দেশকন্ঠ ডেস্ক : হৃদরোগ হওয়ার পর চিকিৎসার চেয়ে, হওয়ার আগে প্রতিরোধ করাই উত্তম। হৃদরোগ সম্বন্ধে বলতে গেলে প্রথমে হৃদরোগ কী জিনিস সেটা বোঝা দরকার। এটি হলে হৃদপিণ্ড বা হার্টের অসুখ। হার্টের অসুখ কিন্তু বিভিন্ন কারণে হয়ে থাকে। তার মধ্যে একটি জিনিস আমাদের দেশে খুব প্রচলিত ছিল, সেটি হলো, রিউমাটয়েড ফিভার বা বাত জ্বর হওয়ার পর হার্টের ভাল্ব নষ্ট হতো। একে আমরা বলতাম রিউমাটয়েড হার্ট ডিজিজ। এতে হার্টের ক্ষতি হতে হতে হার্ট ফেইলিউর তৈরি হয় এবং বাচ্চা বয়স থেকে শুরু করে পরিণত বয়সের লোকজন মারা যেত। এটি একটি বিষয়।
আরেকটি হলো, যাদের হাইপারটেশন বা হাই ব্লাড প্রেশার (উচ্চ রক্তচাপ) ছিল, তাদের অনেক সময় হার্ট অ্যাটাক হতে পারে। জন্মগত হার্ট অ্যাটাক তো আছেই। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যেই জিনিসটি যাকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় ইসকেমিক হার্ট ডিজিজ। ইসকেমিক কথাটার একটু ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন। ইসকেমিক কথাটার মানে হলো, কাজ কর্ম করার জন্য যেটুকু রক্তের প্রয়োজন, সে রক্ত যদি ঠিক মতো না হয়, তাহলে যে রোগগুলো হয় একে ইসকেমিক হার্ট ডিজিজ বলে।
আমরা জানি শরীরে রক্ত স্বঞ্চালন করতে হলে হার্টের নিজস্ব রক্তের প্রয়োজন। এই নিজস্ব রক্ত বহনের জন্য যে রক্তনালীগুলো আছে, সেখানে যদি কোনো রোগ হয়, তাহলে ক্রমাগতভাবে রক্ত কমতে কমতে হার্টের রোগ হতে পারে। ক্রমাগতভাবে কমতে কমতে হার্ট অ্যাটাক হলে যেটা হয়, আস্তে আস্তে বিভিন্ন ধরনের লক্ষণ হয়, হার্টের কার্যক্রম কমে যায়, মানুষ দুর্বল হয়ে যায়। হার্ট দুর্বল হয়ে আসে এবং হার্ট ফেইলিউর তৈরি হয়। কিন্তু এই রোগটি যখন হঠাৎ করে হয়, তখনই হার্ট অ্যাটাক হয়। হার্ট অ্যাটাক হলে অনেক ক্ষেত্রে মানুষ মারা যায়। যারা বেঁচে যায়, তাদেরও কার্যক্ষমতা কমে যায়।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, হৃদরোগ খুব সামগ্রিক একটি রোগ। যার মধ্যে অনেকগুলো বিষয় কাজ করে। কিন্তু যেহেতু ইসকেমিক হার্ট ডিজিজ একটি কঠিন রোগ, সে কারণে আমরা এই রোগটি প্রতিরোধ করার চেষ্টা করি।কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে, জন্মগত রোগ আমরা প্রতিরোধ করতে পারি না। কিন্তু উচ্চ রক্তচাপ থেকে যে রোগ হয় সেটি আমরা প্রতিরোধ করতে পারি। ইসকেমিক হার্ট ডিজিজও আমরা প্রতিরোধ করতে পারবো। এছাড়া অপুষ্টি হয়ে গেলে, বাচ্চাদের খাওয়া দাওয়া যদি কম হয়, সেটিও আমরা প্রতিরোধ করতে পারি। সুতরাং সবকিছুই আমাদের প্রতিরোধের অংশ।
হৃদরোগের মধ্যে ইসকেমিক হার্ট ডিজিজই বেশি আলোচনায় আসে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে ইসকেমিক হার্ট ডিজিজে রক্তনালীর সমস্যা বেশি এখানে। সুতরাং হার্টের মধ্যে যে রক্তনালী এর জন্য যেভাবে রোগ হয়, তেমনি মস্তিস্কেও তাই হয়। আবার হাতে পায়ে যে রক্তনালী আছে সেগুলোও যদি ব্লক হয়ে যায়, সেখানেও রোগ হতে পারে। কিন্তু যেহেতু এই রোগগুলোর কারণ একই, রক্তনালীগুলোতে চর্বি জাতীয় জিনিস জমে, সেটা আস্তে আস্তে ব্লক হয়ে গিয়ে, এই রোগগুলো হয়। সুতরাং এ থেকে এথেরোসক্লোরোসিস হয়। এই রোগকে আমরা যদি প্রতিরোধ করতে পারি, তাহলে হার্টের রোগের সাথে সাথে স্ট্রোকও প্রতিরোধ হতে পারে। পায়ের রোগ প্রতিরোধ হতে পারে। এমনকি অন্ধত্বও প্রতিরোধ হয়ে যেতে পারে।
এর কোনো নির্দিষ্ট কারণ খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে এটি একধনের প্রদাহ। যদি এটি নির্দিষ্ট কোনো কারণে হচ্ছে না। তবে কতগুলো কারণ সমষ্টিগতভাবে মিলে এটি হতে পারে। এর মধ্যে কতগুলো রয়েছে খুব জটিল ধরনের ঝুঁকির বিষয়। এগুলো হলো, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, ধূমপান, কম কাজকর্ম করা, ওজন বেড়ে যাওয়া, চর্বি জাতীয় জিনিসপত্র খাওয়া ইত্যাদি। যাদের মধ্যে এগুলো খুব বেশি রয়েছে তাদেরই দেখা যায়, এই এথেরোসক্লোরোসিস বা চর্বি জাতীয় জিনিসপত্র রক্তনালীতে জমে এবং এই রোগগুলো সৃষ্টি করে। সুতরাং আমরা যদি এই জিনিসগুলোকে একে একে ধরে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করি, তাহলে এই রোগগুলো আস্তে আস্তে প্রতিরোধ করা যায়।
প্রতিরোধে পদক্ষেপ
আজকাল ছোট বেলা থেকেই ওজন বেড়ে যাওয়ার একটি বিষয় দেখা যায়। লক্ষ্য করলে দেখবেন স্কুলে যে বাচ্চারা যাচ্ছে তারা আগের তুলনায় বেশি ভারী। খেলার জায়গার অভাবে, তাদের হয়তো খেলাধুলা হচ্ছে না। সুতরাং বাচ্চা বয়সে যে ওজনাধিক্য সেটি কিন্তু বেশি দেখা যাচ্ছে। এদেরই শেষ পর্যন্ত ওজন বেশি হয়ে যায়। তারা এক পর্যায়ে ঝুঁকিতে পরে যায়। ধূমপান ছাড়তে হবে। এর বিরুদ্ধে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।
এখন আমরা আসি, কিছু রোগ আছে যেগুলো হয়ে যায়। যেমন, উচ্চ রক্তচাপ। উচ্চ রক্তচাপ থাকলে অনেক সময় লক্ষণ প্রকাশ পায় না। এজন্য আমরা হয়তো চিকিৎসা সহজে করি না। নিয়মিত চিকিৎসা না করলে এই রোগ খুব দ্রুত বাড়তে পারে। সেই সাথে যদি ডায়াবেটিস থাকে আরো সাংঘাতিক হয়।
ডায়াবেটিসের চিকিৎসার বিষয়ে ওষুধ যেমন গুরুত্বপূর্ণ, সাথে সাথে তার ব্যায়াম, তার নিয়মানুবর্তিতা, ডায়েট এগুলোও কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ। সবগুলো মিলে যদি করা যায়, তাহলে হয়তো হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি অনেক কমে যায়। বা হলেও এর মাত্রা অনেক কমিয়ে আনা সম্ভব।
আরেকটি বিষয় হলো জীবনযাপনের ধরন। জীবন যাপনের মধ্যে নিয়মটা অনেক সময় থাকছে না। কোনো দিন দুপুরের খাবার একটায় খাচ্ছেন, কোনো দিন তিনটায় খাচ্ছেন। কোনো দিন বাসায় হয়তো রাত ১২ টায় ফিরছেন। আরকেটি বিষয় তরুণদের মধ্যে লক্ষ্য করা যায়, সারারাত ধরে কাজ করছে সকাল ১১টা পর্যন্ত ঘুমাচ্ছে। এটি একটি বদঅভ্যাস। এই জিনিসগুলোকে বোধ হয়, আমাদের পথে আনা বা নিয়মের মধ্যে আনা দরকার। এগুলো নিয়ন্ত্রণে আনলে হয়তো হার্টের রোগকে অনেক প্রতিরোধ করতে পারি।
গণ সচেতনতা এ বিষয়ে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের সাধারণ জনগণ বা যারা রোগী আছেন, তাদের তাদের মতো করে বোঝানো দরকার। জানানো দরকার কিভাবে চললে এই জিনিসগুলো প্রতিরোধ করা যায়। এই ধরনের রোগ পুরোপুরি নিরাময় করার মতো চিকিৎসা অদূর ভবিষতে কবে হবে সেটি কিন্তু আমাদের জানা নাই। সুতরাং প্রতিরোধ করার চেষ্টা অবশ্যই করতে হবে।
স্টেনটিং বা বাইপাস
এগুলো প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নয়। এটি হলো চিকিৎসা ব্যবস্থা, প্রতিকারের ব্যবস্থা। তবে মজার বিষয় হলো এই প্রতিকার আর কলেরার প্রতিকার কিন্তু এক নয়। বা এই প্রতিকার বা টাইফয়েডের প্রতিকার কিন্তু এক নয়। টাইফয়েডের চিকিৎসা দিলে এটি কিন্তু ভালো হয়ে যাবে। কিন্তু হার্ট অ্যাটাকের পর যখন স্ট্যানটিং বা অস্ত্রোপচার করছি এটি কিন্তু নিরাময় হচ্ছে না। একে সাধারণ পেলিয়াটিভ চিকিৎসা বলা হয়ে থাকে। বাংলা করলে দাঁড়াবে জোড়াতালির চিকিৎসা। মানে এক জায়গায় সরু হয়ে গিয়েছিল, সেই জায়গাটি কিছুটা ঠিক করা হয়েছে। তবে যেহেতু ওই রোগীর মধ্যে যেসমস্ত কারণে রোগটি হয়েছে। সেই কারণগুলো তখনও বিদ্যমান, সুতরাং ওই অংশটি আবারও ব্লক হতে পারে। কার কখন কিরকম হবে এটি নির্ভর আছে জটিলতা কতখানি রয়েছে তার ওপর।
ঠিক তেমনই বাইপাসের বিষয়ে হতে পারে যেখানে ব্লক হয়েছে সেটি হয়তো ঠিকই থাকলো, কিন্তু অন্য জায়গায় একটি নালী নিয়ে বাইপাস লাগিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু সে নালী তার শরীরেরই অংশ। সেখানেও আবার ব্লক হতে পারে। সেই কারণে বলা যেতে পারে দুটো পদ্ধতি নিরাময়কারী চিকিৎসা না। এটি একটি জোড়াতালির চিকিৎসা। কিন্তু অস্ত্রোপচার করেন বা স্ট্যানটিং করেন, বাকি প্রতিরোধ মূলক চিকিৎসা অবশ্যই নিতে হবে। যদি না নেওয়া হয়, তাহলে এই ধরনের চিকিৎসা ব্যবস্থা খুব একটা ফলপ্রসূ হবে না। আরো একটি জিনিস, অস্ত্রোপচার করার আগে বা পরে ওষুধের যে খরচ, তার কোনো কমতি নেই। এই সময় খরচ বেশি লাগে। কেননা ব্যবস্থাপনার একটি বিষয় রয়েছে।
দেশকন্ঠ/এআর