পথরেখা অনলাইন : দেশকন্ঠ অনলাইন : উপন্যাসে ক্রমাগত প্রশ্ন উত্থাপন করার পক্ষে সাফাই গেয়েছেন উইলিয়াম ফকনার। তবে উপন্যাস বলতে আমরা সাধারণত বুঝে নেই বিস্তৃত গদ্য বা আখ্যান। সেই বর্ণনা ব্যক্তি বা জনপদকে আশ্রয় করে এগিয়ে যায়। উপন্যাসের উপাদান জীবনকে আরও একটু গভীরে স্পর্শ করে এবং প্রকৃত ঘ্রাণ ছড়ায়। জীবন যাপনের বাঁকগুলো খুটিয়ে খুটিয়ে দেখানো হয় বাংলা উপন্যাসে। কিন্তু একালে উপন্যাস গল্প, বস্তু, চরিত্র, জনপদ, জন ও জীবন গোগ্রাসে গিলে প্রশ্ন নিয়ে উপস্থাপিত হওয়ার আধুনিক এবং যৌক্তিক দাবি রাখে। ঔপন্যাসিক মুম রহমান সেই দাবি পূরণ করছেনে।
মুম রহমান কবি, গল্পকার এবং অনুবাদক হিসেবে অধিক পরিচিত। উপন্যাসে হাজির করেছেন প্রাচ্যের নানাবিধ এবং নানামুখী দর্শন। বর্ণনায় কখনো বৈঠকি,কখনো খৈলান, কখনো মঞ্চ ঢং আশ্রয় করেছেন। বাউল সাধকেরা যেমন নিজ নিজ সৃষ্টিকর্মের মধ্যে নিজের নাম অবলীলায় প্রবেশ করান, ঔপন্যাসিকও নিজের নাম নিয়েছেন। তিনি ক্লাসিক আর ফিউশনের যোগসূত্র তৈরি করেছেন। প্রাচ্যের উপমা নিয়ে গেছেন জাপানের হাইকুর কাছেও। তারপর আবার ফিরে এসেছেন বলিউড পাড়া থেকে বাংলা চলচ্চিত্রের সংলাপ কিংবা নায়িকার লাজুক ও অভিমানআশ্রিত কথামালায়।
উপন্যাসের নাম তিনি রেখেছেন ‘মানুষরতন’। ভাঙলে মানুষ+রতন। উল্টো করে বলা যায় রতনমানুষ বা মানুষই রতন। ঔপন্যাসিকের বিস্তৃত পাঠ পরিধির ধকল পাঠককেও নিতে হবে। না হলে এই ভ্রমণ মধুর হবে না। এটাকে কখনো প্রবন্ধ, কখনো নিবন্ধ, কখনও গল্প, কখনও গদ্য আকারে এগিয়ে নিয়েছেন তিনি। প্রস্থানপর্ব দিয়ে শুরু করে প্রত্যাবর্তন পর্ব দিয়ে শেষ করেছেন। ভাবনার বিস্তৃতি দিতে একের পর এক প্রশ্ন হাজির করেছেন। প্রশ্ন উত্থাপনে দারস্থ হয়েছেন লালন সাঁই, জালাল উদ্দীন খাঁ, রসিদ উদ্দিন, পাগলা কানাই, হাসন রাজা, শঙ্করাচার্য, মেছের শাহ, দীন শরৎ, দুদ্দু শাহ, মনোমোহন দত্ত, শেখ ভানু, পাঞ্জু শাহ, মনসুর বয়াতি, উকিল মুনশি, বিজয় সরকার-এর ভাব, গতি, ভাষা ও মানসচরিত্ররে কাছ। তিনি শরণাপন্ন হয়েছেন লোক ধাঁধার। গালিব থেকে আমির খান বর্ণনায় বসে গেছেন মোটিফ হিসেবে।
উপন্যাসের মূল চরিত্র রতন। তার সঙ্গে পাঠককে একটা ভ্রমণে গিয়ে ফিরে আসতে হবে যেখান থেকে যাত্রা শুরু হয়েছিল সেখানেই। ঔপন্যাসিক শেষে প্রশ্ন রেখেছেন, কার সাধ্য আছে এই দুস্তর সংসার পার হওয়ার? তিনি বৈরাগ্যের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে শেষে দেখিয়েছেন যতোই বলা হোক সবই মায়া,মায়াই সংসার সাজায়। আর সংসার যদি না থাকতো তাহলে তো সব আয়োজন বৃথা।
প্রতিটি কর্মকে সাধনা হিসেবে দেখানো হয়েছে। কর্ম এখানে ঢেউ। ব্যক্তি এখানে একজন মাঝি। যে নিজের কর্মপরিধি সম্পর্কে জ্ঞাত। অন্য কিছু সম্পর্কে তার জানা-না জানা বিশেষ গুরুত্ব বহন করে না। শেষতক মানুষ নিজেকে অনেকাংশে নিশ্চিত ব্যস্ততায় ঠেলে দিয়ে বিশ্বের বস্তু মালিকানা অর্জনে। এই দৌড়ে হারিয়ে যাচ্ছে মানুষের নিজের সঙ্গে নিজের কথা বলার সময়টুকুও। হাসি, কান্না, রাগ, ক্ষোভ এখানে একই রকম ক্ষমতাসম্পন্ন শব্দ বা তরবারি। এগুলো আত্মরক্ষা এবং হত্যার জন্য ব্যবহার করা যায় বলেই লেখক উপস্থাপন করেছেন। এগুলোর আদতে একক কোনো অর্থ নেই। মানুষ যখন অনেক কিছু পেতে যায় তখনও কিছু ছেড়ে যায়। উপন্যাসের রতনও তাই।
সে স্নেহময়ী মা, কঠোর বাবা, হবু স্ত্রীকে ছেড়ে চলে যায় অপর মানুষের কাছে। একটা পর্যায়ে তার জায়গা হয় একটি গ্রামে। বিশ্বায়নের সব বৈশিষ্ট্য ওই গ্রামের চরিত্রে ফুটে ওঠে। যেখানে গ্রাম প্রধান উপস্থাপিত হয়েছেন অস্বীকৃত এবং স্বীকৃত সন্তানের পিতা হিসেবে। অস্বীকৃতকেই নিজের স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য যতভাবে ব্যবহার করা যায় ততভাবে ব্যবহার করছেন তিনি। যিনি ব্যবহৃত হচ্ছেন তিনি জানেন না হত্যা, জখমের আদেশ যিনি দেন তিনিই তার পিতা। সন্তান হিসেবে তার প্রাপ্ত অধিকারও তার জানার কথা নয়। আর স্বীকৃত সন্তান কখনও দাঙ্গাবাজ, কখনো প্রেমিক। যে দূরবর্তীকে ভালোবাসার ইচ্ছা পুষে রাখে। প্রেমই যাকে মানুষ হওয়ার জন্য তাড়িত করে।
অন্যদিকে অস্বীকৃত সন্তানও একদিন জেনে যায় তিনিও ওই মাতব্বরের সন্তান। জানার এই যে কাঠামো প্রাতিষ্ঠানিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে এসএসসি, এইচএসসির পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা গ্রহণের যে উপায় তার সঙ্গে তুলনা চলে। অপ্রাতিষ্ঠানিক দৃষ্টিতে প্রকৃতিতে, নিভৃতে, অনেকের মধ্যে একা হয়ে, বহুকাল নিরবতা পালন করে নিরবতা ভেঙে বেরিয়ে আসার মতো। যার জন্য জানে সে এখানে ম্যাসেঞ্জার হিসেবে আবির্ভূত। দীর্ঘ পথ একা হেঁটে, সংসার ত্যাগ করে সংসারের সার কথা যে আয়ত্ব করেছে, সংসার সাগরের উপরিতল যে দেখতে পায়, যে দৃষ্টিহীনকে দৃষ্টি দিতে পারে সেই রতন। যেভাবে একজন বুদ্ধ সংসারের জন্য সুষমার যোগান দিয়ে গেছেন। রতনও তাই।
রতনকে যে বুঝতে পারে, অথবা যারা নিজেদের চিন্তা চেতনা দিয়ে পরিমাপ করে সঠিক ওজন করতে পারে না অথচ রতনের প্রতি বিমোহিত হন,তারা তাকে মানুষের অধিক ভাবতে চান। রতন আসলে মানুষ হতে চায়। মানুষের মতো সংসারের ডাকে সে আবার ফেরে মায়ের কাছে। সন্তানের ফেরা কঠোর পিতাকে ভেতরে ভেতরে আনন্দে ভাসিয়ে দেয়। তবুও সে মায়ের মতো প্রকাশিত হতে পারে না। সংসারে পিতার এই অসহায়ত্ব ফুটে ওঠে তার সংলাপে, যে সংলাপ স্নেহমাখা- ওরে বইলো, আমিও বাপ। আমারও কলিজা আছে। ওরে বইলো ছেলের জন্য বাবার প্রাণও কাঁদে। সন্ন্যাসী সাঁইজা আইছে, অথচ এ ছেলে আমারেও চিনলো না, তুমিও আমারে চিনলা না।’
মানুষরতনে রতনের সঙ্গে দর্শনের এক দীর্ঘপথ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা দেবে পাঠককে। ব্যক্তি নিজেকে গোপনে গোপনে পাপীও ভাবে আবার সাধুও ভাবে। এই দুই ভারও কিছুটা কমিয়ে দেবে মানুষরতন পাঠের অভিজ্ঞতা। মানুষরতন পাঠ শুভ হোক।
পথরেখা/এআর