পথরেখা অনলাইন : দেশের তৃতীয় জনপ্রিয় খেলা হলেও হকি যেন সৎ মায়ের সন্তান। খেলাটির দুরবস্তা নিয়ে যেন দেখার কেউ নেই। লিগবিহীনভাবে শেষ হয়েছে ২০২৩ সাল। নতুন বছরে কবে লিগ শুরু হবে কিংভা আদৌ হবে কিনা সেই সংশয় যেমন রয়েছে, তেমনি হকির ভবিষ্যত কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে সেটাও চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রায় তিন বছরে প্রিমিয়ার হকি লিগ মাঠে নেই। এ শীতের মৌসুমে হকির সঙ্গে ‘শীতনিদ্রা’ শব্দটাই যেন বেশি উপযুক্ত! ২০২১ সালের ২৭ নভেম্বর মেরিনার ইয়াংসের শ্রেষ্ঠত্বে শেষ হয়েছিল প্রিমিয়ার হকি লিগের ১৩তম আসর। ১৪তম পর্ব গত দুই বছরে আর শুরুই হলো না। গত বছর লিগ না হলেও মাঠে ছিল ফ্র্যাঞ্চাইজি হকি চ্যাম্পিয়নস ট্রফি। আশার আলো জাগিয়ে সেই ফ্র্যাঞ্চাইজি হকি টুর্নামেন্টেরও হদিস নেই। হকি লিগ আর ফ্র্যাঞ্চাইজি হকি টুর্নামেন্ট সমান্তরালে এগোবে, এমন আশায় ছিলেন যাঁরা, সেই খেলোয়াড়েরা ২০২৩ সালে কোনো টুর্নামেন্টেই খেলতে পারলেন না। কেন এই বছর কোনো ঘরোয়া টুর্নামেন্ট আয়োজন করতে পারল না হকি ফেডারেশন, এ নিয়ে বিভিন্ন যুক্তি আর দাবি সামনে আনছেন ফেডারেশন আর ক্লাবের সঙ্গে জড়িত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
এসবের মধ্যে সবার সামনে আসে গত ফেব্রুয়ারিতে এ কে এম মমিনুল হক সাঈদের সাধারণ সম্পাদকের পদ ফিরে পাওয়ার বিষয়টি। দীর্ঘ সময় দেশের বাইরে থাকা আলোচিত-সমালোচিত সাঈদ পদ ফিরে পেয়েই শুরু করেন ফেডারেশনে নির্বাচনী প্রক্রিয়া। জুনে বিনা প্রতিদ্বন্ধিতায় সাঈদ পরিষদই নির্বাচিত হয়েছে। নির্বাচনের মাঝে অনূর্ধ্ব-২১ এশিয়া কাপে অংশ নেয় বাংলাদেশের যুবারা। এশিয়া কাপের পর শুরু হয় এশিয়ান গেমসের জন্য জাতীয় দলের ক্যাম্প। ৮ অক্টোবর এশিয়ান গেমস শেষ হওয়ার পরও এই বছর লিগ আয়োজনের জন্য তিন মাস সময় পেয়েছে ফেডারেশন। এই সময়ে কেন লিগ মাঠে গড়াল না? এ প্রশ্নে দোষ ক্লাবগুলোর ঘাড়ে চাপালেন লিগ কমিটির সাধারণ সম্পাদক খাজা তাহের লতিফ মুন্না বললেন, ‘নভেম্বরে আমাদের সব হওয়ার কথা ছিল। বাইলজ থেকে শুরু করে সভাও হওয়ার কথা ছিল। সাঈদ ভাই সবাইকে রাজি করিয়েছিলেন। কিন্তু সভা পড়ে গেল অবরোধের সময়। ক্লাবের পক্ষ থেকে বলা হলো, নির্বাচনের সময় খেলোয়াড় পাওয়া কঠিন হবে’।
এদিকে মোহামেডান হকি দলের ম্যানেজার আরিফুল হক প্রিন্স কাউকেই দোষারোপ করতে চান না। লিগ না হওয়ার পেছনে জাতীয় দলের সাবেক এ তারকার যুক্তি, ‘ফেডারেশনে সম্পাদক ছিল না। আবার দুটি দল দেশের বাইরে ছিল। কোনো কিছুই সময়ের মধ্যে হয়নি। এখানে আসলে কারও দোষ নেই।’ অথচ এক সময়ের অত্যন্ত জনপ্রিয় খেলা হকি এখন কালের আবর্তে ফুটবলের মতোই ‘মৃতপ্রায়’ হয়ে পড়েছে। ক্রিকেট এখন দেশের সকল বয়সের মানুষের কাছের খেলায় পরিণত হয়েছে। হকির এই করুণ দশার কারণ কী? সেই প্রশ্নের উত্তরে বলতে হয় ফেডারেশনের হাল ছেড়ে দেওয়া। তারপরও ক্রিকেটকে এক নম্বর এবং ফুটবলকে দুই নম্বর ধরে হকিকে তিনে রাখাই যায়। দেশের শিশু-কিশোরদের একটা বড় অংশ ক্রিকেটের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে। হয় খেলোয়াড় নয় সংগঠক কিংবা সমর্থক, ক্রিকেট যেন তার জাদুবলে সবাইকে এক সুতোয় বেঁধে ফেলেছে। অথচ হকিরও কিন্তু এমনটি হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা ছিল। আর সেটা ফুটবল বা ক্রিকেটের চেয়ে বহুগুণ বেশি।
দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশে হকির ঘরোয়া আয়োজন সবচেয়ে কম ও অনিয়মিত। এর কোনো বর্ষপঞ্জি নেই। কবে কোন খেলা, কেউ বলতে পারে না। ক্লাবগুলো খেলতে চাইলে তবেই খেলা হয়। নইলে খেলা হয় না। একটা সময় ফুটবলের পাশাপাশি ঢাকা হকি লিগও ছিল খুবই জনপ্রিয। ফুটবল ও হকির জনপ্রিয়তার কারণে ক্রিকেট ছিল অনেকটাই তৃতীয় শ্রেণির খেলা। ১৯৮৫ সালে ঢাকায় এশিয়ান কাপ হকিতে বাংলাদেশ জাতীয় দল যে অসাধারণ নৈপুণ্য প্রদর্শন করেছিল তার তুলনাই হয় না। সেই ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারলে বিশ্ব হকিতে বাংলাদেশের নাম উচ্চারণ করতেই হতো। এশিয়া কাপ হকিতে বাংলাদেশ তৎকালীন বিশ্বকাপ, অলিম্পিক ও এশিয়ান কাপ চ্যাম্পিয়ন পাকিস্তানকে প্রায় কাঁদিয়েই ছেড়েছিল। গ্রুপপর্বের ম্যাচে বাংলাদেশের বিপক্ষে পাকিস্তানের ম্যাচটি ড্র হতে যাচ্ছিল। পাকিস্তান কোনোভাবেই জালে বল পাঠাতে পারছিল না। উল্টো বাংলাদেশ গোল করারও সুযোগ তৈরি করেছিল। শেষ পর্যন্ত খেলা শেষ হওয়ার মাত্র কয়েক মিনিট আগে জয়সূচক গোল পায় পাকিস্তান।
সেই ম্যাচের পর সারা দেশে হকির একটা জোয়ার সৃষ্টি হয়। কিন্তু হকি ফেডারেশন তা ধরে রাখার কোনো চেষ্টাই করেনি। আজ এত বছর পর হকি ফেডারেশন একই অবস্থায় রয়েছে। তাদের কোনো পরিকল্পনাই নেই খেলাটিকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য। ২০১৯ থেকে ধরলে ৫ বছরে প্রিমিয়ার হকি লিগ হয়েছে মাত্র একবার। ২০২১ সালের ২৮ নভেম্বরে সর্বশেষ লিগ শেষ হওয়ার পর দুই বছর পেরিয়ে গেছে, লিগের কোনো খবর নেই। একটা লিগ শেষ করার তৃপ্তিতেই পরের ১২-১৪ মাস হেলেদুলে কেটে যায় কর্মকর্তাদের। এতে প্রশ্ন ওঠে, বাংলাদেশের হকি কর্মকর্তাদের কাজ আসলে কী? ঘরোয়া হকির খতিয়ান বই খুলে বসলে ছন্নছাড়া অবস্থাই বেরিয়ে আসে। ১৯৯৮ থেকে ২৫ বছরে ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ হয়েছে মাত্র ১৩ বার। ২০০২ থেকে ২০০৪ টানা তিন বছর বাদ দিলে আর কখনো টানা দুই বছর প্রিমিয়ার লিগ হওয়ার নজির নেই। ২০০৬ থেকে ২০১৮ সালের লিগ এক বছর পরপর হওয়ার অলিখিত রীতি ধরে রাখে। ২০১৮ সালের পর হকি লিগের ইতিহাসে সর্বোচ্চ তিন বছরেরও বিরতি পড়ে। বিশ্ব হকির র্যাংকিংয়ে যেখানে ভারত ৩ নম্বরে, পাকিস্তান ১৬ নম্বরে সেখানে বাংলাদেশ রয়েছে ৩০ নম্বরে।
পথরেখা/আসো