মোয়াজ্জেম হোসেন রাসেল : আফগানিস্তানের বিপক্ষে তিন ম্যাচ সিরিজের প্রথম ম্যাচের আগেই তামিম ইকবালের খেলা নিয়ে তৈরি হয় ধুম্রজাল। পুরোপুরি ফিট না থাকায় তার খেলার পক্ষে বিপক্ষে শোনা যায় অনেক কথা। তবে সবচেয়ে বেশি প্রতিক্রিয়া দেখান বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন ও জাতীয় দলের প্রধান কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে। সেই যে ঝামেলার শুরু, ২৪ ঘন্টা না পেরুতেই সংবাদ সম্মেলন ডেকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় বলে দিলেন তামিম। এরপর বিসিবি থেকে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন ক্রিকেট অপারেশন্স কমিটির চেয়ারম্যান তামিম ইকবাল। ক্রিকেট বোর্ড থেকে না কি কোনভাবেই তামিমের সাথে যোগাযোগও করা যাচ্ছেনা। এর আগে ২০২২ সালের ১৬ জুলাই আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি থেকে অবসরের ঘোষণা দিয়েছিলেন এই বাহাতি ওপেনার। নানামুখী আলোচনার পর এসেছিল ওইরকম সিদ্ধান্ত। বিদায় বেলায় কাঁদতে কাঁদতে তামিম অনেক কথাই বললেন। জনাকীর্ন সংবাত সম্মেলনে তাঁর অপেক্ষায় ছিলেন সবাই। বুধবার দুপুর দেড়টা বাজার আগেই চট্টগ্রামের জুবলি রোডে হোটেল টাওয়ার ইনে মাথায় কালো টুপি, পরনে কালো টি-শার্ট পরে এলেন। এসেই জানিয়ে দিলেন, আন্তর্জাতিক ক্রিকেট তিনি আর খেলবেন না। এরপর একপর্যায়ে তিনি কেঁদেই দিলেন।
কান্না করতে করতে কথাই বলতে পারছিলেন বাংলাদেশ ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা ওপেনার। মাত্রই ‘সাবেক’ হয়ে যাওয়া বাংলাদেশ ওয়ানডে অধিনায়কের সংবাদ সম্মেলনের পুরোটাই থাকল এখানে, এ রকম একটা অবস্থায় মানুষ বক্তব্য লিখে আসে। আমি আসলে প্রস্তুত না। আফগানিস্তানের বিপক্ষে মঙ্গলবারের ম্যাচটায় আমার আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচ। আমি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর নিচ্ছি। এটার পেছনে কোনো সাডেন (আকস্মিক) সিদ্ধান্ত ছিল না। আমি এ বিষয়ে ভাবছিলাম। এটার ভিন্ন ভিন্ন কারণ আছে। আমি মনে করি, আমার এখানে এটা বলার আছে। এটা না যে, হুট করে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এটা নিয়ে আমি কয়েক দিন ধরে কথা বলছিলাম। এমনকি আমার পরিবারের সঙ্গেও কথা বলছিলাম। আমি মনে করি, আমার জন্য এটাই সঠিক সময়। আমি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর নিচ্ছি। আমি লোকজনদের ধন্যবাদ জানাই। যেটা আমার কাছে মনে হয়, এটা তাদের প্রাপ্য। আমি সব সময় একটা কথা বলছি যে, আমি খেলেছি (কান্নায় ভেঙে পড়েন কিছুক্ষণ পর পানি খান), আমি সব সময় বলছি যে, আমি ক্রিকেট খেলি আমার বাবার স্বপ্নপূরণ করার জন্য। আমি জানি না, ১৬ বছরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে আমি কতটুকু কী করেছি...। সবাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ।
এরপরই চারিদিকে শুরু হয় নানা কথা। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের ১৬ বছরের দীর্ঘ ক্যারিয়ারের জন্য তামিম ধন্যবাদ দিয়েছেন সতীর্থ, কোচ, বিসিবি, পরিবার ও সমর্থকদের, ‘ক্যারিয়ারের এই দীর্ঘ পথচলায় আমার সব সতীর্থ, সব কোচ, বিসিবির কর্মকর্তাগণ, আমার পরিবার ও যারা আমার পাশে ছিলেন, নানাভাবে সহায়তা করেছেন, ভরসা রেখেছেন এবং আমার ভক্ত-সমর্থক, বাংলাদেশ ক্রিকেটের অনুসারী, সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। আপনাদের সবার অবদান ও ভালোবাসায় আমি চেষ্টা করেছি সব সময় দেশের জন্য নিজের সবটুকু উজাড় করে দিতে।’ আফগানদের বিপক্ষে প্রথম ওয়ানডের আগে সংবাদ সম্মেলনে তামিম জানিয়ে দেন শতভাগ ফিট না হলেও প্রথম ওয়ানডে খেলবেন তিনি। শেষমেশ খেলেছেনও। তামিমের এমন সিদ্ধান্তে কিছুটা রাগান্বিত হন বোর্ড সভাপতি। দেশের একটি দৈনিককে তিনি বলছিলেন, ’এটি তো আর পাড়া-মহল্লার কোনো ম্যাচ নয়, আন্তর্জাতিক একটা ম্যাচ। এমন সিরিজের আগের দিন অধিনায়ক বলছে সে ফিট না। কিন্তু খেলবে। খেলে নিজের ফিটনেস বোঝার চেষ্টা করবে। এটা তো পেশাদার কোনো আচরণ হতে পারে না। বিসিবি সভাপতির এমন মন্তব্যের পরপরই মূলত অবসরের ঘোষণাটা দিলেন তামিম।
হঠাৎ সংবাদ সম্মেলন করে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসরের ঘোষণা দেবেন, সেটি ভাবতে পারেনি বিসিবি। বিশ্বকাপ ও এশিয়া কাপের মাত্র দুই-তিন মাস আগে অধিনায়কের অবসরের সিদ্ধান্ত বড় ধাক্কাই হয়ে এসেছে বিসিবির কাছে। বিসিবির ক্রিকেট অপারেশন্স বিভাগের প্রধান জালাল ইউনুস বলেন, ‘আমরা বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করছি। এরপর সংবাদ সম্মেলন করে জানাব। তবে এটা অপ্রত্যাশিতই...।’ বিসিবির এক নির্বাচক মনে করিয়ে দিলেন, গত বছরও একইভাবে আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট থেকে অবসর নিয়েছিলেন তামিম। তাঁর মতে, এটা একেবারেই ইমোশনাল হয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তামিম। তামিমের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ছেড়ে দেওয়ায় বিসিবিকে একই সঙ্গে দুটি বিষয় নিয়ে ভাবতে হচ্ছে। খুব দ্রুত সময়ে একজন অধিনায়ক খুঁজতে হবে। একই সঙ্গে বড় দুটি টুর্নামেন্টের আগে একজন অভিজ্ঞ ওপেনারকে হারিয়ে ফেলাটাও অনেক বড় ধাক্কা হয়ে এসেছে বাংলাদেশ দলের জন্য। ২৪১ ম্যাচের ওয়ানডে ক্যারিয়ারে ৩৬.৬২ গড়ে ৮৩১৩ রান করেছেন তামিম। সেঞ্চুরি ১৪টি ও ফিফটি ৫৬টি। টেস্টে ৭০ ম্যাচে ৩৮.৮৯ গড়ে ৫১৩৪ রান করেছেন তামিম। সেঞ্চুরি ১০টি ও ফিফটি ৩১টি। এই সংস্করণে বাংলাদেশের হয়ে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান ও সেঞ্চুরি করেছেন তামিম। টি-টোয়েন্টিতে ৭৪ ম্যাচে ১৭০১ রান করেছেন তামিম। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ২৫ সেঞ্চুরি করা তামিম তিন সংস্করণ মিলিয়ে ১৫ হাজারের বেশি রান করেছেন। দেশের আর কোনো ক্রিকেটার আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এত রান করতে পারেননি।
পথরেখা/আসো