ক’দিন আগেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ইসরায়েলের পণ্য বয়কটের ডাক বেশ আলোড়ন তুলেছিলো। ধর্মীয় কারণে হোক কিংবা মানবিকতার বিচারে; অনেকেই অংশ নিয়েছিলেন সেই আহ্বানে। দোকানে কিংবা রেস্তোরায় কোমল পানীয়তে এই বয়কটের প্রভাব পড়েছিলো সবচেয়ে বেশি। এই সুযোগে দেশী কোমল পণ্য বিক্রি হয়েছে প্রচুর। এটা আমাদের অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক বৈকি! কিন্তু আমরা জাতি হিসেবে বিচিত্র!
সেদিন এক মুদি দোকানে একজন ভদ্র মহিলা এলেন কোমল পানীয় কিনতে। কাকতালীয়ভাবে আমার হাতে বয়কট করা কোমল পানীয় কোকাকোলা। চোখ কটমট করে আমাকে উদ্দেশ্য করে দোকানদারকে নানান কথা বলতে থাকলেন ইহুদী পণ্য নিয়ে। এগুলো যেন দোকানে না রাখেন সেই বিষয়েও পরামর্শ দিলেন। পরে কোকাকোলার ২.৫ লিটারে ৫০০ মিলি ফ্রি অফারের দুটি বোতল লুকিয়ে নিয়ে একপ্রকার ছুটে পালালেন!
তো এবার আসি রমজানের সময় হট ফেভারিট তরমুজ বয়কট নিয়ে! ২৫০ টাকার তরমুজ ৮০০ টাকায় বিক্রি হলে সেটা নিয়ে প্রতিবাদ আসতেই পারে এবং সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ফলাফল কি হলো জানেন? তরমুজ বয়কট, দাম বেশি, টলে ভিতরে লাল হয়না এই নিয়ে জলঘোলা করতে করতে মধ্যে থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হলো কৃষক। মাটিতে যে তরমুজ হয় জাতভেদে সেগুলো পরিপক্ক হতে কমপক্ষে ৯০দিন বা তিনমাস সময় লাগে।শীতের পরপরই তরমুজ লাগানো হয়- অর্থাৎ এইবার গরম আগেভাগে আসায় জানুয়ারির শুরু থেকেই তরমুজের চারা/বীজ লাগিয়েছে অনেক কৃষক। সে ক্ষেত্রে মার্চের শুরুতে বা মাঝামাঝি সময়ে তরমুজ ভালভাবে পাকার কোন যোগই নেই। রোজা যেহেতু এগিয়ে এসেছে আবার আড়তদারেরা যেহেতু মাঠ ধরে একবারে তরমুজকে নেয় কৃষকের কাছ থেকে সে জন্যে রোজায় বিক্রি ভাল হবে বলে অপরিপক্ক তরমুজই ক্ষেত থেকে নিয়ে বিক্রি শুরু করেছে এই বার। যা হবার তাই হলো...তরমুজের মত পুষ্টিকর এই ফলের দাম পড়ে গেলো।এই যে এখন তরমুজ পাকার বয়সে চলে এসেছে...তবুও দাম নেই...ফেসবুক প্রচারণায় তরমুজের ক্রেতাও কম। তরমুজ বয়কট একটা পর্যায় পর্যন্ত ঠিক আছে কিন্তু বর্তমানে তরমুজের ভরা মৌসুমে এর যৌক্তিকতা নেই।
তরমুজ বয়কট...তরমুজ কিনবোনা স্লোগানে গরীব কৃষক যে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে সেটা বুঝছেন কজন? তরমুজ বিক্রি না করলেও সিন্ডিকেটও আড়তি মুনাফালোভিদের খুব বেশি ক্ষতি নেই। কিন্তু গরীব কৃষক বিপদে পড়ে যায়। যদি দেশকে এতোই ভালবাসেন তবে দেশের গরিব কৃষক মারছেন কেনো? এরপর আসছি গরুর মাংস নিয়ে। মাংসের দাম কমিয়ে হিরো বনে যাওয়া খলিল হিসেব দেন ৬০০ টাকার নিচে মাংস বিক্রি করেও উনি লাভবান। বাকিদের হিসেব আবার অন্য। মাংসের গুনগত মান নিয়ে সরব উনারা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এবার ডাক এসেছে গরুর মাংস বয়কটের। এক মাস মাংস না কিনে নাকি মাংসের দাম কমিয়ে দিবেন। প্রশ্ন হচ্ছে, মাংসের কেজিপ্রতি উৎপাদন খরচ সম্পর্কে ধারনা কারও আছে কিনা?প্রতিপক্ষ কে? কৃষক নাকি সিন্ডিকেট? মাংস বয়কট করলে সিন্ডিকেটের কিচ্ছু হবে না, মরবে প্রান্তিক খামাড়িরা! ঘরে বসে ফেসবুকের পাতায় ইতিহাস না লিখে একটু ঘেটে দেখুন না! কোরবানির মতো করে প্রান্তিক খামারির কাছ থেকে কজন মিলে একটা গরু কিনেভাগ করার পর হিসাব করে দেখুন কেজি কতো করে পরে। অন্যের কথায় চিলে কান নিয়ে গেছে না ভেবে কানে নিজে একটু হাত দেয়ে দেখুন আছে কিনা!
মনে রাখবেন, কৃষকের পক্ষে বেশীদিন ভর্তুকি দিয়ে পণ্য বিক্রি সম্ভব নয়। এক সময় প্রান্তিক খামারি গরু পালন বন্ধ করে দিলে আমাদের দেশেও ফ্রোজেন বিদেশী জাতের গরুর মাংসের স্বাদ নিতে হবে আপনার। আপনার আশেপাশেই সিন্ডিকেট আছে। বয়কট করুন তাদের। উপায় খুজে বের করুন কৃষক বাচানোর জন্য। সরকারের সংশ্লিষ্ট মহল খলিলদের সামনে এনে স্বস্তা প্রচার না করে সিন্ডিকেট ভেঙে দিন।
আর ভারতীয়পণ্যবর্জনেরপ্রচারণা স্রেফ রাজনৈতিক ফায়দালোটার চেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয়। একজন ইউটিউবে কন্টেন্ট বানিয়ে নিজেকে মহাজ্ঞানী ভাবেন আর সেই ভারতীয়পণ্যবর্জনের ডাককে প্রধান রাজনৈতিক দল এজেন্ডা বানিয়ে নিয়েছে। নিজের গায়ের চাদর পুড়িয়ে ভারতীত পণ্য বর্জনের রাজনীতিকে সস্তা রাজনীতি ছাড়া আর কি বা বলা যায়। ‘বয়কট ভারত’ বা‘ ভারতীয় পণ্য বর্জন’ কোনো নিষ্পাপ সামাজিক আন্দোলন বা জাতীয় অর্থনীতিকে স্বাবলম্বী ও শক্তিশালী করার জাতীয় অর্থনৈতিক আন্দোলন নয়। এটা স্রেফ রাজনৈতিক ফায়দা নেয়ার চেষ্টা। কি বয়কট করবেন কিংবা কি করবেন না এটা কান্তই আপনার নিজের ব্যাপার ভারতীয় পণ্য বয়কট করেন সমস্যা নেই কিন্তু সে পণ্য আপনার আছে তো? রাস্তায় লক্ষ লক্ষ মোটর সাইকেল সিএনজি,কাপড় কিংবা পেয়াজের মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ কাচামাল। অল্প বাজেটের ঘোরাঘুরি না হয় বাদই দিলাম, চিকিৎসার কি হবে? সবার তো আর ব্যাংকক কিংবা সিঙ্গাপুর যাবার আর্থিক সক্ষমতা নেই! হাতের কাছে ভারত সহজ সমাধান।দেশের পণ্য ভালবেসে অন্য দেশের পণ্য বয়কট এক জিনিস আর ইচ্ছে করে ঘৃণা ছড়ানো অন্য জিনিস, কোনটা হচ্ছে আসলে? ভেবে দেখবেন, কে করছে, কেনো করছে, এর পিছনে উদ্দেশ্য কি!
mrinalbanday@gmail.com
পথরেখ/আসো