পথরেখা অনলাইন : প্রতি বছর ৩১ ডিসেম্বরের রাত ১২টায় ঘড়ির ঘণ্টা মনে করিয়ে দেয় আমরা নতুন আরেকটি বছরে পদার্পণ করেছি। তাই বিদায় জানাতে হয় ২০২৪ খ্রিস্টাব্দকে। হারিয়ে গেছে আমাদের জীবনের আরও একটি অধ্যায়। ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজজীবনে একটি নতুন বছরের আগমনে যেমন আনন্দ ও উদ্দীপনার জোয়ার বয়ে যায়, তেমনি বিদায়ী বছরের স্মৃতি আমাদের মনে এক ধরনের শূন্যতার অনুভূতি জাগায়।
অসংখ্য ঘটনা ও মুহূর্ত নিয়ে আমরা বিগত ২০২৪ সাল শেষ করেছি। বহমান নদীর মতো বলুন আর ঘড়ির কাঁটার ন্যায়, বছরটি তার আপন গতিতে শেষ হয়েছে। শেষ প্রান্তে এসে নিয়মমাফিক আমাদের আত্ম-জিজ্ঞাসায় নিমগ্ন হওয়ার সময়। সারা বছর আমরা যেসব অর্জন করেছি সেগুলো স্মরণ করা, ভুল ও বিভ্রান্তিগুলো থেকে শিক্ষা নেওয়া ইত্যাদি। নতুন বছর মানে শুধু ক্যালেন্ডার পরিবর্তন নয়, ব্যক্তিগত পুনর্মূল্যায়ন করার সময়। কোথায় ছিলাম এবং আমরা কোথায় যেতে চাই তা পুনরায় ভাবনার কেন্দ্রে নিয়ে আসার সময়।
২০২৪ সাল বাংলাদেশের ইতিহাসে অমলিন হয়ে থাকবে। বছরটি শুরু হয়েছে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন দিয়ে আর শেষে হয়েছে ছাত্র-জনতার সফল গণঅভ্যুত্থানে। পুরো বছরজুড়ে ছিল নির্বাচন, কোটা আন্দোলন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, আবু সাঈদ হত্যাকা-, এক দফা দাবির আন্দোলন (প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ), সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেশত্যাগ, নোবেলজয়ী ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারের শপথ গ্রহণ এবং দেশ সংস্কারের কার্যক্রম। এমন ঘটনাবহুল বছরের কালেভদ্রে দেখা মেলে।
এছাড়াও ২০২৪ সালÑবছরজুড়েই বন্যা, সাইক্লোন, ঘূর্ণিঝড়, তাপপ্রবাহ ও প্রবল বৃষ্টিপাতের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্মুখীন হয়েছিল দেশের মানুষ। পুরো বছরজুড়েই মানুষকে ভোগায় তাপপ্রবাহ। তাপপ্রবাহে তৈরি হয় দুর্যোগকালীন পরিস্থিতি। দেশবাসী দেখেছে সিলেটে নজিরবিহীন শিলাবৃষ্টি। উপকূলে চোখ রাঙিয়েছে সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড় ‘রেমাল’ ও ‘দানা’। দফায় দফায় বন্যায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে দেশ। স্মরণকালের প্রলয়ঙ্করী বন্যায় আক্রান্ত হয় ফেনী, নোয়াখালী ও ময়মনসিংহ। ঘূর্ণিঝড়, তাপপ্রবাহ ও দফায় দফায় বন্যায় বিপর্যস্ত হয় কোটি কোটি মানুষ। বিপুল পরিমাণে ক্ষতিগ্রস্ত হয় দেশের অর্থনীতি।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের দিকে তাকালেও দেখা যায় ২০২৪ সালের পুরো বছরজুড়ে ছিল অস্থিরতা। পুরো সময়জুড়ে ছিল নির্বাচন, যুদ্ধ ও মুদ্রাস্ফীতি। য্ক্তুরাষ্ট্র, ফ্রান্স, জার্মানি, রাশিয়া, জাপান ও ভারতের নির্বাচন পুরো বিশ্বের নজর কেড়েছিল। এছাড়াও রাশিয়া ও ইউক্রেনের চলমান যুদ্ধের বৃদ্ধি ও মধ্যপ্রাচ্যের চলমান অস্থিরতার ফলে বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতি-মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয়। যদিও অনেকে মনে করছেন এবার যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার ফলে চলমান যুদ্ধগুলোর অবসান ঘটতে পারে। কিন্তু ট্রাম্পের জন্য ইতোমধ্যে চীনের সঙ্গে ওয়াশিংটনের বাণিজ্যিক টানাপোড়েন শুরু হয়েছে।
আমাদের জীবনে অন্য বছরের ন্যায় বিদায়ী বছরেও অনেক আনন্দ, চ্যালেঞ্জ ও সমৃদ্ধি ছিল। অনেকের জন্য বছরটিতে ঘটেছিল অপ্রত্যাশিত কিছু ঘটনা কিংবা কারও কারও জীবনে ছিল ব্যক্তিগত মাইলফলক। তাই আসুন সমাজ ও রাষ্ট্রের ভাবনার বাইরে থেকে একটু নিজের মধ্যে নিমগ্ন হই। নিজেকে সময় দেই। রাজনৈতিক, আন্তর্জাতিক ও অন্য বিষয় থেকে সরে এসে নিজেকে কিছু প্রশ্ন করি, গত বছরের ব্যক্তিজীবনে সবচেয়ে বড় অর্জন কি ছিল! একক কিংবা কারও সঙ্গে মানবকল্যাণে কিছু করেছি কি না! এমনো হতে পারে বিগত বছরে আমরা অনেক বড় বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেছি।
সেখান থেকে যে শিক্ষা নিয়েছি তা কীভাবে অন্য কাজে প্রয়োগ করতে পারি সেটা চিন্তা করার সময় এসেছে। ছোট কিংবা বড় ব্যক্তিগত অর্জনগুলোর জন্য উদ্্যাপন করা উচিত আর ভুলগুলো থেকে শিক্ষা নেওয়ার প্রকৃত সময় এটি। এজন্য আমাদের উচিত নতুন বছরের জন্য কিছু পদক্ষেপ নেওয়া, যা আত্মগঠনে সহায়তা করবে। ব্যক্তি পর্যায়ে এই চর্চা অব্যাহত রাখলে সবাই মিলে সুন্দর একটি পৃথিবী গড়তে পারব। প্রতিটি নতুন বছর নতুন একটি সুযোগ হিসেবে নেওয়া উচিত।
নিজের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের যতেœর প্রতিশ্রুতি দিয়ে শুরু হোক বছরের প্রথম দিন। এর মধ্যে থাকতে পারে নিয়মিত শরীরচর্চা, মননশীলতা অনুশীলন ও পর্যাপ্ত পরিমাণ বিশ্রাম নিশ্চিত করা। মনে রাখবেন, আত্ম-যতœ স্বার্থপর নয়, ভারসাম্য এবং স্থিতিস্থাপকতা বজায় রাখার জন্য এটি অপরিহার্য। সেইসঙ্গে সংকল্প নেওয়া যেতে পারে নতুন কিছু করার। পেশাদার দক্ষতার পাশাপাশি সৃজনশীল কিংবা শখের কোনো কিছুর ওপর গভীরভাবে ডুব দেওয়া যেতে পারে।
এতে করে আমরা যত বেশি নতুন কিছু শিখব, তত বেশি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি প্রসারিত হবে। এছাড়াও সম্পর্ক মজবুতকরণে চেষ্টা করতে পারেন নতুন বছরে। পরিবার, বন্ধুবান্ধব এবং সহকর্মীদের সঙ্গে মানসম্পন্ন সময় কাটানোর মধ্য দিয়ে অনেক অসম্পূর্ণ কাজ সম্পন্ন করতে পারি। অন্যের কথা শোনা ও অগ্রাধিকার দেওয়ার মধ্য দিয়ে শুরু করা যেতে পারে নতুন বছর। সেইসঙ্গে নিজের কিছু ভালো অভ্যাস তৈরির ক্ষেত্রেও মনোনিবেশ করা যেতে পারে ব্যক্তিত্ব গড়ের তোলার জন্য।
ছোট কোনো কিছু দিয়ে শুরু করা যেতে পারে। ধীরে ধীরে চ্যালেঞ্জ নেওয়া শিখতে হবে। নিজের কমফোর্ট জোন থেকে বের হয়ে আসতে হবে। এক্ষেত্রে অনেক বাধার সম্মুখীন হতে হবে। আর এর জন্য নিজের মধ্যে প্রচুর পরিমাণে আত্মবিশ্বাস সঞ্চয় করতে হবে। চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার আরেকটি উত্তম পন্থা হলো আপনি অতীতের বাধা কিংবা ভুলগুলো থেকে যা শিখেছেন তা প্রয়োগ করা।
এবারের নতুন বছরের যাত্রা যেন ব্যক্তিগত বিকাশের একটি যাত্রা হয়, গন্তব্য নয়। এই যাত্রায় অনেক বাধা-বিপত্তি আসবে। সেক্ষেত্রে থেমে গেলে হবে না। নিজের মধ্যকার শক্তিগুলোকে জাগ্রত করা ও অনুভব করতে নিজেকে সময় দিন। এতে করে অনেক সমস্যার সমাধান নিজের ভেতর থেকেই বের হয়ে আসবে।
২০২৫ সাল আমাদের সবার জন্য সম্ভাবনাপূর্ণ হয়ে উঠুক। সকলের জীবনে বয়ে আনুক সমৃদ্ধি, শান্তি ও আনন্দ। সামনের দিনগুলোতে প্রত্যেককে সেরা সংস্করণ হয়ে উঠতে হবে। একটি সুন্দর, সমৃদ্ধিশালী ও সম্প্রীতির বাংলাদেশ গড়ে উঠুক। দেশের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সংকট দূর হোক, সারা বিশ্বে শান্তি প্রবহমান হোক।
লেখক : গণমাধ্যমকর্মী
পথরেখা/এআর