মোয়াজ্জেম হোসেন রাসেল : এশিয়া কাপের প্রথম দুই ম্যাচে জয়ী দলের নাম আফগানিস্তান ও ভারত। দুটি দলই টসে জিতে প্রতিপক্ষ হিসেবে শ্রীলংকা ও পাকিস্তানকে আগে ব্যাট করতে পাঠায়। ফলাফল হিসেবে প্রথম ম্যাচে জয় নিয়ে মাঠ ছাড়ে সময়ের দুই আলোচিত দল। মোহাম্মদ নবীর আফগানিস্তান আর রোহিত শর্মার ভারত তো এক কথায় দুর্দান্ত খেলছে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে। যার প্রমাণ এশিয়া কাপে রেখে চলেছে দেশ দুটি। বাংলাদেশ আসরের প্রথম ম্যাচে আফগানদের মুখোমুখি হয়ে জয়ের আশা করেছিল। কিন্তু টসে জিতে আগে ব্যাটিং করতে নেমে চারিদিকে সমালোচনার তীরে বিদ্ধ হয় সাকিব আল হাসানের দল।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেশের একটি প্রথম সারির টিভি চ্যানেলের স্পোর্টস রিপোর্টার পরিস্কারভাবে লিখেন, টসে জিতে বাংলাদেশের ব্যাটিং করাটা কোনভাবেই উচিত হয়নি। আজকের ম্যাচে যদি বাংলাদেশ জিতেও তবুও আমি এটাকে ভুল সিদ্বান্তই বলব। দিন শেষে কিন্তু সেটাই প্রমাণিত হলো। বাংলাদেশ ৭ উইকেটে হেরে এশিয়া কাপ শুরু করে এখন সুপার ফোরে যাওয়াটা ফেলে দিয়েছে অনিশ্চয়তার মধ্যে। বলা যায়, সেই পুরনো বাংলাদেশেরই দেখা মিলেছে। মেন্টর হিসেবে যোগ দেওয়া শ্রীধরণ শ্রীরামও দলের হতশ্রি চেহারা পাল্টাতে পারলেন না। এছাড়া দলের বিদেশি কোচিং স্টাফরা কি করছেন সেই প্রশ্নেরও উত্তর মিলছেনা। হচ্ছেনা কুড়ি ওভারের ক্রিকেটে উন্নতি।
ওয়ানডে ক্রিকেটে সমীহ করা দল হলেও টেস্ট ও টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে যেন বাজে সময়ই সঙ্গী বাংলাদেশের। এশিয়া কাপের আগে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে তিন ম্যাচ সিরিজটা হারতে হয়েছে ২-১ ব্যবধানে। তখনই আচ করা গিয়েছিল এশিয়া সেরা আসরে খুব ভাল কিছু করতে পারবেনা লাল সবুজ পতাকাধারীরা। এছাড়া নতুন করে দায়িত্ব পাওয়া অধিনায়ক সাকিবও শোনাতে পারেনি আশার বানী। বিশ্বকাপে বাংলাদেশ ভাল করবে বলে প্রত্যাশা জানিয়ে এশিয়া কাপের জন্য আশা করতে বারণও করেছিলেন এই বাহাতি অলরাউন্ডার। প্রথম ম্যাচে বড় ব্যবধানে পরাজয় আবারো চোঁখে আঙ্গুল দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে, বাংলাদেশকে আরও অনেক বেশি শিখতে হবে। একটা সময় জিম্বাবুয়ে যেমন বাংলাদেশের কাছে প্রবল প্রতিপক্ষ ছিল আর সেখানে এখন জায়গা করে নিয়েছে আফগানিস্তান। সে কারণেই প্রথম দুই ম্যাচ হারা বাংলাদেশ-শ্রীলংকার পরের ম্যাচটাই দুই দলের জন্য অঘোষিত ’ফাইনাল’ ম্যাচে পরিণত হয়েছে। যে দল জিতবে সেই দলই পৌছে যাবে সুপার ফোরে। তবে প্রথম ম্যাচে পরাজয়েল পর দলের একাধিক ভুল সামনে চলে এসেছে।
প্রথমত কাপ্তান সাকিবের টস জিতে ব্যাটিং নেওয়ার সিদ্ধান্তই সাহায্য করেছে আফগানিস্তানকে ম্যাচ জিততে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের শারজাহয় টসে জেতার পর সাকিব বলেছিলেন, ‘ভালো উইকেট মনে হচ্ছে। ভালো রান করতে পারলে তাড়া করা কঠিন হবে আফগানিন্তানের।’ তবে ক্রিজে নেমে ভিন্ন চিত্রই দেখলেন টাইগার অধিনায়কও তার সতীর্থরা। নতুন ক্রিজ হওয়ায় তেমন একটা সুবিধা করতে পারছিলেন না বাংলাদেশের ব্যাটাররা। আফগানিস্তান অধিনায়ক মোহাম্মদ নবী জেতার পর বলেন, ’বাংলাদেশের বিপক্ষে আগে বোলিং করায় সুবিধা পেয়েছেন তারা। ম্যাচের আগের দিন সন্ধ্যায় উইকেট বুঝতে বাংলাদেশ দলের টেকনিক্যাল কনসালট্যান্ট শ্রীধরন শ্রীরাম ও টিম ডিরেক্টর খালেদ মাহমুদ শারজায় এসেছিলেন। উইকেট বোঝার চেষ্টা করে তেমন একটা লাভ হলো না। সাকিবের টস সিদ্ধান্তই নবীদের জিততে সাহায্য করে। ম্যাচশেষে আফগান অধিনায়ক নবী জানিয়েছেন, ’আগে বল করতে পেরে ক্রিজ সম্পর্কে বেশি করে জানতে পারেন তারা। এই উইকেটের মাটি নতুন। আর এই পিচে অগে কেউ খেলেনি। তাই আগে বোলিং করে ভালো হয়েছে। পিচ সম্পর্কেও ভাল করে জানার সুযোগ পেয়েছি। বুঝতে পেরেছি পিচ কেমন আচরণ করছে। সেটা কাজে লাগিয়েই আমরা দ্রুত উইকেট নিতে পেরেছি। তাদের চাপে রাখতে পেরেছি।’
এই ম্যাচে দলীয় ১৫ রানে প্রথম উইকেট হারিয়েছিল আফগানিস্তান। সাকিবের বল এগিয়ে এসে খেলতে গিয়ে স্ট্যাম্পিং হন রহমান্যুল্লাহ গুরবাজ। ওয়ানডাউনে নেমে চাপ সামলে ধীরে সুস্থে ইনিংস বড় করে ইবরাহীম জাদরান ৪১ বলে ৪২ রানে অপরাজিত ছিলেন তিনি। এরপর পাঁচে নেমে তান্ডব চালিয়ে ম্যাচ থেকে বাংলাদেশকে ছিটকে দেন নাজিবুল্লাহ জাদরান। দুই পেসার মোস্তাফিজ-সাইফুদ্দিনদের বেধড়ক পিটিয়ে ১৭ বলে ৪৩ রান করে জয়ের পথ প্রশস্ত করেন তিনি। ১ চারের সঙ্গে হাঁকান ৬টি ছক্কা! তাতেই আফসোসে পুড়েছে বাংলাদেশ। একজন পাওয়ার হিটারের যে কত অভাব দলে, সেটি নাজিবুল্লাহর ব্যাটিং দেখে দীর্ঘশ্বাস ছুটেছে প্রতিটি লাল সবুজ সমর্থকের। মূলত মোস্তাফিজ-সাইফউদ্দিনের দুই ওভারেই হেরেছে বাংলাদেশ। দ্য ফিজ খ্যাত বাহাতি পেসার নাকি অহংকারে মাটিতে পা ফেলতে চান না। সে কারণে কোন বোলিং কোচই তাকে নতুন কিছু শেখাতে পারেন না বলে অভিযোগ রয়েছে মোস্তাফিজের বিরুদ্ধে।
এছাড়া ব্যাটিং কনসালটেন্ট হিসেবে সাবেক কোচ জেমি সিডন্সকে নিয়োগ দেওয়ার পর আশায় বুক বেধেছিল। কিন্তু আশার কাছেও যেতে পারেননি এই অষ্ট্রেলিয়ান। তাইতো দলের খেলোয়াড়দের পাশাপাশি কোচিং স্টাফের সদস্যরাও মুন্সিয়ানার পরিচয় দিতে পারছেন না। পুরনো বাংলাদেশ থেকে বের করে আনার মতো ডাইনামিকও হতে পারছেন না। খেলোয়াড়দের স্বাভাবিক খেলাটাও বের করে আনতে পারছেন না তারা। তাইতো টি-টোয়েন্টি ম্যাচ আসলেই কেমন যেন হতাশা পেয়ে বসে। কোনভাবেই আশার আলো দেখাতে পারছেন না। সামনেই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ থাকার কারণেই এবারের এশিয়া কাপ কুড়ি ওভারের করা হয়েছে। বাংলাদেশ কেমন করবে সেই আশা করছেন না ক্রিকেটপ্রেমিরা। পারফরম্যান্সে সেই পুরনো বাংলাদেশের দেখা পাওয়ায় হতাশা বাড়ছে। সেটি কাটাতে পরের ম্যাচে শ্রীলংকার বিপক্ষে জয়ের কোন বিকল্প নেই। নতুন করে শুরু করতে গিয়ে হোচট খাওয়া লাল সবুজের দলটির জন্য একটি জয় অনেক বেশি প্রত্যাশিত আর গুরুত্বপূর্ণ।
এদিকে শারজাহ ক্রিকেট গ্রাউন্ডে বাংলাদেশের রেকর্ডও ভাল নয়। গত বছর প্রথমবারের মতো শারজাহতে টি-টোয়েন্টি খেলতে নামলেও এই ভেন্যুতে বাংলাদেশের খেলার অভিজ্ঞতা যদিও বেশ পুরনো। শারজাহর এই ভেন্যুতে মোট পাঁচটি ওয়ানডে খেলেছে বাংলাদেশ দল। টি-টোয়েন্টির মতো এই ফরম্যাটেও সবগুলো ম্যাচে হেরে মাঠ ছাড়তে হয়। ১৯৯০ সালে শারজাহতে প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলতে নামে দল। অস্ট্রেলিয়া-এশিয়া কাপ নামে ওই টুর্নামেন্টের চতুর্থ ও ষষ্ঠ ম্যাচ খেলে বাংলাদেশ দল। দুই ম্যাচেই বড় ব্যবধানে হেরে শুরু করে তারা। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ১৬১ রানে ও অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ৭ উইকেটে হার মানতে হয়। ১৯৯৫ সালে শারজাহতে পেপসি এশিয়া কাপে আরও তিনটি ম্যাচ খেললেও বাংলাদেশের ভাগ্য বদলায়নি। ভারতের বিপক্ষে ৯ উইকেটের বিশাল হারে শুরু হয়ে শ্রীলংকার বিপক্ষে ১০৭ রানে এবং পাকিস্তানের বিপক্ষে ৬ উইকেটে হারতে হয়। ১৯৯৫ সালের ৮ এপ্রিল পাকিস্তানের বিপক্ষে খেলা ওয়ানডেটিই শারজাহতে বাংলাদেশের খেলা সর্বশেষ ম্যাচ। দীর্ঘদিন পর গত বছর এই মাঠে খেলতে নামে দল। সব মিলিয়ে শারজাহতে এখন পর্যন্ত ৭টি ম্যাচ খেলে। যার মধ্যে পাঁচটি ওয়ানডে ও দুটি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলেছে বাংলাদেশ। আফগানদের বিপক্ষে পরাজয়ে সংখ্যাটা ৮ এ গিয়ে দাড়াল। জয়ের অপেক্ষাটা তাই আরও দীর্ঘ হলো সাকিবের দলের।
দেশকণ্ঠ/আসো