নীতি নৈতিকতা এমন একটা পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, পাকা চুল বাছতে গেলে মাথায় চুলই থাকে না অবস্থা। অন্যকে ঠকিয়ে দ্রুত বড়লোক হয়ে যাওয়ার বাসনা আমাদের বহুদিনের। যে কারণে রমজানে দাম বাড়িয়ে দিতে, খাবারে ফরমালিন মেশাতে কিংবা সিন্ডিকেট করে দাম বাড়াতে, মাছের ফুলকোতে রং লাগিয়ে টাটকা বানাতে আমাদের জুড়ি নাই। যে কোন প্রোডাক্ট নিমিষেই কপি বানিয়ে ফেলা এখন দুধ-ভাত, যেখানে টাকা ছাপিয়ে ফেলা হচ্ছে বেডরুমে রাখা প্রিন্টারে! বাবা-মা এখন ছুটছেন সন্তানের জন্য সাজেশন খুজতে, আর কেউ কেউ তো দু’পা এগিয়ে খুঁজতে থাকেন- যদি প্রশ্নটাই পাওয়া যেতো পরীক্ষার আগে। এখানেই শেষ নয়, নকল করতে না দেওয়ায় অভিভাবকদের মারমুখি ভূমিকার কথাও আমরা জেনেছি।
তবে এবার বোধহয় সব ছাড়িয়েই গেলেন বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব থেকে সদ্য অব্যাহতি পাওয়া মো. আলী আকবর খান। সুফি চেহারার এই মানুষটির স্ত্রী ইতোমধ্যে গ্রেফতার হয়েছেন টাকা লেনদেনের প্রমাণ পাওয়ায়। উনাদের কাছে গেলে কষ্ট করে আর পরীক্ষায় নকল করা, সাজেশন কিংবা প্রশ্ন পত্র দরকার নেই। যেখানে সনদ পাওয়া যায় টাকার বিনিময়ে সেখানে এসবের কি দরকার? তাও আবার নীল ক্ষেতের ফটোকপি দোকান থেকে নয়, একেবারে শিক্ষা বোর্ড থেকে! মানুষের লোভ কোথায় গিয়ে ঠেকেছে একবার ভেবে দেখুন।
সনদ-বাণিজ্য প্রসঙ্গে ডিবির লালবাগ বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মশিউর রহমান সংবাদ মাধ্যমে জানিয়েছেন- বছরের পর বছর কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের জাল সনদ বিক্রি করা হচ্ছিল। এসব সনদের বিষয়ে চেয়ারম্যান ও পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক জানতেন কি না, সে বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। অনেক ঘটনার সিসি (ক্লোজড সার্কিট) ক্যামেরার ফুটেজ ছিল, প্রমাণ ছিল। তাঁরা নিজেরা যুক্ত থাকার কারণে, নাকি অনিচ্ছাকৃতভাবে তাঁরা জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেননি, সে বিষয়েও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। মশিউর রহমান আরও বলেন, আসামিদের জবানবন্দিতে চেয়ারম্যানসহ অনেকের নাম এসেছে। জাল সনদ দেওয়ার ঘটনায় প্রথমে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের সিস্টেম অ্যানালিস্ট শামসুজ্জামান, বোর্ডের সাবেক কর্মচারী ও বর্তমানে শামসুজ্জামানের সনদ তৈরির নিজস্ব কারখানায় নিয়োজিত কম্পিউটারম্যান ফয়সাল হোসেন, গড়াই সার্ভে ইনস্টিটিউটের পরিচালক সানজিদা আক্তার ওরফে কলি, হিলফুল ফুজুল নামের কারিগরি প্রতিষ্ঠানের প্রিন্সিপাল সরদার গোলাম মোস্তফা ও যাত্রাবাড়ীর ঢাকা পলিটেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের পরিচালক মাকসুদুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তাঁদের মধ্যে কয়েকজন রিমান্ডে আছেন।
এ তো গেলো কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের কারসাজি! ১৯ বছর ধরে চাকরি করার পরে রাষ্ট্রায়ত্ত মোবাইল ফোন অপারেটর টেলিটক জানতে পারলো সেই কর্মকর্তার সনদটাই জাল! আর সেটি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে! এরপর একে একে বেড়িয়ে এলো আরও ৩ কর্মকর্তার । সব একই কাহিনী। ভূয়া সনদ দিয়ে উনারা চাকরীতে যোগদান করেছেন। মাঝে পেরিয়ে গেছে দেড় যুগ! ভাবা যায়! তাও ধরা পড়লেন যখন তাদের পদোন্নতির জন্য শিক্ষা সনদ যাচাইয়ের সিদ্ধান্ত হয়! অথচ রাষ্ট্রায়ত্ত যে কোন চাকরীতে যোগদানের আগে তার সকল সনদ যাচাই হবার কথা।
জানা গেছে, ১৯ বছর আগে রাষ্ট্রায়ত্ত মোবাইল ফোন অপারেটর টেলিটক লিমিটেডের বিপণন বিভাগে নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দেন মীর সাইফুল ইসলাম। চাকরিতে যোগদানের আগে নিয়ম মেনে সব শিক্ষা সনদ জমা দেন। পদোন্নতির জন্য তাঁর শিক্ষা সনদ যাচাইয়ের সিদ্ধান্ত হয়। এত বছর পর টেলিটক কর্তৃপক্ষ জানতে পারল, তাঁর স্নাতক সনদ ভুয়া। শুধু মীর সাইফুলই নন, এমন আরও তিন কর্মকর্তার খোঁজ পাওয়া গেছে, যাঁরা দেড় দশকের বেশি সময় ধরে ভুয়া সনদ দিয়ে চাকরি করে যাচ্ছিলেন। অপর তিন কর্মকর্তা হচ্ছেন পি এম মাসুদ, তোয়াবুর রহমান ও এলিয়েট লেনার্ড ফ্রেজার। ভুয়া সনদে চাকরি নেওয়ার অভিযোগে টেলিটকের এই চার কর্মকর্তার বিরুদ্ধে রাজধানীর গুলশান থানায় মামলা করেছেন প্রতিষ্ঠানটির উপমহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম। পরে তাঁদের বরখাস্ত করা হয়। বর্তমানে এই চার কর্মকর্তা পলাতক। সম্প্রতি কর্মকর্তাদের পদোন্নতির সিদ্ধান্ত নেয় টেলিটক। পরে পদোন্নতিযোগ্য ৩৬ জন কর্মকর্তার সনদ যাচাইয়ের সিদ্ধান্ত হয়। এর মধ্যে চারজনের সনদ ভুয়া বলে প্রমাণিত হয়েছে।
জানা গেছে, ২০০৭ সালের ৪ নভেম্বর টেলিটকের বিপণন শাখায় পিএম মাসুদ যোগ দেন। তার আগে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক পাসের সনদ জমা দেন। তবে সনদ যাচাই শেষে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ টেলিটককে জানিয়েছে, পিএম মাসুদের সনদটি ভুয়া। টেলিটকের আরেক কর্মকর্তা মীর সাইফুল ইসলাম চাকরিতে যোগ দেওয়ার সময় প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি থেকে স্নাতক পাসের সনদ জমা দেন। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন টেলিটককে লিখিতভাবে জানিয়ে দেয়, প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি কমিশন কর্তৃক অনুমোদিত বিশ্ববিদ্যালয় নয়। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তোয়াবুর রহমানের এই সনদ ভুয়া। একইভাবে তোয়াবুর রহমান বেসরকারি রয়েল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএড পাসের সনদ জমা দেন। পরে বিশ্ববিদ্যালয়টি সনদ যাচাই শেষে টেলিটককে জানিয়ে দিয়েছে, তোয়াবুরের বিএড পাসের সনদও ভুয়া। আরেক কর্মকর্তা এলিয়েট লেনার্ড ফ্রেজার টেলিটকে যোগ দেন ২০০৫ সালের ৮ নভেম্বর। তখন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক পাসের সনদ জমা দেন তিনি। সনদে উল্লেখ রয়েছে, তিনি বিকম (পাস) করেছেন দ্বিতীয় বিভাগে। অবশ্য জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ টেলিটককে জানিয়েছে, এলিয়েট লেনার্ড ফ্রেজারের স্নাতক পাসের সনদ ভুয়া।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সরকারী চাকুরীতে কিভাবে যাচাই বাছাই ছাড়া এরা চাকরিতে সুযোগ পেলেন আর কারাই বা এদের সুযোগ দিলেন? যেখানে কয়েক ধাপে পরীক্ষা হয় লিখিত এবং মৌখিক, সাথে থাকে পুলিশ ক্লিয়ারেন্স কিংবা গোয়েন্দা প্রতিবেদন! কোথায় পেলেন এরা সেই সনদ? এদের জন্য মেধাবীরা রয়ে যাচ্ছে বেকার হয়ে। দ্রুত এই প্রশ্নগুলোর উত্তর জানা জরুরী। একই সাথে সকল সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে যাচাই করা উচিত সকল সনদ। যাতে করে কোন মেধাবীকে পিছনে ফেলে ভুয়া সনদধারী কেউ সুযোগ না পায়। একই সাথে এদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনা উচিত খুব দ্রুত। ভূয়া সনদধারীরা যদি রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানে দাপিয়ে বেড়ায় তবে এটা সরকারের জন্যই মহালজ্জার।
mrinalbanday@gmail.com
পথরেখা/আসো