স্কুলের এক বন্ধুর বাসায় দাওয়াতে গিয়েছিলাম। তার বাড়ির কাছেই আমার স্কুল শিক্ষক সুখ রঞ্জন দত্ত স্যারের বাড়ি। আমি যখন স্যারের বাড়িতে যাই, তখন তিনি খালি গায়ে বসে ভাত খাচ্ছেন। আমি স্যার বলে ডাকতেই উনি আমার নাম ধরে বললেন- ভেতরে আয়। হাতে ভাত নিয়েই বেরিয়ে এলেন । পা ছুঁয়ে সালাম করতেই বুকে জড়িয়ে নিলেন। এসএসসি পাশের পরে স্যারের সাথে আমার দেখা হয়নি। তখন মোবাইলের যুগ ছিলো না বলে কোনদিন ফোনেও কথা হয়নি। প্রায় দুই যুগ পরে কিভাবে আমার কন্ঠ উনি চিনলেন সেটাই আজও উদ্ধার করতে পারিনি। সেদিন যেই স্যারকে আমি দেখেছি, তার সাথে আমার স্কুল জীবনের তেজদীপ্ত সুখ রঞ্জন দত্ত স্যারের মিল নেই। একদিন উনার গণপিটুনিতে আমার হাত ফুলে গিয়েছিলো। বাসায় গিয়ে জ্বর চলে এলো। বাবা অফিস থেকে এসে শুনলেন স্যারের হাতে মার খেয়েছি। উত্তরে বাবা বললেন- নিশ্চয়ই কোন অপরাধ করেছো। খুব অভিমান হয়েছিলো সেদিন। রাতে ঘুম থেকে উঠে দেখি স্যার আমার পাশে বসে আছে। আমি ব্যাথা পেয়েছি কিনা জিজ্ঞেস না করে উল্টো হুংকার ছাড়লেন- পড়া ফাঁকি দিতেই নাকি ঘুমিয়ে পড়েছি। সাথে সাবধান করে দিয়ে গেলেন- পরের দিন যাতে পিঠে কিছু বেধে নিয়ে যাই! পরে শুনেছি- ঔষধ নিয়ে এসেছিলেন তিনি।
আরও একটা ঘটনা বলি। মাঠে ক্রিকেট খেলছি। সেদিন তুমুল ব্যাটিং করছি আমি। বাবা সরাসরি মাঠে ঢুকে বন্ধুদের সামনে সপাটে গালে চড় বসিয়ে দিলেন। অপরাধ- দীপক স্যার আমার জন্য বাসায় অপেক্ষা করছে আর আমি মাঠে খেলছি। অথচ আমি জানতাম না সেদিন স্যার বাসায় আসবেন।
এই হলো আজ থেকে ২ যুগ আগের ছাত্র শিক্ষকের সম্পর্ক আর শিক্ষক সম্পর্কে অভিভাবকের মূল্যায়ন। আর আজ একজন স্কুল পড়ুয়া ছাত্র তার শিক্ষকের গায়ে হাত তুলতে দ্বিতীয়বার ভাবে না। একে কি বলবেন? চুয়াডাঙ্গা ভিক্টোরিয়া জুবিলি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে গতকাল (৮ অক্টোবর) ঘটে যাওয়া ঘটনায় দায়ী কে? শিক্ষার্থী? না। দায়ী আমাদের পরিবার আর তথাকথিত বড়ভাইরা। কারণ ওরা জানে, শিক্ষকদের কানে ধরিয়ে উঠবস করানো যায়, অন্য ধর্মের হলে ধর্ম অবমাননার মিথ্যা অভিযোগে ফাঁসানো যায়, জুতার মালা গলায় পড়ানো যায়, জেলে পুরে দেয়া যায়। অনেক সময় অভিভাবক নিজেই যান স্কুলে শিক্ষককে অপদস্ত করতে- কেন তার আদরের সন্তানকে শাসন করা হলো কিংবা গায়ে হাত তোলা হলো? এই সন্তান কি শিখবে তার বাবার কাছ থেকে? নকল করতে বাধা দিলে পুরো এলাকাবাসীর একজোট হয়ে প্রতিবাদ করার নজীরও আছে আমাদের সমাজে।
জানা গেছে, চুয়াডাঙ্গা ভিক্টোরিয়া জুবিলি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের এসএসসি পরীক্ষার্থীদের নির্বাচনী পরীক্ষা চলছিল। পরীক্ষার হলে দায়িত্বরত ছিলেন দিবা শিফটের বাংলার সহকারী শিক্ষক হাফিজুর রহমান। রোববার সকাল ১০টায় হিসাব বিজ্ঞান পরীক্ষা শুরু হয়। পরীক্ষা শুরুর ১ ঘণ্টা ১১ মিনিটের সময় পরীক্ষার্থী সাইফুল আমিন অন্যের উত্তরপত্র দেখে লিখছিল। প্রথমে তাকে নির্ধারিত আসন থেকে সরিয়ে সামনের বেঞ্চে বসানো হয়। এরপরও সে পেছনে ঘুরে অন্যের উত্তরপত্র দেখে লিখছিলো। এছাড়াও পেছনের শিক্ষার্থীকে বিরক্ত করছিল। বিষয়টি দেখে দায়িত্বরত শিক্ষক সাইফুলের খাতা নিয়ে টেবিলের ওপর রাখেন। এরপর দুই জনের মধ্যে কিছুটা কথা কাটাকাটি হয়। শিক্ষক ওই ছাত্রকে বেঞ্চে বসার জন্য বললে সে কয়েক মিনিট তার নির্ধারিত আসনে বসে থাকে। এরপর বেঞ্চ থেকে উঠে এসে শিক্ষকের গালে চড় মেরে বাইরে চলে যায়। ভাগ্যিস ক্লাস রুমে সিসি ক্যামেরা ছিলো। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সারা দেশবাসী দেখেছে। নইলে এটা হয়তো অন্য কোন ইস্যুতে চাপা পড়ে যেতো।
সেই পরীক্ষার্থী সাইফুল আমিন স্কুল থেকে বেড়িয়েছে তার মোটর সাইকেলে করে। স্কুলের গণ্ডী না পেরুনো একজন কিভাবে মোটরসাইকেল নিয়ে স্কুলে আসে সেটাও দেখার বিষয়। কিভাবে একজন স্কুল পড়ুয়ার হাতে তার অভিভাভক মোট্রসাইকেলের চাবি তুলে দেন, যার লাইসেন্স থাকার কথা না।
তদন্তে ৪ সদস্যের কমিটি গঠন করেছেন জেলা প্রশাসক। তদন্ত কমিটির প্রধান করা হয়েছে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) শারমিন আক্তারকে। তিন কার্য দিবসের মধ্যে কমিটি প্রতিবেদন দাখিল করবেন তিনি। কিন্তু ফিরিয়ে দেয়া যাবে না যে সম্মান তিনি হারিয়েছেন ক্লাস রুমে। সহকারী শিক্ষক হাফিজুর রহমান, আপনার কাছে আমরা লজ্জিত। এ দায় আমাদের সমাজের, অভিভাবকদের। এ ঘটনার সুষ্ঠ বিচারে এতটুকু অন্তত যদি আমাদের লজ্জা হয়, সেটাই হবে প্রাপ্তি। সমাজে খুব জরুরী হয়ে পড়েছে আমাদের নৈতিক শিক্ষা। নইলে এই অবক্ষয় থেকে রেহাই নেই।
mrinalbanday@gmail.com
পথরেখা/আসো