• শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪
    ৬ আশ্বিন ১৪৩১
    ঢাকা সময়: ০৯:২২

খাদ্যনিরাপত্তায়‘জেনেটিক গেইন’

দেশকণ্ঠ প্রতিবেদন : বাংলাদেশে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে, সেইসাথে বৈচিত্র্যময় পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারে এমন উন্নত ও উচ্চ ফলনশীল ধানের জাত উদ্ভাবনে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে আসছেন বিজ্ঞানীরা। তার সর্বশেষ সংস্করণ হল: ‘জেনেটিক গেইন’। খবর বিবিসি’র।
 
বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তাদের মতে, একটি নির্দিষ্ট সময়ে কোনো ফসলের বৈশিষ্ট্যের উন্নয়ন ঘটানো, সেইসাথে নির্দিষ্ট শতাংশ বেশি উৎপাদন হওয়াকে ‘জেনেটিক গেইন’ বলা হয়। এই প্রক্রিয়ায় ধানের এমন সব জাত উদ্ভাবন করা হচ্ছে, যেগুলো অল্প সময়ে বেশি বেশি উৎপাদন করতে সক্ষম। একইসাথে ধানের মানেরও উন্নয়ন ঘটবে। এখানে মান বলতে মূলত ‘ধানের সুগন্ধ, চকচকে, দেখতে চিকন ও আকর্ষণীয়’ হবে বলে গবেষকরা জানিয়েছেন। এরইমধ্যে এই আধুনিক জাতের ধান দিয়ে ফলন শুরু হয়েছে, সেইসাথে গবেষণাও অব্যাহত রয়েছে।
 
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউট এখন পর্যন্ত ১১৩টি উচ্চ-ফলনশীল আধুনিক ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে। এরমধ্যে ৮টি হাইব্রিড জাতের। প্রতিটি জাতই কোনো না কোনো বৈশিষ্ট্যে অনন্য। তবে বর্তমানে প্রচলিত বেশির ভাগ জনপ্রিয় ধানের জাতের বয়স ২৮-৩০ বছর ছাড়িয়ে গিয়েছে। এগুলোকে অনেক সময় ‘বুড়ো’ ধানও বলা হয়। এসব ধানের ফলন সময়ের সাথে সাথে কমে আসতে শুরু করেছে। এই সময়ের মধ্যে আরো অনেক নতুন জাত উদ্ভাবন হলেও, সেগুলো আগের জনপ্রিয় জাতগুলোকে প্রতিস্থাপন করতে পারেনি। ফলে খাদ্য নিরাপত্তা টেকসই করার ক্ষেত্রে অনেক চ্যালেঞ্জের মুখে ছিল বাংলাদেশ। তবে ‘জেনেটিক গেইন’ সেই লক্ষ্য অর্জনের পথে বাংলাদেশকে এগিয়ে নেবে বলে আশা করছে গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো।
 
ধান গবেষণা ইন্সটিটিউটের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মোহাম্মদ খালেকুজ্জামান জানান, প্রচলিত ধানের জাত যদি প্রতি হেক্টরে দেড় টন উৎপাদন হয়, সেখানে জেনেটিক গেইন প্রযুক্তির কারণে হেক্টর প্রতি দুই মন ধান উৎপাদন সক্ষম। ফলে জেনেটিক গেইনের মাধ্যমে বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা মেটানো এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব বলে জানিয়েছেন গবেষকরা। ধান গবেষণা ইন্সটিটিউটের তথ্যমতে, ২০২১-২২ অর্থ বছরে প্রায় চার কোটি টন ধান উৎপাদন করা হয়েছে। সরকার ২০৩০ সাল নাগাদ এই ফলনের লক্ষ্যমাত্রা ছয় কোটি টনে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে।
 
সেইসাথে ২০৫০ সালের মধ্যে ধানের উৎপাদন ২৫% বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউটের একদল গবেষক ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে কীভাবে ধানের উৎপাদন বাড়ানো যায় তার একটি কৌশলগত গবেষণাপত্র উপস্থাপন করেন। গবেষণায় ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের আনুমানিক জনসংখ্যা হিসাব করে, চাষযোগ্য জমির পরিমাণ, বার্ষিক ধানের উৎপাদন বৃদ্ধি ও জলবায়ুর অবস্থা মূল্যায়ন করা হয়। সেখানে গবেষকরা বলেছেন, জেনেটিক গেইন বৃদ্ধি, অনাবাদী জমি চাষ, কৃষি যান্ত্রিকীকরণ ও ফসলের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করে প্রধান এই খাদ্যদ্রব্যের উৎপাদন বৃদ্ধি করা হবে। সব ধরনের পরিবেশগত প্রতিকূলতা বিবেচনা করে গবেষকরা ২০৩০ সালের মধ্যে প্রতি হেক্টর জমিতে নয় দশমিক ছয় টন বোরো, খরা-প্রবণ এলাকায় প্রতি হেক্টরে ৬ দশমিক দুই, বন্যা-প্রবণ এলাকায় সাত দশমিক তিন ও লবণাক্ততার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় আট দশমিক এক টন ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছেন।
 
সরকারের মূল লক্ষ্য ধানের উৎপাদন বাড়ানো হলেও আরেকটি লক্ষ্য কৃষির বাণিজ্যিকরণা। এক্ষেত্রে উচ্চ ফলনশীল ধানের পাশাপাশি প্রিমিয়াম কোয়ালিটি বা উচ্চমানের ধান উৎপাদনেও জোর দেয়া হচ্ছে। যে ধানের বাজারদর বেশি সেটিই উচ্চমানের ধান। এটি সুগন্ধযুক্ত, চিকন ও চকচকে হতে পারে। ধান গবেষণা ইন্সটিটিউটের খন্দকার মো. ইফতেখারুদ্দৌলা বলেছেন, “মানুষ যখন থেকে ধান চাষ শুরু করেছে তখন থেকেই তারা ধানের ফলন বাড়ানোর চেষ্টা করেছে। সময়ের সাথে সাথে নতুন নতুন প্রযুক্তির সমন্বয় হয়েছে। এভাবে উচ্চ ফলনশীল জাত উদ্ভাবনের পাশাপাশি, মানের দিকেও নজর দেয়া হচ্ছে। ধানের পপুলেশন ইমপ্রুভমেন্ট এবং সাইক্লিং ব্রিডিংয়ের মাধ্যমে ধানকে মানসম্মত করা হচ্ছে।”
 
প্রচলিত ধানগুলোর ফলন কমে যাওয়ার পেছনে ধানের চারা কখন রোপণ করা হচ্ছে, ভূ-প্রকৃতি আবহাওয়া কেমন, ধানের জেনেটিক বৈশিষ্ট্যে কোন পরিবর্তন আসছে কি না – এমন আরও নানা বিষয় নির্ভর করে। মো. ইফতেখারুদ্দৌলা জানান, ধান একটি স্বপরাগায়িত ফসল। এর ফলে উৎপাদনে কোনো পরিবর্তন ঘটে না। তবে পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ধানের রোগবালাইয়ের ধরণ, পোকামাকড়ের বায়োটাইপ প্রতিনিয়ত বদলে যাচ্ছে। এমন আরও নানা কারণে বর্তমানে প্রচলিত জাতগুলোর উৎপাদন আগের চাইতে কমে গিয়েছে বলে তিনি জানান। এ কারণে ধানের প্রচলিত এই জাতগুলোকে অনেকেই ‘ধানের বুড়ো হয়ে যাওয়া’ বলে আখ্যা দিচ্ছেন। এছাড়া সময় মতো ধান রোপণ না করার একটা প্রভাবও এর উৎপাদনে গিয়ে পড়ে।
 
বাংলাদেশে ভোজ্য-তেলের মোট চাহিদার একটি বড় অংশ আমদানি করতে হয়। সেই আমদানিতে লাগাম দিতে এখন দেশের ভেতরেই তেলবীজের উৎপাদন বাড়ানোর হয়েছে। এসব তেলবীজের চাষের মৌসুম হল, আমন ধানের ফলন শেষে ও বোরোর চারা রোপণের মাঝামাঝি সময়ে। এতে বোরো ধান রোপণের সময় পিছিয়ে যাচ্ছে- বলছেন উদ্ভিদ প্রজনন বিজ্ঞানী মো. ইফতেখারুদ্দৌলা। ফসলের ক্যালেন্ডার অনুযায়ী, ধানের সর্বোচ্চ ফলন পেতে বছরের ৩১ জানুয়ারির আগে সব বোরো ধান রোপণ করে ফেলতে হয়। কিন্তু কোথাও কোথাও এখনো বোরো ধান রোপণ করা হচ্ছে বলে তিনি দেখেছেন। অথচ নির্ধারিত সময়ের একদিন দেরিতে ধান রোপণ করলে প্রতি হেক্টরে ৮০ কেজি ফলন কমে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই ফলনের সাথে জাতের যেমন সম্পর্ক আছে, সেই সাথে এর ব্যবস্থাপনারও বড় ধরনের প্রভাব রয়েছে বলে তিনি জানান। আবার মাটি ও আবহাওয়ায় ওপরেও নির্ভর করে কোন জাতের ধান থেকে কি পরিমাণ ফলন হবে। এখানে কৃষকের চাহিদা ও বাজারের চাহিদার কথাও মাথায় রাখতে হয়।
 
আগামী দিনের ধানের জাতে জেনেটিক গেইন বা জিনগত ফলন অনেক বেশি হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এ কারণে ধানের উৎপাদনশীলতা যেমন বাড়বে, তেমনি ধানের নতুন জাত উদ্ভাবনের সময়কাল চার থেকে পাঁচ বছর কমিয়ে আনা সম্ভব হবে, বলছেন বলছেন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তারা। ফলে আগে যেখানে ধানের একটি জাত উদ্ভাবনে ১০-১৫ বছর লেগে যেত এখন তা ৮-১০ বছরে সম্পন্ন করা যাবে। আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইন্সটিটিউটের (ইরি) কারিগরি সহায়তায় এবং বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের (বিএমজিএফ) অর্থায়নে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউট (ব্রি) জেনেটিক গেইনের এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। তারা মূলত স্বল্প সময়ে ধানের জাত উদ্ভাবন, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিরূপ পরিস্থিতিতে উন্নত জাতের ধান নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন।
 
বাংলাদেশের গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো, ধান উৎপাদন বা জেনেটিক গেইন বাড়ানোর জন্য ধানের প্রজনন চক্রের সময়কাল সংক্ষিপ্ত করা, প্রজনন লাইন নির্বাচন নির্ভুল করা, প্রজনন তথ্য ব্যবস্থাপনার আধুনিক কৌশল ব্যবহার এবং ব্যাপকভাবে সরেজমিন মাঠ গবেষণা করে নানা ধরনের জাত উদ্ভাবন করছে। এক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিচ্ছে আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইন্সটিটিউট। বর্তমানে বাংলাদেশ ধান উৎপাদনে বিশ্বে তৃতীয় স্থানে রয়েছে।
দেশকণ্ঠ/রাসু
 

  মন্তব্য করুন
আরও সংবাদ
×

পথরেখা : আমাদের কথা

আমাদের পোর্টালের নাম— pathorekha.com; পথরোখা একটি অনলাইন নিউজ পোর্টাল। আমরা এই প্রতিষ্ঠানকে প্রতিদিনের সত্য-সংবাদের পথরেখা হিসেবে প্রমাণ করতে চাই। পথরেখা সারাদেশের পাঠকদের জন্য সঠিক ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ এবং মতামত প্রকাশ করবে। পথরোখা নিউজ পোর্টাল হিসেবে ২০২৩ সালের জুন মাসে যাত্রা শুরু করলো। অচিরেই পথরেখা অনলাইন মিডিয়া হিসেবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ে নিবন্ধনের প্রক্রিয়া শুরু করবে। পথরোখা  দেশ কমিউনিকেশনস-এর অঙ্গ প্রতিষ্ঠান।
 
পথরোখা জাতীয় সংবাদের উপর তো বটেই এর সঙ্গে রাজনীতি, আন্তর্জাতিক, খেলাধুলা, কৃষি, বিনোদন, অর্থনীতি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, তথ্য ও প্রযুক্তিসহ বিভিন্ন বিভাগকেও গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করে। মাল্টিমিডিয়া সাংবাদিকতা এবং চৌকস ফটোগ্রাফিকে বিশেষ বিবেচনায় রাখে।
 
পথরোখা’র সম্পাদক আরিফ সোহেল এই সেক্টরে একজন খুব পরিচিত ব্যক্তিত্ব। সাংবাদিক হিসেবে তার দীর্ঘ ৩০ বছর কর্মজীবনে তিনি দৈনিক বাংলাবাজার পত্রিকা, আজকের কাগজ, রিপোর্ট২৪ ডটকম প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন। এ ছাড়া তিনি সরকারী ক্রীড়া পাক্ষিক ‘ক্রীড়া জগত’ ও লাইফস্টাইল ম্যাগাজিক অপ্সরা নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন। তিনি জনপ্রিয় অনলাইন দেশকণ্ঠের নির্বাহী সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।
 
পথরেখা দেশের মৌলিক মূল্যবোধ, বিশেষ করে জাতীয় সার্বভৌমত্ব, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ। এছাড়াও, এটি দেশের নাগরিকের মানবিক ও নাগরিক অধিকারের পক্ষে কথা বলবে। ন্যায়পরায়ণতা, নির্ভুলতা এবং বস্তুনিষ্ঠতা বজায় রাখতে আমরা অঙ্গীকারাবদ্ধ। আমরা বিশ্বাস করি যে জনগণের বিশ্বাসযোগ্যতা আমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। পথরেখা রাজনৈতিক ইস্যুতে নির্দলীয় অবস্থান বজায় রাখবে। একটি নিরপক্ষ অনলাইন হিসেবে আমরা নিজেদের কর্মকাণ্ডে প্রমাণ করার শতভাগ প্রছেষ্টা করব। তবে সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করেও কিছু ভুল হতেই পারে। যা ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রাখছি সব মহলেই। সততা পথে অবিচল; আলোর পথে অবিরাম যাত্রায় আমাদের পাশে থাকুন; আমরা থাকব আপনাদের পাশে।
 
উল্লেখ্য, পথরেখা হিসেবে একটি প্রকাশনী দীর্ঘদিন থেকে প্রকাশিত হয়ে আসছে। এবার উদ্যোগ নেওয়া হলো অনলাইন অনলাইন নিউজ পোর্টাল হিসেবে প্রকাশ করার।