সুধীর বরণ মাঝি, পথরেখা অনলাইন : নিরাপদ খাদ্য মানুষের মৌলিক অধিকার। আমরা বাঁচার জন্য খাই। সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য খাই। জীবন ধারণের জন্য খাদ্যের বিকল্প নেই। কিন্তু প্রতিদিন খাদ্যের নামে যা খাচ্ছি, তা কতটুকু নিরাপদ? চারিদিকে শুধু দেখি ভেজালের সমারোহ। নিরাপদ খাদ্যের অভাবে জাতীয় স্বাস্থ্য আজ হুমকির মুখে। সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য নিরাপদ খাদ্যের বিকল্প নেই। কিন্তু আমরা প্রতিদিন টাকা দিয়ে খাদ্যের নামে বিষ কিনে খাচ্ছি। সুস্বাস্থ্যের জন্য প্রতিটি মানুষের প্রয়োজন বিশুদ্ধ, নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্য। বিশুদ্ধ, নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্য সুস্থ ও সমৃদ্ধিশালী জাতি গঠনে একান্ত অপরিহার্য। সুস্বাস্থ্য ছাড়া আমাদের সকল প্রয়োজনই ব্যর্থ। সুস্বাস্থ্যের জন্য চাই নিরাপদ খাদ্য, নিরাপদ পরিবেশ এবং অর্থনৈতিক নিরাপত্তা। সুস্থ খাবার সুস্থ জীবন বা নিরাপদ খাদ্য, নিরাপদ জীবন, নিরাপদ জাতি। কিন্তু আমাদের দেশে বিশুদ্ধ, নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্যপ্রাপ্তি কঠিন করে ফেলেছে কিছু বিবেকহীন অতি মুনাফালোভী ব্যবসায়ী ও আড়তদার। উৎপাদন থেকে শুরু করে বাজারজাতকরণ পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে খাদ্যকে অনিরাপদ এবং বিষে পরিণত করা হচ্ছে।
১৭ কোটি মানুষ রয়েছে ভেজাল আতঙ্কে। সুস্থভাবে বেঁচে থাকা আমাদের মৌলিক এবং সাংবিধানিক অধিকার। সেই নিশ্চয়তা নিশ্চিত করা একটি রাষ্ট্রের প্রধান কাজ। আমরা খাই বাঁচার জন্য, মৃত্যুর জন্য নয়। খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার কারণে কিডনি, লিভার, ক্যান্সার এবং হৃদরোগের পরিমাণ অকল্পনীয় হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। খাদ্য মানুষের পুষ্টি চাহিদা পূরণ করে সুস্থ সবল রাখে এবং মানুষকে কর্মক্ষম করে তোলে। কিন্তু খাদ্যের নামে আমরা কি খাচ্ছি, আসলে তা খাদ্য না বিষ! আসলে আমরা খাদ্যের নামে টাকা দিয়ে প্রতিনিয়ত বিষ কিনছি। ভেজাল খাদ্য আমাদের প্রতিনিয়ত মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে। আমরা অসুস্থ হয়ে পড়ছি। অসুস্থ মানুষ পরিবার, সমাজ, দেশ ও জাতির জন্য বোঝাস্বরূপ। অসুস্থ ব্যক্তির পেছনে অতিরিক্ত সময়, অর্থ এবং চিন্তা ব্যয় করতে হয়। অপচয় ঘটে কর্মঘণ্টার। ভেজাল খাদ্যের ফলে আজ কোটি কোটি মানুষের জীবন হুমকির সম্মুখীন। এখন খাদ্য মানেই ফরমালিন, কার্বাইড, হাইড্রোজ, পারক্সাইড, এসপারটেম, ইথোফেনসহ নানা ক্ষতিকর রং ও বিষ। আমরা অসহায়। আমরা জিম্মি ভেজালকারীদের নিকট। এই অবস্থা আর কতদিন চলতে থাকবে একটি দেশে? ভেজাল খাদ্যের পাশাপাশি সক্রিয় আছে ভেজাল এবং মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধের সরবরাহকারী সিন্ডিকেট। ভেজাল এবং মেয়াদোত্তীর্ণের কারণে জীবন রক্ষাকারী ওষুধ জীবনধ্বংসকারী হিসেবে কার্যকর ভূমিকা পালন করে।
একদল অতিলোভী মুনাফাকারী ব্যবসায়ীদের লালসার শিকার হচ্ছি আমরা প্রতিনিয়ত। খাদ্যে ভেজালের কারণে জাতীয় স্বাস্থ্যসেবা এবং অর্থনীতি হুমকির মুখে। ভেজাল খাদ্যের কারণে রোগাক্রান্ত শিশু জন্ম নিচ্ছে এবং পুষ্টিহীনতায় ভুগছে। ফলে, আমাদের সামনে দৃশ্যমান একটি অপুষ্ট এবং অসুস্থ জাতি। যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। খাদ্যে ভেজালের কারণে আশঙ্কাজনক হারে বিভিন্ন রকমের ক্যান্সার, লিভার সিরোসিস, কিডনি ফেইলউর, হৃদযন্ত্রের অসুখ, হাঁপানি ইত্যাদি জটিল রোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। হাসপাতাল ও ডাক্তারের কাছে রোগীর লাইন আরও দীর্ঘ থেকে দীর্ঘ হচ্ছে। নিরাপদ খাবার উপহার দিতে না পারলে একসময় জাতি পঙ্গু হয়ে যাবে। শুধু খাদ্যে ভেজালের কারণে দেশে প্রতিবছর ৩ লাখ লোক ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে। কিডনি রোগে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ৩ লাখ। ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্তের সংখ্যা ১ লাখ ৫০ হাজার। এছাড়া গর্ভবতী মায়ের শারীরিক জটিলতাসহ গর্ভজাত বিকলাঙ্গ শিশুর সংখ্যা দেশে প্রায় ১৭ লাখ।
খাদ্যে ভেজাল এবং নকল ওষুধ প্রস্তুত দেশে প্রায় মহামারির আকার ধারণ করেছে। ঢাকা শহরের ৭০ শতাংশ এবং
গ্রামাঞ্চলে ৫০ শতাংশ খাদ্যে ভেজাল। রাষ্ট্রকে এখনই ভেজাল খাদ্য এবং নকল ওষুধের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে আগামীতে এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করা দুঃসাধ্য হয়ে পড়বে। খাদ্যে ভেজাল শুধু যে শারীরিক ক্ষতি তা নয়, খাদ্যে ভেজালের কারণে জাতীয় উন্নতিও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। খাদ্যে ভেজাল হত্যা অপরাধের শামিল। ভেজাল ওষুধ তৈরি করা এবং মেয়াদোত্তীর্ণ বিক্রি করাও হত্যার শামিল অপরাধ। ভেজাল এবং মেয়াদোত্তীর্ণের পর কোনো ওষুধ আর ওষুধ থাকে না । তা হয়ে যায় বিষ। কোনোভাবেই এগুলোকে আশ্রয়-প্রশয় দেওয়া যাবে না। ভেজালকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর এবং সোচ্চার হতে হবে। নিরাপদ খাদ্য এবং ওষুধের জন্য জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করতে হবে। ভেজালকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান সবসময় চলমান রাখতে হবে। একটি সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। ভেজালকারী যতই ক্ষমতাধর হোক না, তার পরিচয় সে একজন ভেজালকারী। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কাছে সে কিছুই নয়। কেউ ভেজালকারীদের পক্ষে অবস্থান নিলে, তাকেও আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে।
ভেজালকারীদের সংখ্যা বেশি নয় । হাতেগোনা হবে হয়তো। কিন্তু এর ভুক্তভোগী ১৭ কোটি মানুষ এবং অনাগত ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। যাদের নিরাপদ রাখার দায়িত্ব আমাদের। খাদ্যে ভেজাল এবং বিষ মিশিয়ে অগণিত মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে প্রতিদিন। খাদ্যে ভেজাল মেশানোর অপরাধে ভারতে যাবজ্জীবন এবং চীনে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে। আমাদের দেশেও ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের ২৫(গ) এর ১(ঙ) ধারায় খাদ্যে এবং ওষুধে ভেজাল মেশালে বা বিক্রি করলে অপরাধী ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন বা ১৪ বছর কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হবে বলে বিধান রয়েছে। তবু কেন যেন আইনের প্রয়োগ নেই। মাঝে মধ্যে ভেজালকারীদের বিরুদ্ধে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে জরিমানা করা হলেও তারা আবার নতুন উৎসাহে ভেজালের মহোৎসব চালায়। যে সকল কোমল পানীয় কিডনি, লিভার, ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়, সেই সকল কোমল পানীয় নিষিদ্ধ করতে হবে । এক মাসের মধ্যে তাদের অভিযোগ নিষ্পত্তি করে জামিন অযোগ্য এবং সাধারণ ক্ষমার অযোগ্য ঘোষণা করে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিধান করতে হবে। আইনের যথাযথ প্রয়োগ করা হলে নিশ্চিতে আমরা বিশুদ্ধ, নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্য নিশ্চিৎ করতে পারব। খাদ্যের নিরাপত্তা, জীবনের নিরাপত্তার জন্য এবং জাতীয় স্বাস্থ্য নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজনে নতুন আইন প্রণয়ন এবং প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। আগামীর সুস্থ ও সুন্দর জাতি গঠনের জন্য বিশুদ্ধ, নিরাপদ, পুষ্টিকর খাদ্য ও পানি নিশ্চিত করতে হবে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
লেখক : শিক্ষক
পথরেখা/এআর