা দেন। এরপর মামলাটিতে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শুরু হয়। ২০২০ সালের ৫ আগস্ট তাদের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) পরিদর্শক লিয়াকত আলী। এরপর একই বছর ২০ আগস্ট আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে বিচার শুরুর নির্দেশ দেন আদালত। করোনার ভুয়া রিপোর্ট প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান জেকেজি হেলথ কেয়ারের কর্ণধার আরিফুল চৌধুরীর স্ত্রী ডা. সাবরিনা চৌধুরী জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের একজন চিকিৎসক। মামলার পর ওই প্রতিষ্ঠান থেকে তাকে বরখাস্ত করা হয়েছে। জেকেজির চেয়ারম্যানের দায়িত্বে সাবরিনা আছেন বলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জানায়।
২০২০ সালের ১২ জুলাই সাবরিনাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তেজগাঁও বিভাগীয় উপ-পুলিশ (ডিসি) কার্যালয়ে আনা হয়। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন জেকেজির প্রতারণা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা, ডিসিসহ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। জিজ্ঞাসাবাদে তিনি সদুত্তর দিতে না পারায় তাকে তেজগাঁও থানায় আগেই আরিফুলের বিরুদ্ধে হওয়া মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়। ২০২০ সালের ২৩ জুন করোনার ভুয়া সনদ দেওয়া, জালিয়াতি ও প্রতারণার অভিযোগে আরিফুলসহ ছয়জনকে গ্রেফতার করে তেজগাঁও থানা পুলিশ। গ্রেফতারের পর থানা হাজতে থাকা অবস্থায় আরিফুলের ক্যাডার বাহিনী ভাঙচুর ও হামলা করে থানায়। মারধর করে পুলিশকে। জানা যায়, জেকেজির কর্ণধার স্বামী-স্ত্রী মিলে করোনা টেস্টের ভুয়া সনদ বিক্রি করেছেন। প্রতিটি টেস্টের জন্য জনপ্রতি নিয়েছেন সর্বনিম্ন ৫ হাজার টাকা। আর বিদেশি নাগরিকদের কাছ থেকে জনপ্রতি তারা নিতেন ১০০ ডলার।
দেশকন্ঠ/অআ