স্বৈরশাসক এরশাদ বিরোধী গণআন্দোলন তখন তুঙ্গে। স্বৈরাচারী এরশাদের পতনের একদফা দাবিতে ৮দল, ৭দল ও ৫দলীয় জোটের যুগপৎ আন্দোলন চলছে। সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রামে পরিষদের কর্মসূচি প্রতিদিন আছে। সংগ্রামে পরিষদের আহ্বানে বেশ কয়েকদিন ধরেই ছাত্র ধর্মঘট চলছে। সাধারণ মানুষ রাজপথে নেমেছে একই দাবিতে। সবার মুখে একই স্লোগান একদফা একদাবি, এরশাদ তুই কবে যাবি, স্বৈরাচারি এরশাদ, এই মুহূর্তে গদি ছাড়, ছাত্র-শিক্ষক-জনতা, গড়ে তোল একতা। শিল্পী, সাহিত্যিক, কবি, বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী, শ্রমিক, কৃষক, শ্রমজীবী জনতা সবাই এক কাতারে। সবাই শহীদ নুর হোসেনের উত্তরসূরী, স্বৈরাচারের পতন আর গণতন্ত্রের মুক্তির দাবিতে সোচ্চার!
২৭ নভেম্বর সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে ছাত্র ধর্মঘট ছিল। আমি তখন সরকারি জগন্নাথ কলেজে স্নাতক প্রথম বর্ষের ছাত্র। ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী। সকালে কলেজের মূল ফটকে তালা দেয়া হলো আর হাতে লেখা পোস্টার সাটানো হলো, যেখানে লেখা ছিল এরশাদের পতনের দাবিতে আজ ছাত্র ধর্মঘট। আগেই নির্দেশ ছিল সকাল ১০টার মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে উপস্থিত থাকার। সে অনুযায়ী আমরা দুই বন্ধু (আমি ও ওলিউর রহমান খোকন) রওনা হলাম। হাইকোর্ট ও কার্জন হলের মাঝের রাস্তায় পুলিশ ব্যারিকেড দিয়েছে। কাউকে ঢুকতে দিচ্ছেনা। শাহবাগ দিয়ে ঢুকবো এই সিদ্ধান্ত নিয়ে দু’জনে সেখানে পৌঁছালাম। বিধি বাম! সেখানেও পুলিশ কাঁটাতারের বেড়া দিয়েছে। আসলে তারা সবদিক দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকার রাস্তা বন্ধ করেছে। শাহবাগে আরো কয়েকজন সহযোদ্ধার সাথে দেখা হলো। আলোচনা অনুযায়ী সবাই মিলে আজিজ মার্কেটের উল্টোদিকে বঙ্গবন্ধু হলের দেয়াল টপকে সূর্যসেন হল হয়ে রেজিস্টার বিল্ডিংয়ের পাশ দিয়ে মুধুর ক্যান্টিনে গেলাম। তখন বেলা ১১:৩০টা। সেখানে থমথমে পরিবেশ। শুনলাম, এরশাদের সন্ত্রাসীদের গুলিতে টিএসসিতে জাসদ নেতা, বিএমএ-এর যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ডা. মিলন নিহত হয়েছেন। আরো জানলাম ছাত্র দল নেতা নিরু-অভি এরশাদের পক্ষ নিয়েছে (আগে থেকেই গুজব ছিল) এবং তারা সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের কর্মীদের উপর হামলা করেছে। দুই পক্ষের মধ্যে ধাওয়া, পাল্টা ধাওয়া, গুলিবর্ষণ হয়েছে। সাধারণ ছাত্রদের প্রতিরোধের মুখে স্বৈরাচারের দালালগোষ্ঠী পিছু হটছে। অনেকে গুলিবিদ্ধ। ক্যাম্পাসের ভেতরে খন্ড খন্ড মিছিল হচ্ছে। দেখা হলো সহযোদ্ধা বন্ধু মাসুদ (রহমান মুস্তাফিজ), সত্যজিৎ, অপু, ছাত্র ইউনিয়ন নেতা শহিদুল ইসলাম লিটন, পথিক সাহা, মোজাম্মেল হক পাটোয়ারি, শ্যামল হালদারসহ অনেকের সাথে। আমরাও যোগ দিলাম মিছিলে। এর মধ্যেই খবর এলো সরকারি দলের ভাড়া করা বাহিনী বাংলা একাডেমি পর্যন্ত সরে গেছে। টিএসসি এলাকা এখন মুক্ত। গেলাম টিএসসিতে। মিলন ভাইয়ের শহিদ হওয়ার স্থান ঘিরে রাখা হয়েছে। রাস্তায় জমাট রক্ত!
দুপুর ১২:৩০টা-১টা, দুই পক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, ককটেল বিস্ফোরণ, মাঝে মাঝে গুলির আওয়াজও পাওয়া যাচ্ছে। দুর থেকে দেখছি বাংলা একাডেমির সামনে রাস্তায় ড্রাম ফেলে ছাত্ররা ব্যারিকেড দিয়েছে। কেউ কেউ আহত হয়ে টিএসসিতে ফিরছে। টিএসসির পশ্চিম পাশের যাত্রী ছাউনিতে প্রাথমিক চিকিৎসা কেন্দ্র বসানো হয়েছে। ঢাকা মেডিক্যালের ছাত্র-কর্মীরা সেখানে আহতদের চিকিৎসা দিচ্ছে। ছাত্রদের পাশাপাশি রোকেয়া ও শামসুন্নাহার হলের ছাত্রী কর্মীরা খাটের স্ট্যান্ড, বাঁশের লাঠি হাতে রাস্তায় অবস্থান নিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মচারিরাও রাজপথে ছিলেন সেদিন। মিছিলে মুখরিত ক্যাম্পাস। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে খবর এলো এরশাদের পেটোয়া বাহিনী ছাত্র-জনতার প্রতিরোধের মুখে শহীদুল্লাহ হলের পাশ দিয়ে চানখারপুল-নিমতলী দিয়ে পালিয়ে গেছে। এমনকি পুলিশও সরে গেছে! ক্যাম্পাস মুক্ত। অনেক ছাত্র কর্মী আহত হয়ে ঢাকা মেডিক্যালে ভর্তি বা চিকিৎসা নিচ্ছে। সহজেই অনুমেয় যে, এরশাদ মিয়া তার দালাল-পেটোয়া গোষ্ঠীকে পুলিশ পাহারায় ছাত্র হত্যা করতে পাঠিয়েছিল। কিন্তু তারা কুলিয়ে উঠতে না পারায় পুলিশসহ সরকারি বাহিনী পিছু হটেছে। বিশাল বিজয় মিছিল ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করলো। আমরাও শরীক হলাম। মিছিলটি টিএসসি, বাংলা একাডেমি, দোয়েল চত্বর, শহিদ মিনার হয়ে আবার টিএসটিতে ফিরে এলো।
২:৩০টা-৩টার দিকে বিবিসি বাংলার তৎকালীন জনপ্রিয় সাংবাদিক প্রয়াত আতাউস সামাদ ৫০সিসি মোটরসাইকেলে চড়ে টিএসসিতে এলেন। ছাত্র নেতা ও সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের সাক্ষাৎকার নিলেন, সারা দিন কি ঘটেছে জানতে চাইলেন। সবাই গণপ্রতিরোধের কথা বললো এবং এরশাদের পদত্যাগের আগে ঘরে না ফেরার শপথ নিলো। যারা বাঁশের লাটি আর খাটের স্ট্যান্ডের মাধ্যমে গণপ্রতিরোধের কথা বললো তাদের কারো কারো হাতে বা কোমড়ে ধাতব য*ন্ত্রও দেখা যাচ্ছিল! আমাদের রক্তও টগবগ করছিল। এরশাদের পতন চাই-দেশে গণতন্ত্র চাই!
বিকেলে একপাতার সান্ধ্য পত্রিকা টেলিগ্রাম বের হলো। হকাররা সুর করে উচ্চ কণ্ঠে “তাজা খবর” বিক্রি করছে। সেখানে আট কলামে শিরোনাম ডা. শামসুল আলম খান মিলন নিহত। সন্ধ্যায় নিয়ম অনুযায়ী বিবিসি বাংলা শুনলাম। আতাউস সামাদের ভরাট কণ্ঠে গণপ্রতিরোধের প্রতিবেদন শুনলাম আর চোখের সামনে ভেসে উঠলো সারা দিনের সব ঘটনা! ঐদিনই সরকার ভীত হয়ে অনির্দিষ্টকালের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে এবং দেশে জরুরি অবস্থা জারি করে।
ডা. মিলন হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে তখনকার স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে নতুন গতি সঞ্চারিত হয় এবং মাত্র ৯ দিনের মধ্যে ৬ ডিসেম্বর ১৯৯০ এরশাদ সরকারের পতন ঘটে।
২৭ নভেম্বর আজ ডা. মিলনের ৩৩তম মৃত্যুবার্ষিকী। এই দিনে তার কবরে ও স্মৃতিমিনারে অনেক রাজনৈতিক দল, সংগঠন ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায়। কিন্তু এই তেত্রিশ বছরে তার হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়নি। যারা হত্যার বিচার চেয়েছিল এবং যারা হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছিল তারা আজ মিত্রপক্ষ! সেই বাংলা প্রবাদ, আমে-দুধে মিশে গেছে, আদারের আঁটি আদারে গেছে! স্বৈরাচারের অর্থনৈতিক ভিত্তি দুর্বল হয়নি। গণতন্ত্র জনমানুষের নাগালে আসেনি।
লেখক : রাজনীতিক এবং সমাজ কর্মী
পথরেখা/আসো