পথরেখা অনলাইন : দেশের প্রখ্যাত কৃষি গবেষকরা কৃষক থেকে ভোক্তা পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ে খাদ্য অপচয়ের মাধ্যমে উৎপাদন-উত্তর ফসলের ক্ষতি কমানোর প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেছেন এটি খাদ্য নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি। কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ফসল তোলার পরে ক্ষতির কারণে বছরে দেশে এখন প্রায় ১৬ মিলিয়ন টন খাদ্যশস্য বিনষ্ট হচ্ছে।
বাংলাদেশ গত কয়েক দশকে খাদ্য উৎপাদনে উল্লেখযোগ্য উন্নতি করেছে এবং মাথাপিছু খাদ্যের প্রাপ্যতা বৃদ্ধি পেয়েছে, তবে ফসল কাটার পরের ক্ষতি এবং খাদ্যের অপচয় সামগ্রিক খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনে ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতি তৈরি করেছে।
২০০০ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত গত দুই দশকে ধানের ৬২ শতাংশ, ভুট্টা ৫৪২ শতাংশ, আলু ২২৫ শতাংশ, ডাল ১৪৪ শতাংশ, তৈলবীজ ৩১০ শতাংশ এবং শাকসবজির উৎপাদন ১৯৭ শতাংশ বেড়েছে।
কিন্তু ধান কাটার পর ১২ শতাংশ, ভুট্টা ১৩, আলু ২০, ডাল ও তৈলবীজের প্রতিটি ১৫ শতাংশ এবং সবজির ২৫ শতাংশ ক্ষতি হয়েছে বলে কৃষি মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে।
দুধ উৎপাদনের ক্ষেত্রে, সংগ্রহের পরের ক্ষতি ৯ দশমিক ০৭ শতাংশ। এতে দেশে প্রতি বছর মোট ক্ষতি ১ দশমিক ২৮ মিলিয়ন টন।
পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, মাংস সংগ্রহে ক্ষতির পরিমাণ ৬ দশমিক ৯ শতাংশ, মাছের ক্ষেত্রে ৭ শতাংশ এবং ডিম উৎপাদনে ১২ দশমিক ৯ শতাংশ।
সার্ক কৃষি কেন্দ্রের পরিচালক (এসএসি) ড. মো. হারুনুর রশীদ বলেন, বাংলাদেশের এক তৃতীয়াংশ উদ্যানজাত পণ্য, প্রধানত শাক-সবজি এবং ফল সংরক্ষণ ও গুদামজাত সুবিধা এবং সঠিক পরিবহন ব্যবস্থার অভাবে নষ্ট হয়ে যায়।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের (ডিএই) কর্মকর্তারা বলেছেন যে ফল ও সবজির উৎপাদন বৃদ্ধির হার প্রায় দশ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে তবে এক্ষেত্রে ফসল কাটার পরে অপচয় একটি বিশাল উদ্বেগের বিষয় হয়ে উঠেছে এবং এ বিষয়ে এখনো কোনো সমাধান নেই।
ডিএই এবং জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) তথ্য মতে, বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম ধান, আলু, কাঁঠাল, আম ও পেয়ারা উৎপাদনকারী দেশ।
২০১৯-২০ অর্থবছরে, ৫ দশমিক ২৬ কোটি টন চাল উৎপাদন করে বাংলাদেশ বিশ্বে চতুর্থ স্থানে রয়েছে এবং সবজি উৎপাদনে প্রতি বছর ১ দশমিক ৬ কোটি টন উৎপাদন করে দেশটি বিশ্বে তৃতীয় স্থানে রয়েছে। ১ দশমিক ২ কোটি টন আলু উৎপাদন করে ষষ্ঠ স্থানে রয়েছে।
এক বছরে ১০ লাখ টন কাঁঠাল উৎপাদন করে বাংলাদেশ দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে এবং বার্ষিক ২৪ লাখ টন আম উৎপাদে করে অষ্টম সাথানে রয়েছে।
কৃষি-বিশেষজ্ঞদের অভিমত, বাংলাদেশে ফসল তোলার পর অপচয় কৃষকদের তাদের কঠোর পরিশ্রম সত্ত্বেও সর্বোচ্চ মুনাফা থেকে বঞ্চিত করছে।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের পোস্টহার্ভেস্ট প্রযুক্তি বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হাফিজুল হক খান বলেন, ফল ও শাকসবজি বাংলাদেশের কৃষি পণ্যের অপচয় হওয়ার জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ কারণ এতে প্রচুর পানি থাকে।
তিনি বলেন, ‘উৎপাদক থেকে ভোক্তা পর্যায়ে এই পণ্যগুলোর জন্য গুদামজাতকরণ, সংরক্ষণ ও পরিবহনের জন্য কোনো পরিকল্পিত ব্যবস্থাপনা নেই’। খান যোগ করেন যে ক্ষয়ক্ষতির নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পর্কে সম্পূর্ণ ধারণা দেওয়া সম্ভব নয়।
বিজ্ঞানী হারুনুর রশীদ ফসল তোলার পরে ক্ষতির চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় শক্তিশালী কোল্ড চেইন অবকাঠামো উন্নয়নে বিনিয়োগের পরামর্শ দিয়েছেন।
বর্তমানে সারা দেশে ৬০ লাখ টন সম্মিলিত ক্ষমতা সম্পন্ন ৪শ’ টিরও বেশি হিমাগার চালু রয়েছে যেগুলো মূলত আলু সংরক্ষণের জন্য ব্যবহৃত হয়। এই ধরনের হিমাগার ফল ও সবজি সংরক্ষণের উপযুক্ত নয়।
শহরের তেজগাঁওয়ে ১,০০০ টন ধারণক্ষমতার একটি ব্যক্তিগত মালিকানাধীন বিশেষ হিমাগার রয়েছে যেখানে শুধুমাত্র আমদানি করা ফল সংরক্ষণ করা হয়। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাছে ১২০ টন ধারণক্ষমতা সম্পন্ন শাকসবজি ও ফলের জন্য আরেকটি বিশেষায়িত হিমাগার রয়েছে, যেটি শুধুমাত্র রপ্তানিকারকরা ব্যবহার করেন।
এমতাবস্থায় কৃষি বিপণন অধিদপ্তর সারাদেশে ৩,০০০ টন শাকসবজি বা ফল সংরক্ষণের সম্মিলিত ক্ষমতা সম্পন্ন ২৫টি বিশেষায়িত হিমাগার স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে।
সরকারি অর্থায়নে (জিওবি) ২৭০ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি ২০২৪ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে বাস্তবায়িত হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
কৃষি বিপণন বিভাগের পরিচালক (শস্য ঋণ ও গুদাম ব্যবস্থাপনা) ড. ফাতেমা ওয়াদুদ বলেন, প্রস্তাবিত প্রতিটি হিমাগারের ধারণক্ষমতা হবে ৩শ’ টন থেকে ৫শ’ টন। সব মিলিয়ে হিমাগারের মোট ধারণ ক্ষমতা হবে ৩ হাজার টন।
এসডিজি’র ১২ দশমিক ৩ অনুযায়ী, এটি খুচরা ও ভোক্তা পর্যায়ে মাথাপিছু বিশ্বব্যাপী খাদ্য বর্জ্য ২০৩০ সালের মধ্যে অর্ধেক করার এবং উৎপাদন ও সরবরাহ শৃঙ্খলে খাদ্য ক্ষয়ক্ষতি হ্রাস করার আহ্বান জানানো হয়েছে, যার মধ্যে ফসল তোলার পরের ক্ষতিও রয়েছে।
পথরেখা/এআর