দেশকণ্ঠ প্রতিবেদন : প্রথম ম্যাচ বৃষ্টিতে পণ্ড। দ্বিতীয় ম্যাচে অসাধারণ জয়। তৃতীয়টিও স্নায়ুযুদ্ধে জয়ে সিরিজ জয় বাংলাদেশের। এমন এক সিরিজ শেষে দেশে ফিরেছে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। ফিরেই জানিয়ে দিয়েছে বিশ্বকাপের আগে এই সফর বাংলাদেশের অনেক কাজে আসবে। ১৬ মে দেশে ফিরেছে বাংলাদেশ।
৩ ম্যাচের সিরিজে ‘আনুষ্ঠানিক’ স্বাগতিক ছিল আয়ারল্যান্ড। চেমসফোর্ডের কাউন্টি ক্রিকেট গ্রাউন্ডে তিন ম্যাচে বাংলাদেশ সমর্থকদের উপস্থিতি বলছিল একেবারেই ভিন্ন কথা। বাংলাদেশে ফিরে সিরিজসেরা নাজমুল হোসেন বললেন, ‘খুব ভালো লেগেছে। আমার মনে হয়নি দেশের বাইরে খেলছি। অনেক দর্শক ছিল, তারা সব সময় সমর্থন দিয়েছে। এ রকম জিনিস সব সময়ই উপভোগ করি।’
আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম দুই ম্যাচে সুযোগ মেলেনি মুস্তাফিজুর রহমানের। তৃতীয় ম্যাচে সুযোগ পেয়েই বাংলাদেশকে জিতিয়ে মাঠ ছাড়েন। ৪৪ রানে ৪ উইকেট নিয়ে ৪ রানের জয়ে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। অনেকটা শাসরুদ্ধকর ম্যাচে এবার আর হতাশা নিয়ে যেতে হয়নি। প্রথম ম্যাচ বৃষ্টির কারণে পরিত্যক্ত হওয়ার পর দ্বিতীয় ও শেষ ম্যাচ জিতে ২-০ ব্যবধানে সিরিজ জিতে দেশে ফিরেছে তামিম ইকবালের দল। শেষ ওভাবে তরুন হাসান মাহমুদের ম্যাজিক্যাল বোলিংয়ের কল্যাণে জয় হাতছাড়া হয়নি। আইসিসি ওয়ানডে সুপার লিগের শেষটাও তাই দারুণ হয়েছ চন্ডিকা হাথুরুসিংহের দলের। চমক হিসেবে বোলিংয়ে অনিয়মিত নাজমুল হোসেন শান্তকে এনে যেন বাজি ধরেছিলেন তামিম ইকবাল। আগের ম্যাচের বিধ্বংসী ব্যাটার হ্যারি টেক্টরকে অফ-স্পিনের ভেলকিতে বাউন্ডারিতে ধরাশায়ী করেছেন শান্ত। লিটন দাসের তালুবন্দি হওয়ার আগে টেক্টরের সংগ্রহ ৪৫ রান। এরপর দ্রুত উইকেট হারিয়ে ক্রমাগত হারের দ্বারপ্রান্তে চলে যেতে থাকে আইরিশরা। শেষ দিকে আলো ছড়িয়েছেন সিরিজের প্রথম দুই ওয়ানডের একাদশে জায়গা না পাওয়া মুস্তাফিজুর রহমান। তার ৪ শিকারে টানা দ্বিতীয় সিরিজে জয় পেয়েছে বাংলাদেশ। যদিও আইরিশ ইনিংসের ৩৭তম ওভারটাই বাংলাদেশকে ম্যাচ থেকে ছিটকে দিতে পারত। অভিষিক্ত মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর করা ওই ওভারে আইরিশরা তোলে ২১ রান।
অথচ এর আগে স্বাগতিকদের দরকার ছিল ৭৪ বলে ১০১ রান। সেই ধাক্কা সামলে ব্রেক-থ্রু চাওয়া ছিল টাইগারদের। বোলিংয়ে এসে সেটাই নিশ্চিত করেছেন শান্ত। এরপর মুস্তাফিজ ও হাসানের আগুন ঝরানো বোলিং আইরিশদের কফিনে শেষ পেরেক ঠোকার মতো কাজ করেছে। তখনও নাটকীয়তার কিছুটা বাকি। টাইগারদের কাছ থেকে জয় ছিনিয়ে নেওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছিলেন উইকেটে থাকা মার্ক অ্যাডায়ার ও অ্যান্ডি ম্যাকব্রাইন। তার ওপর বাড়তি পাওনা হিসেবে আসে বাউন্ডারিতে মেহেদী হাসান মিরাজের হাত ফসকানো ক্যাচ। এরপর হাসান মাহমুদ যখন শেষ ওভার করতে আসেন, তখন জয় থেকে মাত্র ১০ রান দূরে আয়ারল্যান্ড। তবে এবার আর স্বপ্নভঙ্গ নয়, সময়ের দাবি পূরণ করেছেন তরুণ এই পেসার। দুর্দান্ত স্লোয়ারে ওভারের প্রথম বলেই হুমকি হয়ে ওঠা অ্যাডায়ারকে বোল্ড করেন তিনি। এরপর তৃতীয় বলে অলরাউন্ডার ম্যাকব্রাইনকে ফাঁদে ফেলে স্লিপারের হাতে ক্যাচ দিতে বাধ্য করেন। সব মিলিয়ে ম্যাচের শেষ ওভারে কেবল ৪ রান তুলতে পারে আইরিশরা। আর এতেই ৪ রানের জয়ে সিরিজ নিশ্চিত করে টাইগাররা।
এর আগে বাংলাদেশের দেওয়া ২৭৫ রানের লক্ষ্যে খেলতে নেমে দেখে-শুনে শুরু করেন দুই আইরিশ ওপেনার স্টার্লিং ও স্টিফেন ডোহেনি। তবে বাংলাদেশি পেসারদের তোপের মুখে খুব বেশি দূর এগোয়নি এই জুটি। ইনিংসের ষষ্ঠ ওভারে আইরিশ শিবিরে প্রথম আঘাত হানেন মুস্তাফিজ। ওভারের দ্বিতীয় বলটি অফ স্টাম্পের বাইরে লেন্থ ডেলিভারিতে করেন এই বাঁহাতি পেসার। সেখানে কাট করতে গিয়ে লিটনের হাতে ধরা পড়েন ডোহেনি। সাজঘরে ফেরার আগে এই ওপেনারের ব্যাট থেকে আসে ১৬ বলে ৪ রান। ডোহেনিকে দ্রুত ফেরালেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশি বোলারদের ওপর চড়াও হতে থাকেন আইরিশ ব্যাটাররা। শুরুতে ধীরগতির ব্যাটিং করলেও উইকেটে থিতু হওয়ার পর খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসেন স্টার্লিং। তিনে নামা অ্যান্ডি বালবার্নিকে সঙ্গে নিয়ে শক্ত ভীত গড়েন এই ওপেনার। তাদের দুর্দান্ত ব্যাটিংয়ে ২১ ওভারে শতরানের মাইলফলক স্পর্শ করে আইরিশরা। এর মধ্যেই ৫৮ বলে হাফ সেঞ্চুরি তুলে নেন স্টার্লিং। এই মাইলফলক ছুঁয়েছেন বালবির্নিও। ফিফটি করতে অধিনায়কের প্রয়োজন হয়েছে ৭১ বল। হাফ সেঞ্চুরির পর আর বেশিক্ষণ টিকতে পারেননি বালবার্নি। ২৭তম ওভারের প্রথম বলটি শর্ট লেন্থে রেখেছিলেন এবাদত, সেখানে ঘুরে দাঁড়িয়ে পুল করেন আইরিশ অধিনায়ক। টাইমিং না হওয়ায় শুধুই উচ্চতা পেয়েছে বল, কিন্তু বেশি দূরত্ব পায়নি।
তাতে রনি তালুকদারের হাতে ধরা পড়েন তিনি। সাজঘরে ফেরার আগে তার ব্যাট থেকে আসে ৭৮ বলে ৫৩ রান। এই অভিজ্ঞ ব্যাটারের উইকেট এমন মুহূর্তে বাংলাদেশের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা স্পষ্ট ছিল টাইগারদের উদযাপনে। বিশেষ করে, এই উইকেটটি ট্রেডমার্ক ‘স্যালুট’ দিয়ে উদযাপন করেন এবাদত। অধিনায়কের পর বাংলাদেশের পথে কাঁটা হয়ে দাঁড়ান স্টার্লিং। উইকেটে থিতু হয়ে যাওয়া এই অভিজ্ঞ ওপেনারকে সাজঘরে ফিরিয়ে বাংলাদেশকে ম্যাচে ফেরান মেহেদি হাসান মিরাজ। ৩২তম ওভারের প্রথম বলে এই স্পিনারের বাড়তি বাউন্সে ঠিকমতো টাইমিং করতে পারেননি স্টার্লিং। তাতে আউটসাইড এইডজে বল চলে যায় মৃত্যুঞ্জয়ের হাতে। ৭৩ বলে ৬০ রান করা স্টার্লিং সাজঘরে ফেরায় ভালোভাবেই ম্যাচে ফেরে বাংলাদেশ। এরপর অবশ্য আতঙ্ক ছড়িয়েছেন দুই আইরিশ ব্যাটার টেক্টর ও লরকান টাকার। আগের ম্যাচের সেঞ্চুরিয়ান টেক্টর ৪৮ বলে ৪৫ এবং টাকার করেন ৫৩ বলে ৫০ রান। এছাড়া টাইগারদের ব্যাটিংয়ে সর্বোচ্চ ৪ উইকেট পাওয়া অ্যাডায়ার শেষদিকে করেন ১০ বলে ২০ রান। বাংলাদেশের হয়ে সর্বোচ্চ ৪ উইকেট পান মুস্তাফিজ। এছাড়া হাসান দুটিটি এবং একটি করে উইকেট নিয়েছেন মিরাজ, এবাদত ও শান্ত। এদিন ইনজুরিতে ছিটকে যাওয়া সাকিব আল হাসানকে ছাড়াই খেলতে নামে বাংলাদেশ। টস হেরে ব্যাটিং করতে নেমে শুরুটা ভালো হয়নি বাংলাদেশের।
প্রথম দুই ওয়ানডেতে ছিলেন না। মুস্তাফিজুর রহমান তৃতীয় ও শেষ ওয়ানডেতে দলে ফিরেই দেখালেন ঝলক। শুধু দুর্দান্ত বোলিং করাই নয়, আইরিশদের বিপক্ষে রুদ্ধশ্বাস সিরিজ জয়ের ম্যাচে সেরা হয়েছেন কাটার মাস্টার। তিন ম্যাচের সিরিজে ১৯৬ রানের সঙ্গে বল হাতে একটি উইকেট নিয়ে সিরিজসেরা হয়েছেন নাজমুল হোসেন শান্ত। প্রথম ওয়ানডেতে ৪৪ রানের পর দ্বিতীয়টিতে ক্যারিয়ারের প্রথম সেঞ্চুরি করেন শান্ত। খেলেন ১১৭ রানের ইনিংস। তৃতীয় ওয়ানডেতে ব্যাট হাতে শুরুটা করেছিলেন দারুণ। তবে ৩২ বলে ৭ বাউন্ডারিতে ৩৫ করে থামতে হয় শান্তকে। কিন্তু শান্ত যেন থামার মানুষ নন। দুর্দান্ত কিছু ফিল্ডিংয়ের সঙ্গে বল হাতেও ঝলক দেখান শেষ ম্যাচে এসে। ম্যাচে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে ব্রেক থ্রো দেওয়া শান্ত ৩ ওভারে মাত্র ১০ রান দিয়ে নেন একটি উইকেট। অন্যদিকে মুস্তাফিজ এই ম্যাচে ছিলেন দুর্দান্ত। ১০ ওভারে একটি মেইডেনসহ ৪৪ রান দিয়ে ৪টি উইকেট শিকার করেন কাটার মাস্টার। শেষের দিকে এসে টানা তিন ওভারে নেন তিনটি উইকেট। আইরিশদের ইনিংসে প্রথম আঘাতও হেনেছিলেন তিনি। সবমিলিয়ে ম্যাচসেরার পুরস্কার ফিজের হাতে।
দেশকণ্ঠ/আসো