এস এম শাহীনুজ্জামান, পথরেখা অনলাইন : আমি একেবারেই একজন সাধারণ নাগরিক, ক্ষুদ্র শিল্প উদ্যোক্তা ও সমাজকর্মী, সামাজিক কাজ করতে গিয়ে প্রতিনিয়তই সাধারণ মানুষের বিভিন্ন ধরনের প্রশ্নের সম্মুখিন হয়েছি, দেখছি দেশের সাধারণ মানুষের অসম্ভব রকমের রাজনীতি সচেতনতার অনুভুতি। প্রায়শই তারা প্রশ্ন করেন- কেন বার বার বাংলাদেশে শাসক শ্রেণী একনায়ক হয়ে ওঠে? কোথায় শাসনতন্ত্রের ত্রুটি ও বিচ্যুতি? কেন আমরা বিগত ৫৩ বছরেও এই ত্রুটি সারাতে পারি না? এই প্রশ্নের উত্তর খুজতে গিয়ে দেখলাম সাবেক পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ এই পর্যন্ত ছোট এবং বড় মিলিয়ে মোট ৬টি গনঅভ্যুত্থান সংঘঠিত হয়েছে। তার মধ্যে ১৯৫২ ও ১৯৬৯ সালের অভ্যুত্থান পাকিস্তানি শাসনে বাকী ৪টি সংঘঠিত হয়েছে ১৯৯০, ১৯৯৬, ২০০৬ এবং ২০২৪ সালে বাংলাদেশের শাসনে। এর মধ্যে আবার ৩টি ১৯৯৬, ২০০৬ এবং ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান হয়েছে, প্রথমে গণতান্ত্রিক ভাবে মানুষের ভোটে নির্বাচিত হয়ে সরকারে এসে অগণতান্ত্রিক, একনায়কতন্ত্র বা ফ্যাসিবাদের চরিত্র ধারন করার পর মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন, সংগ্রামের মাধ্যমে মানুষের ভোটে নির্বাচিত সরকারের বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থান।
বারবার আন্দোলন, রক্তক্ষয়, রক্তাক্ত ইতিহাস চরিত হওয়ার পরও রাজনৈতিক দল সমুহের স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠার পেছনে আমার মনে হয়েছে ত্রুটিপূর্ণ সাংবিধানিক কাঠামো অনেকাংশে দায়ী, বিষয়টা অনেকটা এরকম যে- রোগ নির্ণয় না করে বরং বার বার সাময়িক চিকিৎসা পত্র দিয়ে রোগ প্রসমনের চেষ্ঠা করা হয়েছে মাত্র।
প্রাসঙ্গিকভাবে আমরা যদি দেখি যে ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসনকালে তিন জোটের রুপরেখা বাস্তবায়ন কওে তৎকালীন সময়ের জনগনের কাংক্ষিত সংস্কার করে ১৯৯১ সালের নির্বাচনটি করতে পারতাম তাহলে ১৯৯৫-১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্যে আর সংগ্রাম করতে হতো না এবং বাংলাদেশের মানুষকে একটি দীর্ঘ আন্দোলন, সহিংসতা ও আত্মহানির মধ্যে দিয়ে যেতে হতো না বা একটি গনঅভ্যুত্থানের প্রয়োজন পরতো না। ১৯৯৬ সালে তৎকালীনর বিএনপি সরকার একটি ভোট বিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে সংসদ গঠন করে গণরোষের কবলে পড়ে রাতারাতি একটি ত্রুটিপূর্ণ তত্ত্বাবধায়ক নির্বাচনী সরকার ব্যবস্থার প্রবর্তন করে, স্বল্প সময়ের জন্যে কার্যকর হলেও অচিরেই এই ব্যবস্থার ত্রুটি স্পষ্ট হয়ে উঠলো ফলশ্রুতিতে আবারো ২০০৬ সালে সেই হানাহানি, আন্দোলন, সহিংসতা এর ফলশ্রুতিতে গণঅভ্যুত্থানের দ্বারপ্রান্তে সেনাসমর্থিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থাটি ২ বছর স্থায়ী ছিলো, জনসাধারণের ধারনা ছিলো এইবার সঠিক ডায়াগনসিস করে রোগ নির্ণয় করার পর চিকিৎসা দেওয়া হবে এবং পর্যাপ্ত সময়ও হাতে পাওয়া গিয়েছিল। কার্যত এই শাসনে কিছু সংস্কার হলেও বাস্তবে ত্রুটি রয়েই গেল, ফলশ্রুতিতে পরবর্তী নির্বাচনে ২০০৮ সালে ব্যপক সংখ্যাগরিষ্ট আসনে জনগণের ভোটে নির্বাচিত আওয়ামী লীগ সরকার অন্তর্বতীকালীন সরকারের নেওয়া সমস্ত সংস্কার দুমড়ে-মুচড়ে এমন একটি একনায়কতান্ত্রিক, একপেশে ব্যবস্থা কায়েম করলেন যে, পেশাজীবি, বুদ্ধিজীবি, সাংবাদিক, ব্যবসায়িক, আমলা সহ সকল স্তরে পদলেহনকারী একটি বিশাল স্থাবকগোষ্ঠিই শুধু তৈরি করেনি নির্বাচনেরও একটি নিউ বাকশালীজনের মাধ্যমে একছত্র ফ্যাসিজম কায়েম করতে সমর্থ হয়। যার ফলাফল ১৫ বছর ধরে গণতন্ত্রহীনতা, মানুষের বাকস্বাধীনতার হস্তক্ষেপ এবং মাফিয়াতন্ত্রের মধ্য দিয়ে মানুষের নাভিশ্বাস অবস্থার তৈরি। আবারও আন্দোলন, রক্তক্ষয়, প্রাণহানী, এইবারতো সমস্ত রেকর্ড ছাড়িয়ে এক অদ্ভুত মৃত্যু উপাত্যকারীর সাথে পরিচয় হল বাংলাদেশের মানুষের।
আবারও ছাত্র জনতার অভ্যুত্থান এবং হাজারো শহিদের রক্তের উপর প্রতিষ্ঠিত হলো অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ব্যবস্থা। প্রশ্ন হলো আমরা কি আবারও সেই ওষুধ দিয়ে রোগের উপশম করবো নাকি রোগের সঠিক কারণ খুঁজে রোগ নিরাময় করে পুরো শরীরকে রোগমুক্ত করে তুলব? যদি সত্যিকার অর্থে একটি গণতান্ত্রিক, সুশাসন ভিত্তিক জবাবদিহিতামূলক বাংলাদেশ গড়ে তুলতে চাই তাহলে আমি সহ আমার মত হাজারো, লক্ষ আমজনতা মনে করে রাষ্ট্রের মেরামত করে একটি প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা দাড় করাতে হবে। যাতে করে, আর কোনদিনও স্বৈরাতন্ত্র ফেরত না আসে। একে একে যদি বলি তাহলে প্রথমত আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনার সংস্কার, সুষ্ঠু নিয়োগ পদ্ধতি, ট্রেনিং এবং জবাবদিহিতার সুষ্পষ্ট ব্যবস্থা করতে হবে। একটি মাত্র পরিক্ষা শ্রেণীর মধ্য দিয়ে তৈরি আমলাতন্ত্র পেশাদায়িত্বে এবং নৈতিকতায় শক্তিশালী না হওয়ায় এটি মেধাবী, কোটারী ও দুর্নীতির হাটে পরিনত হয়েছে। যার ফলে ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার আরও অনেক বিশেষায়ীত বিষয়ের শিক্ষার্থীরা ঝাপিয়ে পড়ছে আমলাতন্ত্রের নিয়োগ পরিক্ষায় মনে হয় এটা যেন একটা মধুশালা। বিদ্যমান এই ব্যবস্থার পরিবর্তে সরকার একটি বিশেষায়ীত বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করতে পাওে, কিছুটা ক্যাডেট কলেজ গুলোর অনুরুপ মেধাবী শিক্ষার্থীরা উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে তিন স্তরের পরিক্ষা প্রক্রিয়া মধ্য দিয়ে নির্বাচিত হয়ে ৬ বছর ধরে প্রশাসন, পুলিশ, কাষ্টমস সহ সব স্ব স্ব ক্যাডারে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ করে সরাসরি এন্ট্রি পরিক্ষার মাধ্যমে চাকরীতে প্রবেশ করতে পারে এবং এই ৬ বছর ব্যাপী স্নাতক, স্নাতকোত্তর কোর্স চলাকালীন তাদের সম্পূর্ণ ট্রেনিং প্রক্রিয়া হবে প্রো-পিপল এবং চাকুরীতে প্রবেশের প্রথম দিনেই তার এবং তার পরিবারের সকল সদস্যদের সম্পদের হিসাব প্রকাশ করতে হবে। প্রতি বছর এক বা একাধিক স্বতন্ত্র সংস্থার মাধ্যমে নিরিক্ষন এবং তদন্তশেষে তার বিবরনী প্রকাশ করতে হবে। জনসাধারণ মনে করে এভাবে যদি আমলাতন্ত্রকে একটি জনসহায়ক প্রতিষ্ঠানে পরিনত করা যায় তাহলে রাজনৈতিক দল সমুহের স্বৈরাতন্ত্রী হয়ে ওঠার পথে আমলাতন্ত্র হবে প্রথম বাধা।
দ্বিতীয়ত হল সাংবাধানিক সংস্কার : বর্তমান এক কক্ষ বিশিষ্ট সংসদীয় ব্যবস্থা ভেঙ্গে দিয়ে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইন সভার প্রবর্তন করতে হবে। যার নিন্ম কক্ষ হবে সরাসরি জনগণের ভোটে নির্বাচিত, উচ্চ কক্ষের অর্ধেক আসন নির্বাচিত হবে নিন্ম কক্ষের নির্বাচিত সাংসদ ও স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধি বৃন্দ দ্বারা, বাকি অর্ধেক নির্বাচিত হবে নিন্ম কক্ষের নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দল সমুহের প্রাপ্ত ভোটের আনুপাতিক হারের উপর ভিত্তি করে। (আসন সংখ্যা নির্ধারন বিভিন্ন রাজনৈতিক দল সমূহের সংগে আলোচনার ভিত্তিতে করা যেতে পারে।) সংসদের দুই কক্ষেই একজন স্পীকার ও ২ জন ডেপুটি স্পীকার নির্বাচন করা হবে এবং একজন ডেপুটি স্পীকার সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী বিরোধী দল সমূহ থেকে নির্বাচিত হতে হবে। ক্ষমতা কাঠামোয় সাংসদদের শুধুমাত্র আইন তৈরি ছাড়া অন্যান্য সকল প্রকার বরাদ্ধ ও আর্থিক ক্ষমতা রদ করতে হবে এবং সকল প্রকার ভিআইপি সুবিধা তথা শুল্কমুক্ত গাড়ী প্লট ইত্যাদি বাতিল করে একটি আকর্ষনীয় বেতন কাঠামো করা যেতে পারে।
তৃতীয়ত : সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানসমূহ যেমন-
১। নির্বাচন কমিশন
২। উচ্চ আদালত
৩। স্বাধীন ন্যয়পাল
৪। দুর্নীতি প্রতিরোধ প্রতিষ্ঠান।
এই চারটি প্রতিষ্ঠানের নিয়োগের ক্ষেত্রে সরকারী ও বিরোধী দল সমুহের প্রতিনিধি থাকা অত্যাবশ্যক হতে হবে। যেমন-
১। নির্বাচন কমিশন : নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলীয় নেতা, সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি, সংসদের উভয় কক্ষের স্পীকার ও ডেপুটি স্পীকার বৃন্দ এবং নাগরিক সমাজের একজন প্রতিনিধি থাকতে পারে যিনি রাষ্ট্রপতি কর্তৃক মনোনিত হবেন।
২। উচ্চ আদালত : উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগের জন্য কমিটি হবে প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলের নেতা, সংসদের উভয় কক্ষের স্পীকার ও ডেপুটি স্পীকার বৃন্দ এবং রাষ্ট্রপতির মনোনিত একজন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধির মাধ্যমে। এখানে আইন মন্ত্রনালয়ের মন্ত্রি মহোদয়কে কমিটির সচিব হিসাবে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে।
৩। স্বাধীন ন্যায়পাল : এই পদের জন্য নিয়োগের ক্ষেত্রেও অনুরুপ প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলের নেতা, সংসদের উভয় কক্ষের স্পীকার ও ডেপুটি স্পীকার বৃন্দ, সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এবং রাষ্ট্রপতির মনোনিত একজন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি থাকতে পারে।
৪। দুর্নীতি প্রতিরোধ প্রতিষ্ঠান : এই প্রতিষ্ঠানের সকল উচ্চপদ অর্থাৎ চেয়ারম্যান, বোর্ডের সদস্যগণ প্রত্যেকেই আলাদা আলাদা ভাবে একটি বাছাই কমিটির মাধ্যমে নিয়োগ পাবেন। এখানেও প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলের নেতা, সংসদের উভয় কক্ষের স্পীকার ও ডেপুটি স্পীকার বৃন্দ, সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এবং রাষ্ট্রপতির মনোনিত একজন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি থাকবেন।
চতুর্থত : দেশের একজন রাষ্ট্রপতি ও একজন উপরাষ্ট্রপতি থাকবেন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান গুলোর উপর নজরদারী ও দেখভালের জন্যে। রাষ্ট্রপতি ও উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হবেন সংসদ সদস্য ও স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রত্যক্ষ ভোটে। রাজনৈতিক দলসমূহ রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রার্থী মনোনীত করতে পারবেন না কিন্তু তাদের নিজ নিজ দলের সমর্থন জ্ঞাপন করতে পারেন। সাংবিধানিক সকল প্রতিষ্ঠানের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করবেন রাষ্ট্রপতি ও উপরাষ্টপতি। এখানে প্রধানমন্ত্রীর কোন নির্বাহী ক্ষমতা থাকবেনা।
শত শহীদের রক্তে রঞ্জিত এই নতুন মুক্তির আলোর স্ফুরণ ঘটিয়ে যদি একটি উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মাণ করতে চাই তাহলে আবারো সুযোগ এসেছে, সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এই সাহসী মানুষগুলো নিশ্চয়ই মৌলিক এই পরিবর্তনের মাধ্যমে বাংলাদেশের নতুন যুগের সুচনা করবে। আর অনাদী কালের মানুষ যুগ যুগ ধরে স্মরণ করবে একদা একটি সাহসী প্রজন্মের আগমন হয়েছিল বাংলাদেশে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের পর।
লেখক- শিল্প উদ্যোক্তা ও সমাজকর্মী।
পথরেখা/এআর