মোজাম্মেল বাবু : দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন এগিয়ে আসতে থাকলে ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে যায় যে বিএনপি-জামায়াত নির্বাচনে আসছে না। ১৪৯টি পর্যন্ত আসন পেলেও তারেক রহমানের কোনো লাভ নেই, এমনকি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও তাঁর ভয় কাটবে না। কেননা তাতে অন্য কেউ বিএনপির সংসদীয় দলের নেতা হবেন এবং দল ও ধানের শীষ উভয়ই হাতছাড়া হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেবে। ২০১৮ সালে একই আশঙ্কা থেকেই মির্জা ফখরুল ইসলামকে শপথ নিতে দেওয়া হয়নি। ফেরারি তারেক চান নির্বাচনের আগেই শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করতে এবং বীরের বেশে দেশে ফিরে গণজোয়ারের নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী হতে।
অন্যদিকে বিএনপি-জামায়াত ২০১৪ সালের মতো ভোট বর্জন করলে কিংবা ২০১৮ সালের মতো মাঝপথে সরে দাঁড়ালে আওয়ামী লীগের জন্য ভোটার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা এবং কেন্দ্র দখল ঠেকানো অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। নির্বাচনের এক বছর আগে থেকেই এডিটর্স গিল্ডের গোলটেবিল থেকে, জাস্টিন হফম্যানের বিখ্যাত ছবির নাম অবলম্বনে ‘ক্রেমার ভার্সেস ক্রেমার’ ধারণাটি সামনে নিয়ে আসা হয়।
আওয়ামী লীগের অন্য সদস্যদের নির্বাচনে স্বতন্ত্রভাবে অংশগ্রহণের এ কৌশলকে আপাতদৃষ্টে ‘আউট অব দ্য বক্স’ মনে হলেও এর উদাহরণ রয়েছে বঙ্গবন্ধুর বাকশালের কর্মসূচিতে। নির্বাচনে অর্থ ও পেশিশক্তির প্রভাব নিয়ে জাতির পিতা সব সময়ই চিন্তিত ছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, এ প্রচলিত পদ্ধতিতে সত্যিকারের ভালো মানুষেরা খুব কমই জিতে আসতে পারবেন, যতই জনপ্রিয় হোন না কেন! তাই তিনি এমন একটি পদ্ধতির কথা চিন্তা করেছিলেন, যেখানে নির্বাচনের সব খরচ বহন করবে রাষ্ট্র। নির্বাচন কমিশন সব প্রার্থীর জন্য অভিন্ন একটি পোস্টার ও সবার পরিচিতি দিয়ে একটি সম্মিলিত লিফলেট ছেপে দেবে। প্রতিটি ওয়ার্ড কিংবা ইউনিয়নে জনসভার মঞ্চ তৈরি করার দায়িত্বও তাদের। অংশগ্রহণকারী প্রার্থীরা শুধু তাঁদের জন্য নির্ধারিত সময়ে বক্তৃতা করবেন অথবা বিতর্কে অংশ নেবেন। ১৯৭৫ সালে সর্বদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা বাকশাল প্রবর্তিত হলে সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপরাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন এবং তাঁর কিশোরগঞ্জের আসনটি খালি হয়। সেই আসনে তাঁর আপন ভাইয়ের বিরুদ্ধে প্রার্থী হন আশরাফ মাস্টার।
অনেকে ৭ জানুয়ারির নির্বাচনকে আওয়ামী লীগের ‘প্রাইমারি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এ ক্ষেত্রে মুহম্মদ জাফর ইকবালের বক্তব্যই প্রণিধানযোগ্য, ‘নির্বাচনে অবশ্যই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী থাকবেন, কিন্তু তাঁদের একজন হবেন বাংলাদেশের পক্ষে এবং আরেকজন হবেন বাংলাদেশের বিপক্ষে, এমন প্রতিযোগিতা আমাদের প্রয়োজন নেই! প্রার্থীদের সবার আগে মুক্তিযুদ্ধের ছাঁকনি দিয়ে পার হতে হবে। ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দল উভয়ই হবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে।’ আওয়ামী লীগের একটি শক্তিশালী নেতার বিরুদ্ধে একজন স্কুলমাস্টার জয়ী হয়ে আসেন কোনো টাকা খরচ না করেই। কুষ্টিয়ার আরেকটি উপনির্বাচনেও একই বাস্তবতা দেখা দিয়েছিল।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সে অভিজ্ঞতার আলোকেই, আওয়ামী লীগ প্রায় প্রতিটি সিটে জোটের প্রার্থী মনোনয়ন দিলেও নিজে দলের অন্য আগ্রহী প্রার্থীদের স্বতন্ত্র হিসেবে অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেয়। যাঁরা বিষয়টি ঠিকমতো বুঝতে পেরেছেন, তাঁরা সব প্রস্তুতি নিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন এবং অন্তত ১০০টি আসনে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তুলেছেন। ৬২টি আসনে তাঁরা জয়ীও হয়েছেন। আরও ১০০টি আসনে শক্তিশালী স্বতন্ত্র প্রার্থী না থাকায় তেমন প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়নি। তবে অবশিষ্ট ১০০টি আসনে কেবল ‘ডামি প্রার্থী’ থাকায় কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতাই হয়নি। এসব প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন আসনের কারণেই গড় ভোটের হার ৪২ শতাংশে নেমে এসেছে। সব কটি আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ঠিকভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলে ভোটের হার ৬০ শতাংশ পর্যন্ত উঠে যেত। নির্বাচনে কোন দল অংশগ্রহণ করল, তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর উপস্থিতি।
অনেকে ৭ জানুয়ারির নির্বাচনকে আওয়ামী লীগের ‘প্রাইমারি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এ ক্ষেত্রে মুহম্মদ জাফর ইকবালের বক্তব্যই প্রণিধানযোগ্য, ‘নির্বাচনে অবশ্যই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী থাকবেন, কিন্তু তাঁদের একজন হবেন বাংলাদেশের পক্ষে এবং আরেকজন হবেন বাংলাদেশের বিপক্ষে, এমন প্রতিযোগিতা আমাদের প্রয়োজন নেই! প্রার্থীদের সবার আগে মুক্তিযুদ্ধের ছাঁকনি দিয়ে পার হতে হবে। ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দল উভয়ই হবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে।’ ৭ জানুয়ারি ২০২৪ আদর্শ নির্বাচনের লক্ষ্যে এক দফা অগ্রসর হওয়া গেছে। তবে এবারও টাকা ও পেশিশক্তির প্রভাবমুক্ত হওয়া যায়নি। তা ছাড়া বাকশালের উপনির্বাচনে কারও কোনো দলীয় মার্কা না থাকায় ‘দলবাজি’র সুযোগ ছিল না।
এবারের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী একজন প্রার্থীর শক্তিশালী দলীয় মার্কা ছিল, বাদবাকিদের ছিল না। এতে পুরোপুরি ‘লেভেল প্লেয়িং গ্রাউন্ড’ হয়নি। তারপরও যাঁরা জিতে এসেছেন, বিপুল সাধুবাদ তাঁদের প্রাপ্য! সামনের নির্বাচনে দলীয় মার্কার ব্যবহার নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন ও দলীয় মার্কা অবশ্যই তুলে দিতে হবে। ‘ক্রেমার ভার্সেস ক্রেমার’ ধারণাটিকে যাঁরা আওয়ামী লীগের পাতানো খেলা মনে করেছিলেন, প্রতিদ্বন্দ্বিতার তীব্রতায় তাঁদের সে ভুল ভেঙে গেছে। কিশোরগঞ্জ সদরে দুই ভাই-বোনের লড়াইও শেষমেশ পাতানো থাকেনি। তবে এবারের প্রতিদ্বন্দ্বিতা কেবল দুই প্রার্থীর লড়াই ছিল না, অনেক ক্ষেত্রেই তা হয়ে উঠেছে ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া প্রার্থীর বিরুদ্ধে তৃণমূলের অভ্যুত্থান। কোথাও কোথাও তা হয়ে দাঁড়িয়েছে নারীর ক্ষমতায়নের প্রশ্ন কিংবা শ্রেণিসংগ্রাম।
১০ জানুয়ারি, বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসে, আওয়ামী লীগের ২২২ জন ও জাতীয় পার্টির ১১ জন সদস্যের পাশাপাশি ৬২ জন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যও শপথ গ্রহণ করেছেন। এখন প্রশ্ন উঠেছে, স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচিতদের ভবিষ্যৎ কী হবে? তাঁরা কি জোটবদ্ধ হয়ে বিরোধী দল গঠন করবেন? নাকি ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাবেন?
দলের কৌশলগত সিদ্ধান্তে তাঁরা স্বতন্ত্র নির্বাচন করলেও এ কথা ভুলে গেলে চলবে না, তাঁদের সবাই বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক, আজন্ম আওয়ামী লীগার। এমনকি ইমানের পরীক্ষায় তাঁরা কেউই নৌকা মার্কা নিয়ে জিতে আসা প্রার্থীদের চেয়ে কম নম্বর পাবেন না! তাঁদের দলে না নিয়ে ‘বিরোধী দল, বিরোধী দল’ খেলা চলতে থাকলে, একসময় তাঁরা ‘না ঘরকা না ঘাটকা’ হয়ে, দলছুট ও আদর্শচ্যুত হয়ে পড়বেন। অনেকে এই ৬২ জনকে নিয়ে নতুন ষড়যন্ত্রের কথাও ভাবতে পারেন। ১৯৮৬ সালে আব্দুর রাজ্জাকের বাকশালের পাঁচজনের প্রার্থী দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। দলে ফিরতে না পেরে তাঁরা নতুন দল গঠন করেন, জাতীয় পার্টিতে বিলীন হয়ে যেতে বাধ্য হন। ধ্বংস হয়ে যায় তাঁদের বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক ক্যারিয়ার!
তাই কোনো রকম দ্বিধাদ্বন্দ্বে না থেকে, স্বতন্ত্রদের মধ্যে যাঁরা দলে ফিরতে আগ্রহী, তাঁদের অবিলম্বে দলে ফিরিয়ে নেওয়া জরুরি। যাঁরা চান, তাঁরা অবশ্যই স্বতন্ত্র হিসেবে থেকে যেতে পারেন। তাতে ১১টি আসন নিয়ে জাতীয় পার্টিই হবে বিরোধী দল। তবে এ সুযোগে বঙ্গবন্ধুকন্যা, সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণের সময় ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে, সংবিধানের ৭০ ধারা তুলে দিয়ে সংসদীয় গণতন্ত্রকে পরের ধাপে নিয়ে যেতে পারেন। বাংলাদেশের রাজনীতিকে স্বপ্নের জায়গায় নিয়ে যাওয়া কেবল তাঁর পক্ষেই সম্ভব!
পথরেখা/আসো # সূত্র : প্রথম আলো