মেয়ের স্কুল বন্ধের সুযোগে আমরা ঢাকার বাইরে বেড়াতে গিয়েছিলাম। ফিরে আসার বেশ কিছুদিন পর সে আমার সাথে সেই ভ্রমণ নিয়ে গল্প করছিলো। মনোযোগ দিয়ে শুনছিলাম ওর কথাগুলো। কিছুক্ষণ পর সেই ভ্রমণ কাহিনী লিখে নিয়ে আমাকে দেখালো। জানালো এটা তার হোম-ওয়ার্ক। বেশ আগ্রহ নিয়ে পড়তে শুরু করলাম। ফিরে গেলাম আমাদের সময়ের ভ্রমণ কাহিনী লেখার স্মৃতিতে। মেয়ে আমার ভ্রমণ কাহিনীতে গরুকে ঘাস খাওয়াতে গিয়ে নৌকায় তুলে দেয়নি। কিংবা আমাদের সময়ের মতো জার্নি বাই ট্রেন/বাস কিংবা মুখস্ত গরুর রচনা লিখেনি। যা দেখেছে, যেটা ভালো লেগেছে, ওর অনুভূতি দিয়ে সেটাই লিখেছে।
আরও একটা ঘটনা বলি। আমি তখন প্রাইমারিতে। আমাদের ক্লাসে পড়তে দিয়েছে ‘গাছের পাতার রং সবুজ’, ‘প্লেন আকাশে উড়ে, ‘ট্রেন চলে রেল লাইনের উপর দিয়ে। অথচ পরীক্ষায় গিয়ে সে সেটা ভুলে গেছে আমার এক বন্ধু । গাছের পাতার রং ভুলে গেছে, লিখতে পারেনি। আর প্লেনকে নামিয়ে দিয়েছে রেল লাইনে, আর ট্রেনকে আকাশে উড়িয়ে দিয়েছে। আমরা অনেক বছর ওকে ক্ষেপিয়েছি। দোষটা আসলে কার? কেউ যদি ওকে গাছের সামনে গিয়ে পাতার রং দেখিয়ে দিতো কিংবা আকাশে তাকিয়ে যখন সে মুগ্ধ হয়ে প্লেন দেখতো, তার সাথে রেল লাইনের ফারাক বুঝিয়ে দিতো, তবে মাথা ঝাকিয়ে ঝাকিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ওকে পড়ে মুখস্ত করতে হতো না। বন্ধুদের মাঝে ট্রলের শিকারও হতে হতো না ওকে।
ইংরেজি আর অংক ক্লাস ছিলো আতঙ্কের আরেক নাম। বহু ছেলেকে অংক মুখস্ত করে পাশ করতে দেখেছি, একই ইংরেজিতে। এ সময়ের অনেক ডিগ্রী পাওয়া ছেলে মেয়ে ইংরেজিতে একটা দরখাস্ত লিখতে পারে না। শুধুমাত্র ইংরেজিতে কথা বলতে না পারার কারণে অনেকের চাকরি হচ্ছে না, দেশের বাইরে গিয়ে কম বেতনের চাকরি করতে হচ্ছে। আর এসবের ফায়দা কারা লুটছে জানেন? কোচিং আর প্রাইভেট টিউটর! ইংরেজি কথা বলা শেখার বিভিন্ন অ্যাপস তুমুল জনপ্রিয়। কোটি টাকার ব্যবসা করে নিচ্ছে। অথচ গাছের পাতার রং সবুজ এটা শেখার জন্য প্রাইভেট টিউটর লাগে না, এটাই জানে না অনেক অভিভাবক। অনেক শিক্ষকও স্কুলের পড়া বাসায় পড়িয়ে বাড়তি ইনকাম করে নিচ্ছে।
বারাক ওবামার মেয়ে তার স্কুলে ছুটির সময়ে পরিচয় গোপন করে একটি রেস্তোরায় কাজ করে ব্যাপক প্রশংসায় ভেসেছিলো। বাবা নিশ্চয়ই তার মেয়েকে দেখিয়ে বলেছিলেন, দেখো, তুমি এক গ্লাস পানি ঢেলে খেতে পারো না, আর প্রেসিডেন্টের মেয়ে রেস্তোরায় কাজ করে। একটা বারও বাবার মনে হয়নি, বারাক ওবামার মেয়ে রেস্তোরায় কাজ করেছিলো, এটাও তার পড়াশোনার একটা অংশ! দেশের বাইরে আদরের ছেলে ফুড ডেলিভারির কাজ করে, এটা সমস্য না। দেশে কোট টাই না পড়ে চাকরি করলে সেটা স্ট্যাটাসে পড়ে না। বিদেশের স্কুলে শিক্ষক নেচে গেয়ে আনন্দ করে পড়ালে সেটা উঁচু জাতের পড়াশোনা, আমাদের দেশের শিক্ষক সেটা করালে, সব বুঝি এবার রসাতলে গেলো!
এদেশে নতুন শিক্ষা ব্যবস্থার অবস্থা এমনি। ছেলে-মেয়ে যদি নাক ডুবিয়ে রাত জেগে না পড়ে, ৪/৫টা টিউটর যদি না থাকে তবে সেটা আবার কেমন শিক্ষা ব্যবস্থা? নতুন আরেক বিষফোঁড়া কিছু নামকেওয়াস্তে মাইক্রোফোন হাতে ধরে থাকা কনটেন্ট ক্রিয়েটর। কি থেকে যে তারা কি বানাচ্ছে, নিজেও জানে না। শুধুমাত্র ভিউ বাড়াতে যা ইচ্ছে প্রচার করছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। ভাইরাল হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে চারপাশে। আতঙ্কিত হয়ে পড়ছেন অভিভাবকরা। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে চলমান সমালোচনা নিয়ে জানিয়েছে এসব গুজবে কান না দিতে।
বর্তমানে কোনো পেশাকেই আর ছোটো করে দেখা হয় না; বরং অপরিচিত বা নতুন সৃষ্ট পেশায় আয় ও মর্যাদা বেশি। যেমন যারা চুল কাটে, তাদের নাপিত বলা হতো এবং সামাজিকভাবে হেয় মনে করা হতো। অথচ বিশ্বব্যাপী এটি উচ্চ আয়ের একটি পেশা। এমনকি বাংলাদেশেও এখন ‘সেলুন’ প্রতিষ্ঠিত পেশা হিসেবে স্থান করে নিয়েছে। কাজেই উচ্চশিক্ষিত বেকার তৈরির চেয়ে কম শিক্ষিত দক্ষতাসম্পন্ন জনগোষ্ঠী এখন বেশি প্রয়োজন। উচ্চশিক্ষা বা কাজের জন্য বর্তমানে হাজারো ছেলেমেয়ে বিদেশে যাচ্ছে। সেখানে কিন্ত তাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় কাজ তাদেরই করতে হচ্ছে। তা ছাড়া বিশ্বব্যাপী পেশা ও তার মর্যাদার পরিবর্তন হচ্ছে। আমেরিকা বা ইউরোপে কাজের জন্য ঘণ্টা হিসেবে মজুরি পাওয়া যায় এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা সমান। এখন তাকে যদি কাজের জন্য সাহায্যকারী বা গৃহকর্মী রাখতে হয়, তাহলে গৃহকর্মীর মজুরি ও নিজের রোজগার সমান হলে জীবন কীভাবে চলবে? অতএব নিজের কাজ নিজেকেই করতে হবে আর এ শিক্ষাই দেওয়া হচ্ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরিবর্তিত শিক্ষাক্রমে। তাহলে হাতের কাজ শিখতে কিংবা শেখাতে সমস্যা কোথায়?
পড়ালেখটা যদি এরকম হয় যে কোন নোট বই লাগবে না, কোচিং সেন্টারে যেতে হবে না, প্রাইভেট টিউটর দিতে হবে না, বন্যা কেনো হয় তা যদি চিন্তা করতে শেখায়, পদ্মা সেতু তৈরী করতে যে মানুষের মাথা লাগেনা তা যদি বুঝতে শেখায়, বাবার আয়ের সাথে ব্যয়ের ফারাক দেখে প্রশ্ন করতে শেখায়, দেশ আর দেশের মানুষকে ভালবাসতে শেখায় তাহলেই সন্তুষ্ট। আসলে কারিকুলাম ছাত্রছাত্রীদের মাঝে ভালো মানুষ হওয়ার তাগিদ তৈরি করে দিতে পারলেই সেটা সেরা। যারা সমালোচনা করছেন বা গুজব ছড়াচ্ছেন তারা নিজেরা কতোটুকু জানেন? অল্পবিদ্যা কিন্তু আবার ভয়ংকরী। একটা রাষ্ট্রের অনেক গবেষণার পরে যে সিদ্ধান্তে আসে সরকার, সেটা আমরা এক তুরিতে উড়িয়ে দিচ্ছি! সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আর ভুঁইফোড় কন্টেন্ট নিয়েও ভাববার সময় এসেছে। বাস্তবতা না বুঝে চিলের পেছনে না দৌড়িয়ে, বিরোধিতার জন্যে বিরোধীতা না করে অসুন সবাই শুভ বুদ্ধির পরিচয় দেই।
mrinalbanday@gmail.com
পথরেখা/আসো