দেশকন্ঠ প্রতিবেদন : ওষুধ শিল্প দেশের রফতানিতে তৈরি পোশাক খাতের মতো ভূমিকা রাখতে সক্ষম এবং পোশাক খাতের মতোই রফতানি করা সম্ভব। ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) আয়োজিত ‘এলডিসি উত্তরণ-পরবর্তী সময়ে ওষুধ খাতের রফতানি : কৌশল নির্ধারণ’ শীর্ষক সেমিনারে বক্তারা এ অভিমত দেন। গতকাল শনিবার ডিসিসিআই অডিটোরিয়ামে অনুষ্ঠিত সেমিনারে প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান ফজলুর রহমান প্রধান অতিথি এবং প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।
স্বাগত বক্তব্যে ঢাকা চেম্বারের সভাপতি রিজওয়ান রাহমান বলেন, এলডিসি উত্তরণের পর রফতানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে অতিরিক্ত ৮-১৫ শতাংশ শুল্ক প্রদান করতে হতে পারে, যার ফলে আমাদের মোট রফতানি ১৪.২৮ শতাংশ হ্রাস পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এর মূল্য প্রায় ৫.৭৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। তিনি বলেন, অর্থনৈতিক এ উত্তরণের পর ২০২৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশি পণ্যের মেধাস্বত্ব সুবিধা অব্যাহত থাকবে, তবে এ সময়কালের পর মেধাস্বত্ব আইনের আওতায় বিদ্যমান সুবিধা অব্যাহত না থাকার কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে রফতানির ক্ষেত্রে আমাদের ওষুধ খাতকে প্রবল প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হতে হবে, সে সঙ্গে কমবে রফতানি। ডিসিসিআই সভাপতি উল্লেখ করেন, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারের স্বার্থে মেধাস্বত্ব আইন গ্রহণের জন্য আমাদের বেসরকারি খাতকে সক্ষমতা অর্জন করতে হবে এবং সে সঙ্গে সরকারের পক্ষ থেকে প্রণোদনা প্রদান করা একান্ত অপরিহার্য। এ ছাড়া দেশীয় ওষুধ শিল্পের গবেষণা খাতের উন্নয়ন ও বাজার সম্প্রসারণে প্রয়োজনীয় নীতি সহায়তা প্রদানের জন্য তিনি সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে উপদেষ্টা সালমান ফজলুর রহমান এমপি বলেন, ওষুধ খাতে আমাদের অর্জন অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক এবং দক্ষ মানব সম্পদের উপস্থিতির কারণে এ সাফল্য অর্জন সম্ভব হয়েছে। তিনি বলেন, এ শিল্পে আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার শুরু হয়েছে। তাই আমাদেরকে আরও বেশি হারে গবেষণা ও উন্নয়ন কাজে মনোনিবেশ করতে হবে। তিনি উল্লেখ করেন, বিশ্বব্যাপী বেশি হারে বায়োলজিক্যাল ড্রাগ উৎপাদনের প্রবণতা আগামীতে আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে। উপদেষ্টা বলেন, বর্তমানে দেশের ব্যবহৃত মোট এপিআইয়ের ১৫ শতাংশ স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত হয়ে থাকে, তবে আরও বেশি হারে মূল্য সংযোজনের নিশ্চিতের বিষয়টি আমাদের জন্য অতীব জরুরি। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশে তৈরি ওষুধের প্রশাধিকারের বিষয়ে তিনি অত্যন্ত আশাবাদী এবং একবার এটা করা সম্ভব হলে ওষুধ খাতের বৈশি^ক ইমেজ তৈরিতে আর কোনো প্রতিবন্ধকতা থাকবে না বলে তিনি মত প্রকাশ করেন। আগামী ৪-৫ বছরের মধ্যে এ খাতে প্রায় ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রফতানি সম্ভব বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি। এ ছাড়া তৈরি পোশাক খাতের সুবিধাগুলো দেশের রফতানিমুখী অন্য সম্ভাবনাময় খাতগুলোতে প্রদানের ওপর জোরারোপ করেন।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস বলেন, বাংলাদেশের এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের সময় করোনা মহামারি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মতো বেশকিছু বৈশি^ক সঙ্কট দেখা দিয়েছে, যে কারণে এ বিষয়ে আমাদেরকে আরও সচেতন থাকতে হবে এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পৃক্ততা বেশি থাকায় আমাদের অর্থনীতিতে এর প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। তিনি বলেন, তৈরি পোশাক রফতানিতে আমরা আমাদের সক্ষমতা দেখিয়েছি এবং ওষুধ খাতসহ অন্যান্য খাতে এ সক্ষমতা বজায় রাখতে পারলে দেশের রফতানি উল্লেখজনক হারে বৃদ্ধি পাবে। এলডিসি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকারের পক্ষ থেকে বেসরকারি খাতকে সার্বিক সহায়তা প্রদান করা হবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন। জ¦ালানি সঙ্কটের কারণে দেশে বিদ্যুৎ খাতে উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলায় বেসরকারি খাতসহ সব জনগণকে আরও সচেতন ও সাশ্রয়ী হওয়ার জন্য তিনি আহ্বান জানান।
সেমিনার মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সম্মানিত ফেলো প্রফেসর ড. মোস্তাফিজুর রহমান। মূল প্রবন্ধে তিনি উল্লেখ করেন, আমাদের অর্থনীতির জন্য ওষুধ খাত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যেটি অভ্যন্তরীণ চাহিদার প্রায় ৯৭ শতাংশ উৎপাদন করতে সক্ষম, যার মূল্য প্রায় ৩.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। তিনি বলেন, ২০২১-২২ অর্থবছরে ওষুধ খাতে রফতানির পরিমাণ ছিল ১৮৮.৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং বাংলাদেশের ওষুধ ও কেমিক্যাল খাতে বৈদেশিক বিনিয়োগের পরিমাণ হলো ৪১৯.২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা মোট বৈদেশিক বিনিয়োগের প্রায় ১.৯৪ শতাংশ। মোস্তাফিজ বলেন, গত অর্থবছর আমাদের ওষুধ খাত প্রায় ১০৫০.১ মিলিয়ন মার্কিন ডালারের কাঁচামাল আমদানি করছে, এ অবস্থায় স্থানীয়ভাবে এপিআই উৎপাদনে বাংলাদেশের সক্ষমতা বৃদ্ধির ওপর আরও মনোযোগী হতে হবে। এ ছাড়া গবেষণা ও উন্নয়নের ওপর জোরারোপ, মানবসম্পদের দক্ষতা উন্নয়ন, এফডিআই সম্প্রসারণে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে যৌথ বিনিয়োগ আকর্ষণে গুরুত্বারোপ, কন্ট্রাক ম্যানুফ্যাকচারিংকে উৎসাহিতকরণ, স্থানীয়ভাবে এপিআই উৎপাদনের কাঁচামাল ও ল্যাবরেটরির যন্ত্রপাতি আমদানি এবং উৎপাদিত এপিআই ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে ভ্যাট ও উৎসে কর অব্যাহতির প্রস্তাব করেন, সংশ্লিষ্ট নীতিমালার সংস্কার ও প্রয়োজনে দ্রুততার সঙ্গে নতুন নীতিমালা প্রণয়নের ওপর তিনি জোরারোপ করেন। তিনি মত প্রকাশ করেন যে, প্যাটেন্ট আইন এবং ওষুধ নীতিমালায় প্রয়োজনীয় সংশোধনের বাংলাদেশ ট্রিপস চুক্তি অনুসারে লাইসেন্সিং বাধ্যতামূলক করার মধ্য দিয়ে আমাদের ওষুধ শিল্প সুবিধা ভোগ করতে পারে।
সেমিনারের নির্ধারিত আলোচনায় জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োমেডিকেল গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক অধ্যাপক ড. এবিএম ফারুক এবং ইউনিমেড ইউনিহেলথ ফার্মাসিউটিক্যাল লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম মোসাদ্দেক হোসেন অংশগ্রহণ করেন। আলোচকরা দ্রুততম সময়ে এপিআই পার্কের কার্যক্রম সম্পন্নকরণ, দীর্ঘমেয়াদি নীতিসহায়তা প্রদান, তৈরি পোশাকের মতো সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিতকরণ, ট্রিপস চুক্তির সময়কাল সম্প্রসারণে ডব্লিউটিওর সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন এবং এশিয়ান অঞ্চলের বাজার সম্প্রসারণের প্রতি মনোনিবেশ বাড়ানোর আহ্বান জানান। ডিসিসিআই সহসভাপতি মনোয়ার হোসেন এবং পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরা এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
দেশকন্ঠ/রাসু