• সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
    ৯ পৌষ ১৪৩১
    ঢাকা সময়: ০১:১৪

বাইডেন ট্রাম্প ও গণতন্ত্রের সৌন্দর্য

  • মত-দ্বিমত       
  • ০৬ আগস্ট, ২০২৪       
  • ৫৪
  •       
  • ০৬-০৮-২০২৪, ২২:৫৯:০৯

সেলিম খান, প্রভাত  : বয়স বাড়লে মানুষ যে প্রজ্ঞার অধিকারী হয় তা আরও একবার প্রমাণ হলো। প্রমাণ করলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। অনেক গোঁয়ার্তুমির পর আগামী নভেম্বরে অনুষ্ঠেয় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের লড়াই থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিয়ে এবং একই সাথে ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসকে প্রেসিডেন্ট পদে ডেমোক্র্যাট দলের প্রার্থী হিসেবে সমর্থন দিয়ে। তাঁর এই দুটি সিদ্ধান্ত যেন ম্যাজিকের মতো কাজ করেছে।

বেশ কিছু দিন আগে আমেরিকার সাংবাদিক বন্ধুরা ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় আমাকে বলেছিলেন, বাইডেনকে সরে যেতেই হবে। কারণ ডেমোক্রেটিক দলের পক্ষ থেকে তাঁর ওপর চাপ বাড়ছে। এত চাপ এই বৃদ্ধের পক্ষে নেওয়া সম্ভব না। তবে বাইডেনের প্রার্থী থাকার খায়েশে শেষ পেরেকটি ঠোকেন বারাক ওবামা। কারও কাছে অবিশ্বাস্য মনে হলেও এটা কঠিন সত্য যে, বারাক ওবামা এখনো ডেমোক্রেটিক পার্টিতে সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা। তাঁর কথায় দলের অনেক কিছুই ঠিক হয়। প্রায় আট বছর আগে প্রেসিডেন্ট পদ থেকে সরে গেলেও এই কৃষ্ণকায় মানুষটির জনপ্রিয়তা এখনো অটুট। কৃষ্ণকায় শব্দটির মধ্যে অনেকে বর্ণবাদী গন্ধ পেতে পারেন, এতে দোষের কিছু নেই। তবে শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে এটা বোঝানোর জন্য যে, ট্রাম্পের শ্বেতাঙ্গ-প্রভুত্বের ধ্বজা ওড়ানো আমেরিকার পাশাপাশি আরও একটি উন্নত আমেরিকা যে আছে, তা।

 আমেরিকার সাংবাদিক বন্ধুদের বক্তব্য ছিল, ৮১ বছরের এক অশক্ত নেতার পেছনে থেকে ডেমোক্র্যাটরা বুঝে গেছেন, ২০২৪-এ তাঁদের কোনো সুযোগ নেই। ট্রাম্প আসছেনই। আর ফিলাডেলফিয়ার গুলির ঘটনার পর সে সম্ভাবনা আরও বেগবান হয়েছে। ফলে তাঁরা চাইছেন, কমলা হ্যারিসকে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন এবং তাঁর সাথে একজন উপযুক্ত রানিং মেট দিয়ে এ যাত্রা কোনোমতে পার করা। তাঁদের লক্ষ্য ২০২৮। আর ওই সময় ট্রাম্প থাকবেন না। ফলে হারের ধাক্কাটা কমলার ওপর দিয়ে পার করে দিয়ে তাঁর রানিং মেট বা অন্য কোনো তরুণ নেতাকে ২০২৮-এর নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত করা।

এই বক্তব্যে বাইডেনকে সরানোর বিষয়টি বিশ্বাস হলেও কমলাকে প্রার্থী করাটা কষ্ট-কল্পনা বলেই মনে হয়েছিল। তারপরও ভেবেছিলাম, বলির পাঁঠা তো কাউকে না কাউকে হতেই হয়। আর শব্দটি যখন ভারতীয় ভাষার সাথে যুতসই, তখন ভারতের সাথে সামান্যতম সম্পর্ক আছে এমন কারোর ওপর প্রয়োগ করাটাই দস্তুর বলে মনে করছেন ডেমোক্রেটিক দলের শীর্ষ নেতারা। হতেই পারে। কয়েক দিন আগে দেখলাম এই আখ্যান পুরোপুরি মিলে যাচ্ছে। বাইডেন নিজে কমলার নাম প্রস্তাব করছেন শিখণ্ডী হিসেবে। রাজনীতির নির্মমতা কোন পর্যায়ে যেতে পারে, তা ওপরের কাহিনি থেকে পরিষ্কার।

বাস্তবতা হলো, কাহিনি এখানে শেষ হলে তা একেবারে পানসে হয়ে যেত। কিন্তু সেটা হতে দেননি কমলা। বাইডেনের ঘোষণার পর এক অদ্ভুত ম্যাজিক দেখল সবাই। যে কমলা হ্যারিসকে এত দিন কেউ গোনার মধ্যে ধরেনি, সেই তিনি কিনা ভগ্নপ্রায় দলে নতুন করে প্রাণসঞ্চার করলেন। বিমর্ষ, হতোদ্যম ডেমোক্রেটিক দলটাকে এক লহমায় চাঙা করে তুললেন। দলের সদস্যরা আশাবাদী হয়ে উঠল। বুঝুন অবস্থাটা। বাইডেনের মতো একজন ঝানু রাজনীতিক দলটাকে কোথায় নিয়ে গিয়েছিলেন, আর এক কৃষ্ণকায় ও অভিবাসী নারী রাজনীতিক ডুবতে বসা দলটাকে কোথায় টেনে তুললেন।

কথায় কথায় মার্কিন অভিবাসীদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগটি করা হয়, তা কতটা যুক্তিহীন, অসার–কমলা হ্যারিসের এই উত্থান তার প্রমাণ। এখন তাঁকে চ্যালেঞ্জ করার মতো নেতাই ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে খুঁজে পাওয়া কঠিন। তবে এর অর্থ এই না যে, ওই দলে আর কোনো যোগ্য নেতা নেই। বরং এত অল্প সময়ে (৩ মাস) ট্রাম্পের মতো প্রতিযোগীর বিরুদ্ধে একেবারে আনকোরা মুখ নিয়ে আসাটা অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত কমলাই ডেমোক্রেটিক পার্টির সর্বোত্তম প্রার্থী। যদি সবকিছু ঠিক থাকে, তাহলে আগস্টের দলীয় সম্মেলনে তিনি ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন পেতে চলেছেন, তা একপ্রকার নিশ্চিত।

আমেরিকার প্রেক্ষাপটে দুটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। এক. প্রেসিডেন্ট বাইডেনের বিলম্বিত বোধদয়। তিনি ৮১-তে পৌঁছেও মানতে পারছিলেন না–রাজনীতিতে তাঁর থাকার দিন শেষ। এমনকি প্রথম বিতর্কে ট্রাম্পের কাছে পর্যুদস্ত হওয়ার পরও। ক্ষমতার রাজনীতি মানুষকে কতটা চিন্তাহীন করে তোলে তার বড় প্রমাণ বাইডেনের দীর্ঘ একগুঁয়েমি।

দুই. ট্রাম্পের অজানা বিপদ। এতদিন এক বৃদ্ধ রাজনীতিককে রীতিমতো অকথ্য ভাষায় আক্রমণ করে তিনি নিজের জায়গা অনেকটাই পোক্ত করে ফেলেছিলেন। আর ৭৮ বছর বয়সে গুলির মুখ থেকে বেঁচে আসার পরে তিনি প্রায় ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যান। কিন্তু দৃশ্যপট থেকে বাইডেনের এই আচমকা বিদায় তাঁর জন্য এক বড় ধাক্কা। এতদিন বাইডেনকে ঘিরে তিনি যে প্রচার চালিয়ে এসেছেন, তার পুরোটাই পানিতে গেছে। মঞ্চে এখন একেবারে নতুন এক প্রতিদ্বন্দ্বী, যাকে তিনি কখনো আমলে নেননি। আর এই মুহূর্তে তো ডেমোক্র্যাটদের আনুষ্ঠানিক ঘোষিত কোনো প্রার্থীই নেই। তাহলে তিনি কথা বলবেন কাকে নিয়ে? কমলাকে নিয়ে? কমলা যদি চূড়ান্ত মনোনয়ন না পান, তাহলে সে প্রচারও তো পানিতে যাবে। বিদায়ের আগে কী এক মুশকিলে ট্রাম্প সাহেবকে ফেলে গেলেন প্রেসিডেন্ট বাইডেন। কোনো মানে হয়! এর ওপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে এসেছে জনপ্রিয়তার সূচক, যা কিনা সবসময় ট্রাম্পের পক্ষেই থেকেছে। মঞ্চের নট-নটী পরিবর্তনের সাথে সাথে রয়টার্স ও সিএনএন-এর পৃথক দুটি জরিপ জানাচ্ছে, কমলা জনপ্রিয়তার নিরিখে ট্রাম্পের চেয়ে দুই পয়েন্ট এগিয়ে আছেন। অথচ এমনটি হওয়ার কথা ছিল না। বরং ট্রাম্প ২০ পয়েন্টে এগিয়ে থাকলেও কেউই বিস্মিত হতেন না।

আইনশাস্ত্রে পড়াশোনার পর স্বাভাবিকভাবে কমলা একজন আইনজীবী হিসেবে পেশাগত জীবন শুরু করেন। কিন্তু এর পরে তাঁর উত্থান বিস্ময়কর। ২০০৩ সালে সান ফ্রান্সিসকোর ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নি, ২০১০-এ ক্যালিফোর্নিয়া মতো বড় অঙ্গরাজ্যের অ্যাটর্নি জেনারেল, ২০১৬ সালে সিনেটর, ২০২০-এ ভাইস প্রেসিডেন্ট–দুই অভিবাসীর সন্তান হিসেবে তিনি সবকিছুতেই প্রথম। হয়তো প্রেসিডেন্ট হিসেবেও। বাবা জ্যামাইকা ও মা ভারত থেকে যাওয়া অভিবাসী। ফলে আফ্রিকান-আমেরিকান পরিচয়ের পাশাপাশি ভারতীয়ত্বের ছাপ লেপ্টে আছে তাঁর গায়ে। আমেরিকার ক্ষমতাধারী পুরুষেরা (বিচারপতি থেকে রাজনীতিক সবাই) যখন গর্ভপাত, অভিবাসনসহ বিভিন্ন ইস্যুতে দেশটাকে মধ্যযুগে নেওয়ার চেষ্টা করেছেন, তখনই কমলা ছিলেন এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রতিমূর্তি। তাঁর উদারমনা মনোভাব, সোজাসাপটা কথাবার্তা–তরুণদের কাছে জনপ্রিয়তা পেয়েছে।

তারপরও কমলা হ্যারিস দলের মনোনয়ন পাবেন কিনা, পেলেও জিতবেন কিনা–সেসব অনেক দূরের প্রশ্ন। কিন্তু গণতান্ত্রিক ধারায় নির্বাচনের মধ্যে যে অন্তর্নিহিত সৌন্দর্য আছে, সেটাই এখানে ফুটে উঠেছে। এই সৌন্দর্যের স্বাদ বিশ্বের গণতন্ত্রপ্রেমীরা পেয়েছে ভারতে শক্তিশালী বিরোধী দলের আত্মপ্রকাশের মধ্যে; যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সে দক্ষিণপন্থীদের ভরাডুবির মধ্যে; একইভাবে বাইডেনের সরে দাঁড়ানো ও ট্রাম্পকে নড়বড়ে করার মধ্য দিয়ে। সব ঘটনার শিক্ষা একটাই, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় মানুষ খুব একটা ভুল করে না। ভুল করলেও শুধরে নেয়। তাই তাদের ওপর আস্থা রাখাটাই শ্রেয়।

সেলিম খান: নির্বাহী সম্পাদক, ডিজিটাল মিডিয়া, ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশন
পথরেখা/এআর

  মন্তব্য করুন
আরও সংবাদ
×

পথরেখা : আমাদের কথা

আমাদের পোর্টালের নাম— pathorekha.com; পথরোখা একটি অনলাইন নিউজ পোর্টাল। আমরা এই প্রতিষ্ঠানকে প্রতিদিনের সত্য-সংবাদের পথরেখা হিসেবে প্রমাণ করতে চাই। পথরেখা সারাদেশের পাঠকদের জন্য সঠিক ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ এবং মতামত প্রকাশ করবে। পথরোখা নিউজ পোর্টাল হিসেবে ২০২৩ সালের জুন মাসে যাত্রা শুরু করলো। অচিরেই পথরেখা অনলাইন মিডিয়া হিসেবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ে নিবন্ধনের প্রক্রিয়া শুরু করবে। পথরোখা  দেশ কমিউনিকেশনস-এর অঙ্গ প্রতিষ্ঠান।
 
পথরোখা জাতীয় সংবাদের উপর তো বটেই এর সঙ্গে রাজনীতি, আন্তর্জাতিক, খেলাধুলা, কৃষি, বিনোদন, অর্থনীতি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, তথ্য ও প্রযুক্তিসহ বিভিন্ন বিভাগকেও গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করে। মাল্টিমিডিয়া সাংবাদিকতা এবং চৌকস ফটোগ্রাফিকে বিশেষ বিবেচনায় রাখে।
 
পথরোখা’র সম্পাদক আরিফ সোহেল এই সেক্টরে একজন খুব পরিচিত ব্যক্তিত্ব। সাংবাদিক হিসেবে তার দীর্ঘ ৩০ বছর কর্মজীবনে তিনি দৈনিক বাংলাবাজার পত্রিকা, আজকের কাগজ, রিপোর্ট২৪ ডটকম প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন। এ ছাড়া তিনি সরকারী ক্রীড়া পাক্ষিক ‘ক্রীড়া জগত’ ও লাইফস্টাইল ম্যাগাজিক অপ্সরা নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন। তিনি জনপ্রিয় অনলাইন দেশকণ্ঠের নির্বাহী সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।
 
পথরেখা দেশের মৌলিক মূল্যবোধ, বিশেষ করে জাতীয় সার্বভৌমত্ব, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ। এছাড়াও, এটি দেশের নাগরিকের মানবিক ও নাগরিক অধিকারের পক্ষে কথা বলবে। ন্যায়পরায়ণতা, নির্ভুলতা এবং বস্তুনিষ্ঠতা বজায় রাখতে আমরা অঙ্গীকারাবদ্ধ। আমরা বিশ্বাস করি যে জনগণের বিশ্বাসযোগ্যতা আমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। পথরেখা রাজনৈতিক ইস্যুতে নির্দলীয় অবস্থান বজায় রাখবে। একটি নিরপক্ষ অনলাইন হিসেবে আমরা নিজেদের কর্মকাণ্ডে প্রমাণ করার শতভাগ প্রছেষ্টা করব। তবে সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করেও কিছু ভুল হতেই পারে। যা ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রাখছি সব মহলেই। সততা পথে অবিচল; আলোর পথে অবিরাম যাত্রায় আমাদের পাশে থাকুন; আমরা থাকব আপনাদের পাশে।
 
উল্লেখ্য, পথরেখা হিসেবে একটি প্রকাশনী দীর্ঘদিন থেকে প্রকাশিত হয়ে আসছে। এবার উদ্যোগ নেওয়া হলো অনলাইন অনলাইন নিউজ পোর্টাল হিসেবে প্রকাশ করার।