পথরেখা অনলাইন : ক্রিকেটের বনেদি খেলা বলা হয়ে থাকে টেস্টকে। সেখানে খেলাটা অনেকের কাছেই স্বপ্নের মতো মনে হয়। কারণ অনেক ক্রিকেটারই লাল বলে জাতীয় দলের জার্সি গায়ে নামতে পারেননি। সে হিসেবে কিছুটা হলেও সফল বলা যায় নাহিদ রানাকে। জাতীয় দলের অভিষেক ম্যাচেই আলো কাড়লেন এই দীর্ঘদেহী তরুণ। গতিময় বোলিং দিয়ে অভিষেককে স্মরণীয় করে রাখলেন লালমনিরহাটের এই কিশোর। বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে সর্বোচ্চ গতির বোলিংয়ের রেকর্ড তাসকিন আহমেদের। ২০২১ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ঘণ্টায় ১৫০+ কিলোমিটার গতিতে একটি ডেলিভারি করেন টাইগার পেসার। তাসকিনকে অবশ্য ছাড়িয়ে যেতে পারেননি শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে টেস্ট অভিষেক হওয়া নাহিদ রানা। তবে বল হাতে টানা ১৪০+ কিমি গতিতে বোলিং করেছেন ২১ বছর বয়সী এই পেসার। গতির ঝড় তুলে রাঙিয়েছেন অভিষেক। এক-দেড় বছর আগেও দেশের ক্রিকেটে অপরিচিত নাম ছিলো তার। জাতীয় লীগ, বিপিএল দিয়ে এই পেসার এখন বাংলাদেশের ১০৩তম টেস্ট ক্রিকেটার।
রানার এই অবিশ্বাস্য পথচলায় সবচেয়ে বড় হাতিয়ার তার গতি। এবারের বিপিএলে বল হাতে ঘণ্টায় ১৪৯ কিলোমিটার গতি তুলে সবার নজর কাড়েন তিনি। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে আন্তর্জাতিক অভিষেকেও গতির তীব্রতা দেখালেন রানা। ম্যাচের গুরুত্বপূর্ণ মূহূর্তে অল্প সময়ের ব্যবধানে নিলেন তিন উইকেট। রানার শিকার শ্রীলঙ্কার ইনিংসের দুই সেঞ্চুরিয়ান অধিনায়ক ধনাঞ্জয়া ডি সিলভা, কামিন্দু মেন্ডিস এবং প্রবাত জয়সুরিয়া। তিন উইকেট নেয়া রানা ১৪ ওভারে ৮৭ রান খরচ করেন। যার মধ্যে ছিল দুটি মেডেন। আন্তর্জাতিক অভিষেকে আলো ছড়ানো নাহিদ রানা সবশেষ বিপিএলেও দেখান গতির ঝলক। বাংলাদেশের ফ্র্যাঞ্চাইজি টুর্নামেন্টে নিজের প্রথম ওভারেই প্রতিপক্ষ হিসেবে পান বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসানকে। স্নায়ুচাপ সামলে নিজের সেরা অস্ত্রই তাক করেন নাহিদ, সাকিবের উদ্দেশে ছোড়েন ১৪৯.৭ কিলোমিটার গতির বল।
আর ওই ওভারে তিনি আরো দুটি ডেলিভারি করেন ১৪৭ কিলোমিটার গতিতে। খুলনা টাইগার্সের হয়ে ২ ম্যাচে ২ উইকেট নেয়া রানার পারফরম্যান্স নজর কাড়া না হলেও গতির সুবাদেই খুলে যায় জাতীয় দলের দুয়ার। ২০২২ সালের জাতীয় ক্রিকেট লীগ দিয়ে মূলত উত্থান নাহিদ রানার। সেবার রাজশাহী বিভাগের হয়ে ৬ ম্যাচে ৩ বার ইনিংসে ৫ উইকেটসহ আসরের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৩২ উইকেট নিয়েছিলেন তিনি। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ১৫ ম্যাচ খেলে মাত্র ২১.৯২ গড়ে রান দিয়ে ৬৩ উইকেট নিয়ে ফেলেছেন নাহিদ রানা। সিলেট টেস্ট শুরুর আগ মুহুর্তে বাংলাদেশ দলের ম্যানেজার নাফিস ইকবাল রানার জন্য অভিষেকের ক্যাপ এনে অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্তর কাছে দেন। এরপর অধিনায়ক রানার হাতে তুলে দেন ক্যাপ। যদিও অন্যদের তুলনায় কিছুটা দেরিতে শুরু হয়েছে নাহিদের ক্রিকেট ক্যারিয়ার। পরিবারের শর্ত ছিল, মাধ্যমিকের গন্ডি পেরোনোর আগে ভর্তি হওয়া যাবে না ক্রিকেট অনুশীলনে। নিজের ইচ্ছে থাকার পরও তাই স্কুলে থাকতে ক্রিকেট বলের কোনো পাঠ নিতে পারেননি রানা।
সে হিসেবে বয়সভিত্তিক ক্রিকেটেরও কোনো অভিজ্ঞতা নেই তার। ২০২০ সালে এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর রাজশাহীর ক্লেমন ক্রিকেট একাডেমিতে ভর্তি হন তিনি। ওই একাডেমির কোচ আলমগীর কবিরের হাত ধরে ক্রিকেট বলে হাতেখড়ি হয় রানার। সম্ভাবনাময় এই তরুণের পরের বছরই জাতীয় লীগে অভিষেক হয় রাজশাহী বিভাগের জার্সিতে। সিলেট টেস্টের আগে নাহিদ রানা এবং মুশফিক হাসানের অভিষেকের সম্ভাবনার কথা জানিয়েছিলেন বাংলাদেশ কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে। আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার শুরুর তিন বছর আগে প্রথম বল হাতে তুলে নিয়েছেন ২০২১ সালে ১৮ বছর বয়সে। মাত্র ৩ বছরেই খুলে গেছে জাতীয় দলের দরজা। তাও অভিজাত টেস্ট ক্রিকেটে। খেলেননি কোনো বয়সভিত্তিক দলেও।
অথচ নেই ঘরোয়া ক্রিকেটে হইচই করার মতো এমন কোনো সাফল্য নেই, যা তাকে নিয়ে আসবে লাইমলাইটে। শুধুমাত্র গতি দিয়েই জাতীয় দলে প্রবেশ করে নাহিদ রানা রূপকথাকেও হার মানিয়েছেন। এমন অনেক ক্রিকেটার আছেন, যাদের জাতীয় দলে জায়গা করে নিতে কতো পরিশ্রম করতে হয়েছে। অনেকেই আবার সেই সুযোগও পান না। পারফর্ম করার পরও দিনের পর দিন অপেক্ষা করতে হয়েছে। এ ক্ষেত্রে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হতে পারেন জাকের আলী। অনূর্ধ্ব-১৯ দলে খেলেছেন। ২২ গজে ফিনিশারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে ভালো করে গেছেন নিয়মিত। উইকেটের পেছনেও গ্লাভস পরে নিয়মিত সাফল্য পেয়েছেন। জাতীয় দলে ডাক পাওয়াটা তার জন্য অত্যাবশ্যকীয় হয়ে উঠেছিল। কিন্তু তিনি ডাক পাচ্ছিলেন না, পরে পেলেন। তবে নিশ্চিতভাবে সবাইকে ছাড়িয়ে গেলেন, হয়ে রইলেন হৃদয়ভাঙ্গাদের অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে।
পথরেখা/আসো