পথরেখা অনলাইন, হাসনাত আবদুল হাই : এক।। বিকালে হাঁটতে বের হন মুনীর সাহেব বিশ মিনিট দূরের পার্কে। সেখানে সম বয়সী কয়েকজনের সঙ্গে দেখা হয় তাঁর। আগে তাঁরা নিজের সময় মতো ভিন্ন ভিন্ন সময়ে পার্কে এসে কয়েক চক্কর দিয়ে বাড়ি ফিরে যেতেন। একে একে পরিচয় হওয়ার পর তাঁরা এখন একই সময়ে পার্কের নির্দিষ্ট জায়গায় এসে জড়ো হয়ে হাঁটা শুরু করেন। কথা বলতে বলতে ঘণ্টা খানেক হাঁটা হয়ে যায় নিজেদের অজান্তেই। তারপর যেখান থেকে যাত্রা শুরু সেখানে এসে ঘাসে বসে জিরিয়ে নেন ঘরে ফেরার আগে। বাদামওয়ালা এলে কিনে খোসা ছাড়িয়ে খেতে খেতে কিছুক্ষণ কথা বলেন তারা। আলোচনার বিষয় প্রায়ই দেশে কী হচ্ছে, আজ কাগজে কী লিখেছে, বাজারে জিনিসপত্রের চড়া দাম, নিজেদের অসুখ-বিসুখ— এসব নিয়ে। ঘুরে ফিরে একটা বৃত্তের মধ্যে ঘোরে তাদের আলোচনা, যেমন সীমাবদ্ধ হয়ে গিয়েছে পার্কের নির্দিষ্ট এলাকায় ঘোরা।
আজ তাদের আলোচনার অনেক খানি জুড়ে থাকলো কোর্টে নেয়ার পথে বিচারাধীন তিন উগ্রপন্থীর পুলিশ কাস্টডি থেকে পলায়ন। পুলিশ তাঁদের পুরোনো আস্তানায় হানা দিয়ে খুঁজছে, এ কথা লিখেছে কাগজে। তারা কি এতই বোকা যে নিজেদের পুরোনো আস্তানায় ফিরে যাবে? বললেন মুনীর সাহেব।
শুনে তাঁর সঙ্গীরা একমত হলেন।
দুই।।
সন্ধ্যায় বাড়ির সামনের গলিতে এসে একটু থামলেন মুনীর সাহেব। বুকের বাঁদিকে যেন চিড়িক দিয়ে ব্যথা করে উঠলো তার। তিনি এক পাশের দেয়াল ধরে দাঁড়ালেন। গলি দিয়ে অনেকে হেঁটে যাচ্ছে, রিকশা যাচ্ছে ঘণ্টা বাজিয়ে। কয়েকটা মোটর সাইকেল গেল প্রচণ্ড শব্দ করে। হাঁপাতে থাকলেন মুনীর সাহেব, মনে হলো শরীর ভিজে যাচ্ছে ঘামে। এঞ্জাইনার পেইন শুরু হয়েছে— ভাবলেন তিনি। এমন তাঁর মাঝে মাঝেই হয়। তখন জিভের নিচে নাট্রোমিন্টের স্প্রে করলেই কিছুক্ষণ পর ঠিক হয়ে যায়। স্প্রে সব সময় পকেটে থাকে তাঁর, রাতের বেলা বালিশের নিচে। আজ পার্কে হাঁটতে যাওয়ার সময় সঙ্গে নিতে ভুলে গিয়েছেন।
পথচারীদের মধ্যে দু’একজন যেতে যেতে তাঁর দিকে তাকালেও কেউ কিছু বলছে না। একজন বললো, শালার পেচ্ছাপ চেপেছে। আর জাগা পেলো না!
মুনীর সাহেব চোখ বন্ধ করে আছেন। এই সময় কে যেন পিছন থেকে তাঁর ঘাড়ে হাত দিয়ে বললো, অসুস্থ বোধ করছেন?
তিনি মাথা নিচু রেখেই আস্তে বললেন, একটু।
কণ্ঠস্বর বললো, কোথায় থাকেন?
তিনি বললেন, কাছেই। সামনের ল্যাম্পপোস্টের ডানের গেট দিয়ে ঢুকে সামনের বাড়ির দোতলায়।
কণ্ঠস্বর বললো, আপনাকে আমরা বাড়ি পৌছে দেব। চলুন।
মুনীর সাহেব দেখলেন দু’দিক থেকে দুজন যুবক তাঁকে ধরেছে হাত দিয়ে। আরেক জন পিছনে। কণ্ঠস্বর বললো, আমরা আপনাকে ধরেছি। আপনি আস্তে আস্তে হাঁটুন। আমরা আপনার বাড়ি পৌছে দেব। হাঁটুন।
যেতে যেতে কণ্ঠস্বর বললো, বাড়িতে কে আছে?
আমার স্ত্রী।
আর কেউ না?
না। সকালে বাইরে থেকে ছুটা বুয়া আসে।
কণ্ঠস্বর তার দুই সঙ্গীর উদ্দেশ্যে বললো, তিনি আর তাঁর স্ত্রী। কোনো ঝামেলা নেই। আইডিয়াল।
বাড়িতে যাওয়ার সিঁড়ির কাছে এসে দাঁড়িয়ে গেলেন মুনীর সাহেব। হাসি-মুখে বললেন, ব্যথাটা চলে গিয়েছে। আপনাদের কষ্ট করে ওপরে যেতে হবে না। আমি নিজেই যেতে পরব। অনেক ধন্যবাদ আপনাদের।
কণ্ঠস্বর বললো, তা কি করে হয়? আপনাকে বাড়িতে পৌছাতেই আমরা এসেছি। সিঁড়ি থেকে ফিরে যাওয়া যায় না। চলুন ওপরে।
মুনীর সাহেব তখন ভাবছেন তিন যুবককে নিয়ে বাড়িতে গেলে এদের চা-নাস্তা খাওয়াতে হবে। তাঁর স্ত্রীর ওপর চাপ পড়বে। তিনি এবার জোর গলায় বললেন, বললাম তো, আপনাদের যাওয়ার দরকার নেই। আমি নিজেই যেতে পারব।
কণ্ঠস্বর এবার কঠিন ভঙ্গিতে বললো, আপনাকে নিয়ে আপনার বাড়িতে ঢুকব আমরা। আমাদের দরকার আছে। চলুন। তার স্বরে চাপা ধমক।
মুনীর চৌধুরী ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললেন, কী দরকার?
কণ্ঠস্বর প্রথম যুবক তাঁর পেটে তীক্ষ্ম একটা কিছু চেপে বললো, এত কথার কি দরকার? আমাদের দেখে বুঝতে পারছেন না আমরা হাইজ্যাকার? আপনার বাড়িতে আমাদের ঢুকতে হবে। চলুন ওপরে।
পিছন থেকে দ্বিতীয় যুবক প্রথম যুবককে বললো, তাড়াতাড়ি করো। কেউ এসে পড়তে পারে।
তৃতীয় যুবক ব্যস্ত হয়ে বললো, দরকার হলে চ্যাংদোলা করে নিয়ে চল। এমন চান্স আর পাওয়া যাবে না। প্রায় খালি বাড়ি।
মুনীর সাহেব চিৎকার করার চেষ্টা করতেই পেটে তীক্ষ্ম বস্তুটা প্রায় ঢুকে যাওয়ার মতো হলো। তিনি কথা না বলে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠলেন। প্রথম যুবক পিছন থেকে তাঁর পিঠে তীক্ষ্ম বস্তুটা লাগিয়ে রেখে বললো, ঢুকেই স্ত্রীকে বলবেন তিনি আমাদের দেখে টু শব্দটি যেন না করেন। আমরা ডেঞ্জারাস। বুঝলেন? দু’চারটা লাশ ফেলে দিতে ইতস্তত করি না।
ভয়ে তিনি ঘেমে উঠলেন।
দোতলায় পৌছে বাসার বেল টেপার কিছুক্ষণ পর দরোজা খুলে সামনে দঁড়ালেন তাঁর স্ত্রী ফিরোজা। তাঁর পিছনে তিন যুবককে দেখে তিনি শঙ্কিত হয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। মুনীর সাহেব নিজের ঠোঁটের ওপর আঙুলগুলো রেখে খুব আস্তে বললেন, চু-উ-প-প।
তিন।।
জিগাতলায় তিনতলা এই বাড়িতে দুইরুমের ফ্ল্যাট মুনীর সাহেবের। একটা তাদের বেড রুম। দ্বিতীয়টায় তাঁদের স্বামী-স্ত্রীর শিক্ষকতা জীবনে দুজন নিজেদের বিষয়ে যেসব বই কিনেছেন, সেসব কয়েকটি আলমারির শেলফে সাজিয়ে রাখা। কোনো লাইব্রেরিতে দিয়ে দেবেন মনে করলেও এ পর্যন্ত দেয়া হয়নি। শিক্ষকতার জীবনে মুনীর সাহেব অর্থনীতি পড়িয়েছেন, তাঁর স্ত্রী ফিরোজার বিষয় ছিল সোসিওলজি। এই দুই বিষয়ে বই ছাড়াও রয়েছে দুজনের পছন্দের সাহিত্য, ইতিহাস এবং দর্শনের বই। ঘরে দুজনের আলাদা পড়ার টেবিল। টেবিলে খাতা-কলম রয়েছে, সেই সঙ্গে এ ফোর সাইজের কাগজের প্যাকেট। তারা দুজনই মাঝে মাঝে কাগজে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে লেখেন, বিশেষ করে কারেন্ট এফেয়ার্স নিয়ে। অবসরে যাওয়ার পর মুনীর সাহেব কয়েকটা টিভি চ্যানেলের টক শোতে অংশ নিয়েছেন। গভীর রাতে ফিরতে হয় বলে এখন আর যান না।
তিন যুবককে নিয়ে মুনীর সাহেব ঘরে ঢুকে মুখে আঙুল দিয়ে স্ত্রীকে চুপ করে থাকার জন্য সতর্ক করলেও তাঁর গলা থেকে ভয়ার্ত স্বর বেরিয়ে এলো, এরা কারা? এখানে কেন?
প্রথম যুবক ত্বরিতে বাসায় ঢোকার দরোজা বন্ধ করে ঠোঁটে আঙুল দিয়ে মুনীর সাহেব একটু আগে যেভাবে সাবধান করেছেন সেই ভঙ্গিতে বললো, সসসস। আস্তে কথা বলেন। ভালো হয় যদি কথা না বলে চুপ করে থাকেন আর আমাদের কথা শোনেন। সে কথা বলার সময় অন্য দুই যুবক বিদ্যুৎবেগে রান্নাঘর, বাথরুম, দুটো ঘর দেখে এসে বললো, না কেউ নেই। এরা দুজন, যেমন বলেছিলেন তিনি। নলে সে মুনীর সাহেবের দিকে তাকায়।
প্রথম যুবক মুনীর সাহেব আর তাঁর স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলে, বলেছি বটে আমরা হাইজ্যাকার তবে এখানে কিছু নিতে আসিনি। এখানে আমাদের আজ রাত কাটাতে হবে। ভোর হবার আগেই আমরা চলে যাব। আপনাদের কোনো ক্ষতি করার ইচ্ছা নেই আমাদের। কিন্তু আমাদের কথা মতো চলতে হবে। না হলে বিপদ হবে। তারপর সে বললো, প্রথমেই আপনাদের মোবাইলগুলো দিয়ে দিন।
মুনীর সাহেব তাঁর পকেট থেকে মোবাইল বের করে প্রথম যুবকের হাতে দিলেন। প্রথম যুবক ফিরোজা বেগমের দিকে তাকিয়ে বললো, আপনার নেই? আজকাল স্বামী- স্ত্রীর দুজনেরই থাকে। দিয়ে দিন।
ফিরোজা বেগম ইতস্তত করেন, কিছু একটা বলতে চান। প্রথম যুবক কঠিন হয়ে বলে, বোঝা যাচ্ছে মিথ্যে বলে অভ্যেস নেই আপনার। দিয়ে দিন।
ফিরোজা বেগম বললেন, বেড রুমে আছে।
প্রথম যুবক বললো, চলুন। আমাকে দেবেন।
বেডরুমে এসে ফিরোজা বেগমের হাত থেকে মোবাইল নেওয়ার পর প্রথম যুবক বললো, আমরা না যাওয়া পর্যন্ত আপনারা দুজন এই ঘরেই থাকবেন। ঠিক আছে? তারপর পাশের দিকে তাকিয়ে বললো, এটাচড বাথ রুম আছে, সুতরাং আপনাদের ঘরের বাইরে না গেলেও চলবে।
ফিরোজা বেগম বললেন, রাতের খাওয়া?
প্রথম যুবক একটু চিন্তা করে বললো, হু। রাতের খাবার কখন খান আপনারা?
ফিরোজা বেগম বলেন, রাত সাড়ে নয়টায়।
প্রথম যুবক বললো, বেশ খাওয়ার সময় আমরা এসে আপনাদের ডাইনিং টেবিলে নিয়ে যাব। খাওয়া শেষ করে আবার এই ঘরে ফিরে আসবেন। তারপর বাইরের ঘরের দিকে তাকিয়ে সে বললো, আজ আর টিভি দেখা হবে না আপনাদের। বিছানায় শুয়ে দুজনে গল্প করতে করতে ঘুমিয়ে পড়বেন। আমরা অবশ্য মাঝে মাঝে এসে উঁকি দিয়ে দেখে যাব আপনাদের।
কথা শেষ করে সে সঙ্গীদের ডেকে বললো, ওনাকে নিয়ে এসো।
কিছুপর দুই যুবক মুনীর সাহেবকে সঙ্গে নিয়ে বেডরুমে ঢুকলো। তাদের দেখে প্রথম যুবক বললো, আমি ইনাকে সব বুঝিয়ে বলেছি। তাদেরকে এ ঘরে থাকতে হবে আমরা না যাওয়া পর্যন্ত। শুধু সাড়ে নয়টার সময় তাদের বাইরের ঘরে গিয়ে রাতের খাবার খেতে দেয়া হবে। তাতে কোনো অসুবিধা নেই। মনে হচ্ছে, ছুটা বুয়া, রাতের খাওয়া রান্না করে দিয়ে গিয়েছে। তাই না? বলে সে ফিরোজা বেগমের দিকে তাকালো।
তিনি মাথা নেড়ে সায় দিলেন। দ্বিতীয় যুবক বললো, আমাদেরও কিছু খেতে হবে। সারাদিন খাওয়া হয়নি।
প্রথম যুবক বললো, এদের নিশ্চয় সকালে নাস্তা করার রুটি আর ডিম আছে। আমরা ডিম ভেজে রুটি দিয়ে খাব। বলে সে ফিরোজা বেগমের দিকে তাকিয়ে বললো, আপনাদের এইটুকু ক্ষতি আমরা করব। তারপর সে দ্বিতীয় যুবককে বললো, এই ঘরের জানালা দুটো ভালো করে বন্ধ করে দাও। ভালো করে পর্দা টেনে দিতে হবে যেন বাইরে থেকে কোনো আলো দেখা না যায়।
তৃতীয় যুবক বললো, আমাদের একজনের কি এখানে পাহাড়ায় থাকা দরকার?
প্রথম যুবক বললো, দরকার নেই। মাঝে মাঝে এসে উঁকি দিয়ে দেখলেই হবে। বলা শেষ করে সে মুনীর সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললো, আপনি বিছানায় শুয়ে রেস্ট নিন। রাস্তায় অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। আমাদের জন্য টেনশন করবেন না। বলেছি তো আমরা ভোর হবার আগে চলে যাব। আপনাদের কোনো ক্ষতি করার ইচ্ছা নেই আমাদের। কিছু নিতেও আসিনি আমরা।
দ্বিতীয় যুবক বলে, পাশের ঘরে অনেক বই দেখলাম। এরা সময় কাটাবার জন্য বই পড়তে পারেন।
প্রথম যুবক বললো, ভালো কথা বলেছো। এরা টিভি দেখতে পারবেন না আজ রাতে। বই পড়ে সময় কাটাতে পারেন। তারপর সে মুনীর সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললো, আপনাদের পছন্দের বই নিয়ে আসতে চাইলে ওর সঙ্গে যান।
ফিরোজা বেগম বললেন, আজ বই পড়ার দরকার নেই। ওর শরীর খারাপ হওয়ার কথা বললে তুমি একটু আগে। তারপর স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললেন, কী হয়েছিল?
মুনীর সাহেব বললেন, একটু চিনচিনে ব্যথা করেছিল। বেশিক্ষণ থাকেনি।
শুনে ফিরোজা বেগম চিন্তিত স্বরে বললেন, আজ স্প্রেটা নাওনি। বিছানাতেই পড়ে আছে দেখলাম। তোমাকে বলেছি ওটা না নিয়ে বাইরে যাবে না। নাও এখন শুয়ে পড়ো। আমি এসিটা ছেড়ে দিচ্ছি।
প্রথম যুবক ফিরোজা বেগমের মোবাইল দেখে বললো, এখন সাড়ে সাতটা বাজে। দু’ঘণ্টা পর আপনাদের ডিনারের জন্য ডাকা হবে।
ফিরোজা বেগম বললেন, তোমাদের রাতের খাওয়ার কথা বলছিলে। তোমরা কি ডিম ভাজতে পারো?
আমরা মোটামুটি রান্না করতে পারি। আন্ডারগ্রাউন্ড জীবন কাটিয়ে রান্নার অভ্যাস হয়ে গিয়েছে। বলে প্রথম যুবক হাসলো।
তিন যুবক বাইরের ঘরে এসে সোফায় হাত পা ছড়িয়ে বসলো। তৃতীয় যুবক বললো, ভদ্রমহিলা নিজে থেকেই আমাদের জন্য রান্না করার কথা বললেন। তাঁকে করতে দেয়া যায় না? কতদিন ভালো রান্নার খাবার খাই নি।
প্রথম যুবক বললো, রিস্কি। ভদ্রমহিলা রান্না করতে এসে যদি ‘আগুন’ ‘আগুন’ বলে চিৎকার করে লোক জড়ো করেন? অথবা অন্য কিছু করেন যা আমাদের কথা জানিয়ে দেবে প্রতিবেশীদের? ঝামেলায় গিয়ে কাজ কি? তার চেয়ে আমাদের নিজ হাতে ডিম ভাজাই ঠিক আছে। তারপর সে বলে, মোবাইল পাওয়া গিয়েছে। এখন কমরেড লিডারকে ফোন করে জিজ্ঞাসা করতে হয় কেউ এসে আমাদের কীভাবে নিয়ে যাবে। আমাদের নিজেদের পক্ষে কোথাও যাওয়া সম্ভব না। পুলিশ নিশ্চয় হন্যে হয়ে সারা শহর খুঁঁজছে। টিভিতে আমাদের ছবি দিয়ে পাবলিককে বলা হয়েছে দেখলেই যেন খবর দেয়া হয়। এসব জানা থাকার পর বোকামি করা যায় না। তারপর সে বলে, যাই বলো, এই পর্যন্ত বেশ নির্বিঘ্নে কেটেছে আমাদের। এখন কোনো ভুল করা যায় না। ঠান্ডা মাথায় কাজ করতে হবে।
প্রথম যুবক মোবাইলে ফোন করার পর ওপাশ থেকে কেউ কথা বললো। সে বললো, আমরা এখন জিগাতলার এত নম্বরে তিনতালা বাড়ির দোতলায় আছি। না, এটা আমাদের ফোন না। কথা বলতে অসুবিধা নেই। এখান থেকে নিয়ে যেতে কাউকে গাড়িসহ পাঠান। মাঝ রাতে? না না। মাঝ রাত থেকে পুলিশ সব গাড়ি চেক করে। ফজরের নামাজের আজানের পর পাঠান। গলির মোড়ে এসে ফোন দিলে আমরা নেমে আসব। না, জিম্মিরা গোলমাল করবে না। তাদের বেড রুমে আটকে রাখা হবে। হ্যাঁ, আমাদের পালানোর প্ল্যান এ পর্যন্ত ভালোভাবেই কাজ করেছে।
ফোনে কথা বলা শেষ করে প্রথম যুবক দ্বিতীয় যুবককে বললো, দেখ তো কিচেনে চা টা পাওয়া যায় কি না। গলা শুকিয়ে এসেছে। তারপর ডাইনিং টেবিলের দিকে তাকিয়ে বললো, বয়ামে লাঠি বিস্কিট দেখা যাচ্ছে। চায়ের সঙ্গে খাওয়া যাবে একটা।
দ্বিতীয় যুবক রান্নাঘরে যাওয়ার পর তৃতীয় যুবক বললো, কি গাড়ি পাঠাবে বললো কিছু।
প্রথম যুবক বললো, বলেনি। গোপনীয়তার জন্য শেষ মুহূর্তে বলবে।
তৃতীয় যুবক বললো,পার্টি হাই কমান্ডের সিদ্ধান্তগুলো আজকাল ঠিক হচ্ছে না। এই যে আমাদের অপারেশনে পাঠানো হলো এটার সব দিক ভেবে দেখলে আমাদের ধরা পড়তে হতো না।
দ্বিতীয় যুবক ট্রেতে চায়ের কাপ নিয়ে এসে সেন্টার টেবিলে রাখলো। তারপর ডাইনিং টেবিল থেকে বিস্কিটের বয়াম এনে রাখলো সামনে। তৃতীয় যুবক চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বললো, পার্টির লাইন এখনো বদলালো না। গ্রাম থেকেই বিপ্লব সফল করতে চায়। বুঝতে চায় না গ্রামে এখন বিপ্লবী পরিবেশ নেই। সব শ্রেণির কৃষককে সংগঠিত করা সম্ভব না। শুধু জোতদারদের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলে সমস্ত কৃষক সমাজকে একতাবদ্ধ করা যাবে না। সরল মেরুকরণ নয়, গ্রামে এখন বিভিন্ন শ্রেণি স্বার্থ গড়ে উঠেছে। তুলনায় শহরে শ্রমিক আর স্বল্প বেতনভুকদের সহজেই ক্ষমতা দখলের কথা বলে কাছে টানা যায়। প্রগতিশীল ছাত্ররা তো আছেই।
প্রথম যুবক বলে, বিপ্লবী আন্দোলনের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের মস্ত বড় সুযোগ ছিল একাত্তরে মার্চ মাসে ইয়াহিয়া খান যখন গণপরিষদের সভা স্থগিত করে আর জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাস্তায় নেমে আসে। তাদের কোনো রাজনৈতিক দল রাস্তায় নামতে বলেনি। কয়েকদিন তারা কেন্দ্রীয় নির্দেশ ছাড়াই রাস্তায় রাস্তায় বিক্ষোভ করেছে। সেই সময় যে পলিটিক্যাল ভ্যাকুয়াম ছিল সেটা কমিউনিস্ট পার্টি পূরণের জন্য এগিয়ে আসতে পারত। পাক বাহিনীর সঙ্গে সশস্ত্র সংগ্রামও শুরু করা যেত। রাশিয়ায় লেনিন এবং বলশেভিকরা এইভাবে বিপ্লব শুরু করে সফল হয়েছিলেন। সেখানে লেনিনগ্রাডের রাস্তায় প্রথমে কোনো রাজনৈতিক দলের ডাকে সকল শ্রেণির মানুষ বিক্ষোভ মিছিল বের করেনি। জনতার সেই স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনকে পরে নেতৃত্ব দিয়ে বলশেভিকরা বিল্পব আনতে পেরেছিল। হ্যাঁ, একাত্তরে মার্চের কয়েকটা দিন মার্ক্সবাদীদের জন্য সেই সুযোগ এসেছিল। বৃহত্তম রাজনৈতিক দল সেই আন্দোলনের নেতৃত্ব নিয়ে নেয়। তারাই এরপর নির্দেশনা দেয় কীভাবে আন্দোলন পরিচালিত করতে হবে। এই সুযোগ পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্টদের সামনে তখন ছিল। কিন্তু সিদ্ধান্তহীনতার জন্য ক্ষমতা দখলের জন্য বিপ্লবী সংগ্রামের সুযোগ হারালো পার্টি।
দ্বিতীয় যুবক বলে, কিন্তু তা করে সম্ভব হতো? কমিউনিস্ট পার্টি তখন দুই দলে বিভক্ত। তাদের মধ্যে একক সিদ্ধান্ত নেবার মতো একতা ছিল না।
প্রথম যুবক বললো, সেই বিভক্তি তো রাশিয়াতেও ছিল। বলশেভিকদের সঙ্গে অক্টোবর বিপ্লবে নামতে রাজি হয়নি মেনশেভিকরা।
প্রথম যুবক বললো, হ্যাঁ, রাশিয়াতেও কমিউনিস্টরা দ্বিধাবিভক্ত ছিল। এমনকি বলশেভিকদের মধ্যে স্ট্যালিনসহ অনেক নেতা তখন বিপ্লবের সময় আসেনি মনে করেছেন। কিন্তু লেনিন ট্রটস্কিকে নিয়ে বিপ্লবের জন্য সংগ্রাম শুরু করে অক্টোবর বিপ্লব সফল করেছেন। তারপর সে বলে, নেতৃত্ব, বুঝলে নেতৃৃত্বই গুরুত্বপূর্ণ। যে নেতৃত্ব সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম।
তৃতীয় যুবক বলে, এখন তা হলে পার্টির লাইন কী হওয়া উচিত?
প্রথম যুবক বললো, শহরে বিপ্লব আনার জন্য কাজ করতে হবে। রাশিয়ার মতো জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনের এজেন্সি নিয়ে নিতে হবে।
হাইজ্যাক করতে হবে? দ্বিতীয় যুবক হেসে বলে।
সেভাবেও ভাবতে পারো। কিন্তু আমি ভদ্রভাবে বলবো, কো-অপ্ট করে নিতে হবে। কিন্তু আমাদের নেতারা সেভাবে ভাবছে না। মাঝখান থেকে আওলমরা যারা তৃণমূলে কাজ করছি তাদের ত্যাগ স্বীকার করতে হচ্ছে। প্রথম যুবকের স্বরে হতাশা।
চার।।
ফিরোজা বেগম এতক্ষণ দরজায় আড়ি পেতে বাইরের ঘরে যুবকদের কথা শুনছিলেন। তিনি বিছানায় এসে শুয়ে থাকা স্বামীকে বললেন, শুনছো, ওরা হাইজ্যাকার না। কমিউনিস্ট পাটির ছেলে। ওরা বিপ্লব নিয়ে কথা বলছে।
হু বিপ্লব। আছে কোথায় ওরা? মুর্খের স্বর্গে বাস করছে সব। বুঝলে। লিভিং ইন ফুলস প্যারাডাইস। রাশিয়ায় তেয়াত্তর বছর পর বিপ্লব নিজে থেকেই ধসে পড়লো। ইট জাস্ট ইম্পলোডেড। আমেরিকাকে একটা গুলিও খরচ করতে হয়নি। যে ব্যবস্থা হঠাৎ করে ধসে পড়তে পারে তার ওপর মানুষের বিশ্বাস থাকবে কেমন করে?
কিন্তু এই ছেলেগুলোর কথা শুনে মনে হচ্ছে বিপ্লবের আদর্শে মানুষ এখনো বিশ্বাস করে। ফিরোজা বেগম বলেন।
মুনীর সাহেব বলেন, তা করে। মানুষ সবসময় বর্তমান ব্যবস্থা, বিদ্যমান জীবন নিয়ে অতৃপ্ত। তাদের কেউ কেউ ইউটোপিয়ার কথা ভাবে। একটা আদর্শ থাকতে হয় তাদের জন্য। না হলে জীবনে যেন কোনো চ্যালেঞ্জ থাকে না।
ফিরোজা বেগম বলেন, মানুষই একমাত্র প্রাণী যারা স্বপ্ন দেখে। স্বপ্ন বাস্তবে সফল হয় না জেনেও দেখে। এটাই তো তাদের শক্তির জায়গা।
মুনীর সাহেব হেসে বলেন, দুর্বলতার জায়গাও বটে। এখন কথা হচ্ছে এ আপদগুলো যাবে কখন? আমার টেনশন যাচ্ছে না।
ফিরোজা বেগম বললেন, আড়ি পেতে শুনলাম ভোর রাতে ওদের নিতে গাড়ি আসবে।
ভোর রাত? তার তো অনেক দেরি। আমাকে ততক্ষণ টেনশন নিয়ে থাকতে হবে। হার্ট অ্যাটাক না হয়ে যায়। ফিরোজা বেগম বললেন, তুমি এত টেনশন করছো কেন? ওরা কিছু নিতে আসেনি। টাকা-পয়সা না। সোনা-দানা না। শুধু একটা রাত থাকবে। থাকুক, আমাদের খুব অসুবিধায় ফেলেনি ওরা। এমনকি বুয়ার রান্না করা খাবার আমাদের খেতে দেবে। ওরা আমাদের ডিম আর রুটি খেয়েই সন্তুষ্ট থাকবে। শোনোনি?
শুনেছি। এত ভালো মানুষি করছে দেখেই তো আমার টেনশন বাড়ছে। ওরা না যাওয়া পর্যন্ত কিছু বিশ্বাস নেই।
পাঁচ।।
রাতে খাওয়ার পর মুনীর সাহেব আর ফিরোজা বেগম তাঁদের শোবার ঘরে গেলেন। তিন যুবক খেলো আরেকটু পর। তারপর কিছুক্ষণ ভলিউম লো করে টেলিভিশনে নিউজ দেখলো তারা। শেষের দিকে দেখানো হলো তাদের ছবি। বলা হলো ফিল্মি কায়দায় তাদের কোর্টে নেবার পথে রাস্তায় জটলা সৃষ্টি করে উগ্রপন্থীরা তাদের পালাতে সাহায্য করেছে। তাদের ধরার জন্য পুলিশ সর্বাত্মক চেষ্টা করছে। জনসাধারণকে সাবধান করা হচ্ছে এই মর্মে যে এরা খুব সাংঘাতিক অপরাধী। তাদের দেখলে সঙ্গে সঙ্গে পুলিশকে যেন ইমারজেন্সি নম্বরে খবর দেয়া হয়।
নিউজ শেষ হলে প্রথম যুবক বললো, আমাদের একটা সুবিধা এই ক’দিন জেলে থেকে মুখে দাড়ি গজিয়েছে। যার জন্য দেখে এই ছবির সঙ্গে মিল পেতে সময় নেবে। বলে সে একটা হাই তুলে বললো, রাত মোটে সাড়ে দশটা। গাড়ি আসবে ভোর বেলা, মানে সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা পর। এই সময় সোফাতে হেলান দিয়েই একটু ঘুমিয়ে নেয়া যাতে পারে। কিন্তু তার আগে নিশ্চিত হতে হবে আমাদের হোস্ট অ্যান্ড হোস্টেস ঘুমাচ্ছেন কি না।
দ্বিতীয় যুবক দরজার দিকে তাকিয়ে বললো, যে লক সেটা বোধ হয় ভিতর থেকে খোলা যায়। না হলে লক ইন করে নিশ্চিন্তে ঘুমানো যেত।
তৃতীয় যুবক বললো, এক কাজ করি না কেন? ডিনার টেবিলটা টেনে ওদের দরজার সামনে রাখি। তারা যদি ঘর থেকে বের হতে চায় অত বড় টেবিল সরাতে গেলে শব্দ হবে।
প্রথম যুবক বললো, চমৎকার বুদ্ধি। তাই করা যাক।
কতক্ষণ ঘুমিয়েছে তারা মনে করতে পারলো না। ফিরোজা বেগমের শঙ্কিত স্বর শুনে তারা তিনজন প্রায় একসঙ্গে দেখলো তিনি দরজা খুলে ডাইনিং টেবিলের ওপাশ থেকে প্রায় আর্তস্বরে বলছেন, ওর বুকে খুব ব্যথা করছে। হাসপাতালে নিতে হবে। একটা ব্যবস্থা করো তোমরা। এই টেবিল কেন এখানে?
প্রথম যুবক উঠে কাছে গিয়ে বললো, খুব বেশি আর অনেকক্ষণ থেকে ব্যথা করছে কি? আজ সন্ধ্যায় তাঁকে যখন আমরা বাসায় নিয়ে আসি তখন কিন্তু তিনি বুকে ব্যথা করার জন্য দাঁড়িয়ে ছিলেন। সেটা একটু পরই চলে যায়। দেখুন এই ব্যথাও হয়ত চলে যাবে। মনে হচ্ছে, এটা তাঁর ক্রনিক ব্যথা। আসে যায়।
ফিরোজা বেগম বললেন, হাঁ। পুরোনো ব্যথা। কিন্তু এতক্ষণ থাকে না কোনো সময়। আর ব্যথার তীব্রতাও বেশি মনে হচ্ছে।
শোনার পর তিন যুবক ডিনার টেবিল সরিয়ে বেডরুমে ঢুকে দেখলো মুনীর সাহেব ছটফট করছেন। তার সারা শরীর ঘামে ভিজে উঠেছে। তারা মুনীর সাহেবের অবস্থা দেখে নিজেদের জন্যও শঙ্কিত হয়ে পড়লো। তাকে হাসপাতালে নেয়ার জন্য প্রতিবেশীদের ডাকা হলে নিজেরা ধরা পড়ে যাবে, এ কথা মনে হলো সঙ্গে সঙ্গে।
ফিরোজা বেগম কাতর হয়ে অনুনয়ের ভঙ্গিতে বললেন, ভাই তোমরা একটা কিছু করো। মোবাইল দুটোই তোমাদের কাছে। হাসপাতালে ইমার্জেন্সিতে ফোন করে অ্যাম্বুলেন্স পাঠাতে বলো শিগগির। দেখছো না ও কেমন করছে।
প্রথম যুবক বললো, হাসপাতালের ইমার্জেন্সি নাম্বার আছে আপনার কাছে?
ফিরোজা বেগম বললেন, আছে ভাই। এই যে দিচ্ছি। বলে তিনি ড্রেসিং টেবিলের ওপর থেকে একটা নোট বই নিয়ে পাতা খুলে নাম্বারটা দেখালো তাকে। প্রথম যুবক নাম্বার দেখে ফোন করলো। একটু পর হাসপাতালের ইমার্জেন্সি সাড়া দিলো। কথা শেষ করে প্রথম যুবক বললো, অ্যাম্বুলেন্স এখনি আসছে। আপনি চিন্তা করবেন না।
ফিরোজা বেগম বললেন, আমি তা হলে তৈরি হয়ে নিই। বলে তিনি কাপড় রাখা আলনার দিকে গেলেন। প্রথম যুবক তার সঙ্গীদের সঙ্গে নিচু স্বরে কথা বলার পর ফিরোজা বেগমকে বললো, আপনার যেতে হবে না।
ফিরোজা বেগম অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে বললেন, আমার যেতে হবে না? তা হলে কে ওকে নিয়ে যাবে হাসপাতালে?
আমাদের একজন যাবে। প্রথম যুবক বললো।
ফিরোজা বেগম বললেন, তবু আমার সঙ্গে যাওয়া দরকার। আমি গেলে তোমাদের কি অসুবিধা?
অসুবিধা আছে। বুঝতে পারছেন না কেন? আপনি সেখানে গিয়ে আমাদের কথা বলে দিতে পারেন। হয়তো বলবেন না। কিন্তু আমরা বিশ্বাস করি কি করে? আমাদের কি অসুবিধা বুঝতে পারছেন এবার?
ফিরোজা বেগম বললেন, বুঝতে পারছি। বেশ তোমরা নেয়ার ব্যবস্থা করো। সেখানে ভর্তি হওয়ার পর ওর কি অবস্থা আমাকে দয়া করে জানাবে তোমরা।
বলতে বলতে তাঁর গলা কান্নায় ভিজে এলো। প্রথম যুবক তাঁর কাছে গিয়ে বললো, আপনি একটুও চিন্তা করবেন না। আমি নিজেই যাব। গিয়েই ফোন করে জানাব। আপনাদের দু’জনের একটা মোবাইল ফোন থাকবে এদের কাছে। আপনি এদের সঙ্গে এ ঘরেই বসে থাকবেন। ফোন এলেই আপনাকে দেবে এরা। আমি হাসপাতালে গিয়ে সঙ্গে সঙ্গে জানাব আপনাকে।
একটু পর অ্যাম্বুলেন্স এলে মুনীর সাহেবকে স্ট্রেচারে করে নিয়ে গেল মেল নার্স। সঙ্গে গেল প্রথম যুবক। তাদের পিছনে পিছনে সিঁড়ি পর্যন্ত এলেন ফিরোজা বেগম। তারপর শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে ঘরে ফিরে এসে বসে থাকলেন স্থানুর মতো ডাইনিং টেবিলের একটা চেয়ারে। তাঁকে বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে।
ছয়।।
একঘণ্টা হয়ে গেলেও কোনো ফোন না আসায় অস্থির হয়ে পড়লেন ফিরোজা বেগম। অস্থির হয়ে পায়চারি করলেন ঘরের যেটুকু খোলা জায়গা আছে, সেখানে। একটু পর বললেন, ফোন করছে না কেন তোমাদের বন্ধু? কী হচ্ছে হাসপাতালে? এত সময় নিচ্ছে কেন ফোন করতে?
দ্বিতীয় যুবক বললো, ইমার্জেন্সি থেকে জানালো একজন হার্ট পেশেন্টকে ভর্তি করা হয়েছে একটু আগে। তিনি আপনার হাজবেন্ডই হবেন।
ফিরোজা বেগম উদ্বিগ্ন স্বরে বললেন, কিন্তু তোমাদের বন্ধু ফোন করছে না কেন? তাকে ফোন করে দেখো।
দ্বিতীয় যুবক বললো, কয়েকবার করেছি। ফোন বন্ধ।
এই কথার আধ ঘণ্টা পর সিঁড়িতে পায়ের শব্দ শোনা গেল। মনে হলো, একজনের না, কয়েকজনের। বেশ ভারী শব্দ সেই শব্দ পায়ের। ফিরোজা বেগম দুই যুবককে নিয়ে বাইরের দরজা খুলতেই দেখলেন চারজন পুলিশ সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে আসছে, তাদের সামনে প্রথম যুবক। তার দু’হাত পিছনে বাঁধা। ঠোঁট ফুলে গিয়েছে, রক্ত বের হচ্ছে। নাক থেতলে গিয়েছে। একটা চোখ ফুলে আছে। সে হাপাচ্ছে।
পুলিশরা রাইফেল উঁচিয়ে হুঙ্কার দিয়ে এসে দ্বিতীয় আর তৃতীয় যুবককে বাট দিয়ে মেরে মাটিতে ফেলে লাথি মারতে থাকলো। তারপর উঠিয়ে পিছনে হাত বেঁধে নিয়ে ফিরোজা বেগমের দিকে তাকিয়ে রুষ্ট স্বরে বললো, আমরা আসছি। আপনাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
নিচে নামার আগে প্রথম যুবক ঘড়ঘড় স্বরে ফিরোজা বেগমকে বললো, আপনার হাজবেন্ড আইসিইউ-তে আছেন। এখন তার অবস্থা স্টেবল।
পুলিশের দল একটু পর গালি দিয়ে তিন যুবককে মারতে মারতে নিচে নিয়ে গেল। ফিরোজা বেগম পিছনে পিছনে এসে সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে চেচিয়ে বললেন, ওদের এভাবে মারছেন কেন? ওরা চোর বদমায়েশ না।
পথরেখা/এআর