মুম রহমান, পথরেখা অনলাইন : ভিলকমেন হের কাফকা।
: ডাঙ্কে শোয়া হের মুম। হাস্টু ডু ডয়েচে গেলার্নট।
: উম ডিচ যু ফেরস্টেহেন।
এই সময়ই আমার পাছায় একটা বাড়ি পড়ল। বাড়িটা পাছাতেই পড়ার কথা। কারণ আমি পাছা উপুড় করেই পড়ে আছি। ক’ঘণ্টা, ক’দিন জানি না। আমি কাফকার জগতে ঢুকে পড়েছি। কে বা কারা যেন আমাকে ধরে নিয়ে এসেছে। একটা লেমন ললি আইসক্রিম কিনে আমি ফিরছিলাম; পকেটে দু’হাজার সাতশ টাকা। তিন হাজার টাকা একটা লেখার বিল ছিল, সরকার তিনশ টাকা কেটে রেখেছে আর দশ টাকার স্ট্যাম্প কিনতে হয়েছে। আর আমার মানিব্যাগে ছিল আরো চারশ টাকা।
মানিব্যাগে তিন হাজার টাকা জমা হওয়ার খুশিতেই আমি ললি আইসক্রিম কিনে ফেলি। ললি আইসক্রিমগুলো অদ্ভুত, দারুণ! মিষ্টি, ঠান্ডা, আবার অনেকক্ষণ চাটা যায়, চোষা যায়, দাঁত, জিভ খানিকটা সবুজ হয়ে যায়। এর স্বাদ আর দীর্ঘসূত্রিতা বেশ। একটা ললি আইসক্রিমের প্যাকেট খুলে সবুজ লম্বা শীতল মিষ্টতা আমার মুখে নিলাম। দু’বার, তিনবার অথবার চারবার মুখ ভর্তি করে স্বাদটা যেতে না-যেতেই হুট করে একটা মাইক্রোবাস এলো; সিনেমার মতো— ক্র্যাচ-ঘোৎচ শব্দ হলো টায়ারের। কে বা কারা আমাকে টান দিয়ে তুলে নিলো মাইক্রোবাসে। আমি কিছু বুঝে উঠবার আগেই আমার মুখটা একটা বড় কালো কাপড় দিয়ে ঢেকে দেয়া হলো। সেইসঙ্গে পেছনের সিট থেকে, পাশের সিট থেকে ধুমধাম চড়, কিল, ঘুষি ছুটে এসে পড়তে লাগল ঘাড়ে, মাথায়, পিঠে, পেটে। সুখের কথা হলো, আমি দ্রুত জ্ঞান হারালাম। ফলে আর ব্যথা বোধ রইলো না।
যখন আমার জ্ঞান ফিরল তখন আমি একটা ঘুটঘুটে অন্ধকার ঘরে নিজেকে আবিষ্কার করলাম। গ্রিগর সামশার মতো আমিও একটা পোকার মতো পড়ে রইলাম। নিজের হাত-পা কোনোমতে নাড়াতে পারছি। কিন্তু আমার ভুড়িঅলা পেট, পৃথুলা পাছা মেঝে থেকে নড়ছে না। আর আমার চিন্তা হতে থাকল— ঈদ সংখ্যায় একটা উপন্যাস দেয়ার কথা। আর দু’টো দিন লিখলেই উপন্যাসটা শেষ হয়ে যেত। আর দু’টো দিন লিখলেই আট হাজার টাকা পাওয়া যেত।
আমি জমজমাট একটা উপন্যাস লিখছিলাম এবার। এটা একটা থ্রিলার। এখন থ্রিলারের খুব বাজারদর। প্রকাশকরা নগদ টাকা দিয়ে কিনে নেন। এর সঙ্গে যদি একটু মিথ-টিথ গেথে দেয়া যায় তবে সোনায় সোহাগা। আমি খুব কায়দা করে আমার উপন্যাসের চরিত্রের নাম রেখেছি ‘ঋষি’।
ঋষি আসলে যিশু থেকে অনুপ্রাণিত চরিত্র। ঋষি সোস্যাল ইনফ্লুয়েন্সার। তার দেড় লাখ ফলোয়ার আছে। ঋষি নতুন সব কথা বলে। আজকের দিনে এসে কেমন করে ধীর জীবনযাপন করা যায়, ডিজিটাল মিনিমাইলেজশন করা যায়— এসব বলে। এই ঋষিকে তার প্রিয়তম শিষ্য হত্যা করে। তখন ঋষির ভক্তরা বলে, ঋষি মরেনি। ঋষি জীবিত এবং শীঘ্রই তাকে আবার দেখা যাবে; নতুন নতুন কনটেন্ট নিয়ে। ঋষির অনুসারীরা ক্রমে ঋষি ধর্মের প্রচার-প্রসার বাড়াতে থাকে। ‘হ্যাশট্যাগ ঋষি’ খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠে টিকটক, ইন্সটা আর ফেইসবুকেও। আমার কেবল ঋষির পুনরুত্থানের অংশটা লেখা বাকী। এটুকু লেখা হয়ে গেলে আমার দ্বিতীয় উপন্যাস সমাপ্ত। উপন্যাস লেখা খুব গুরুত্বপূর্ণ এবং শেষ করা আরো গুরুত্বপূর্ণ। আফসোস, কাফকা তার গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস শেষ করতে পারেনি। সেটার গুরুত্বও সে বোঝেনি। এমনকি বন্ধু যোশেফ ব্রডকে বলেছিল তার সব লেখা পুড়িয়ে ফেলতে। মৃত্যুর কয়েক সপ্তাহ আগেই বলেছিল। ভাগ্যিস, ব্রড তার বন্ধুর কথা শোনেনি।
কিন্তু আমার কথা কে শুনবে? হ্যালো, কেউ শুনছেন, এক্সকিউজ মি। একটু পানি খাওয়াবেন।
না, কেউ আমার কথা শোনেনি। আমি অনেক ডাকাডাকি করলাম। তারপর নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলাম। মাথা ঠান্ডা করতে হবে। খুঁজে বের করতে হবে, কে বা কারা আমাকে এখানে তুলে এনেছে? আমি কার কী ক্ষতি করেছি? অহেতুক নিশ্চয়ই আমাকে তুলে আনেনি। আমি গুরুত্বপূর্ণ কোনো লেখক নই। আজ পর্যন্ত কোনো পুরস্কার পাইনি। কিছু কবিতা লিখেছি। পয়সার জন্য গত বছর থেকে গল্প, উপন্যাস লিখছি। সেগুলোও তেমন গুরুত্বপূর্ণ পত্র-পত্রিকায় ছাপা হয়নি। আর ছাপা হলেও কিছু যায় আসে না। আমি খুব নিরীহ লেখক। অধিকাংশ সময়ই প্রেমের গল্প কিংবা এই গোয়েন্দা কাহিনী লেখার চেষ্টা করি। একটা ভূতের উপন্যাসের কথাও ভাবছি। কিন্তু সেই আমাকে কে বা কারা কেন তুলে আনবে! লেখালেখির জন্য আনেনি। আনলে ভালো হতো, বিখ্যাত হতে পারতাম। বিখ্যাত হওয়াটা খুব দরকার। যত লাইক, যত শেয়ার, তত ডলার— এখনকার যুগে লেখকদের জন্যও এ কথা সত্য। কিন্তু আমি নিশ্চিত আমাকে লেখালেখির জন্য তুলে আনেনি। জায়গা-জমি, সেটা তো নেই। আমি একটা মেসে থাকি। আরো চারজনের সঙ্গে ঘর শেয়ার করি। তাহলে ভুল করে তুলে এনেছে? শত্রুতা করেছে কেউ? কিন্তু আমার মতো তিন-চার হাজার টাকার লেখকের সাথে শত্রুতাই করবে কে?
হ্যালো, এক্সিউজ মি, কেউ আছেন, একটু পানি খাওয়াবেন।
না, কেউ নেই। আমার মোবাইল ফোনটাও হাতের কাছে নেই। নইলে একটা স্ট্যাটাস দেয়া যেতো। কিংবা জার্মান ভাষাটা প্রাকটিস করা যেত। আমি ৩৪২ দিন হলো ডুয়োলিঙ্গতে ডয়েচ ভাষা শিখছি। দিনে তিরিশ মিনিট। সকাল, সন্ধ্যা মিলিয়ে ১৫ মিনিট করে তিরিশ মিনিট। কোনো কোনো দিন কম-বেশি হয়। আমার টার্গেট ৩৬৫ দিন পূর্ণ করা। সেটাও হবে না। ফোনটা তো ওরা নিয়ে নিয়েছে। ৩৪২ দিনের ধারাবাহিকতা শেষ হয়ে গেল। কিন্তু এ সব কী ভাবছি আমি?
আমার নিজের কথা ভাবা উচিত। এখান থেকে কীভাবে উদ্ধার পাব, সেটা নিয়ে ভাবা উচিত। মুশকিল হলো ওরা আমাকে এখানে ফেলে রেখে চলে গেছে। ওরা কারা? এই জায়গাটা কোথায় তাও জানি না। কেউ এখন পর্যন্ত আমার সাথে কথা বলেনি। ক্ষুধা লেগেছে, তার চেয়ে বেশি তৃষ্ণা পেয়েছে, তার চেয়ে বেশি করে অনিশ্চয়তা আর একাকীত্ব ভর করেছে আমার উপর। আমি কী করবো?
মনে মনে কাফকাকে ডাকি আমি। ডয়েচ ভাষায় তার সাথে কথাবার্তা শুরু করি।
: ভিলকমেন হের কাফকা। (স্বাগতম জনাব কাফকা)
: ডাঙ্কে শোয়া হের মুম। হাস্টু ডু ডয়েচে গেলার্নট। (ধন্যবাদ জনাব মুম। আপনি কি ডয়েচ ভাষা শিখেছেন)
: উম ডিচ যু ফেরস্টেহেন। (আপনাকে বোঝার জন্য চেষ্টা করছি)
এটুকু কথাবার্তাতেই; আগেই বলেছি, আমার পাছায় বাড়ি পড়ল। পুলিশের মোটা বেতের বাড়ি। পুলিশ নাকি অন্য কেউ? আমি জানি না। খুব বেশি না, দশ-পনেরোটা বাড়ি দিল। তারপর বলল, একটা শব্দ করবি না। চুপচাপ থাক। কথা বললেই মাইর হবে।
এ কোন জগতে আমি এলাম, যেখানে কথা বললেই মার খেতে হবে? আচ্ছা মনে মনে যদি বলি, তাহলেও কি মারবে? আমি মনে মনে কাফকার সঙ্গে কথা বলা শুরু করি। খুব বেশি জার্মান আমি বলতে শিখিনি। অসুবিধা কী? কথা তো মনে মনেই হচ্ছে, তাই আমি বাংলাতেই কথা বলা শুরু করি। কাফকাও কি করে যেন বাংলাতেই উত্তর দিতে থাকে।
: ক্ষমা করবেন হের কাফকা, আমি এখনও খুব ভালো করে ডয়েচ ভাষাটা আয়ত্ব করতে পারিনি।
: আমরা মাতৃভাষাটাই তো আয়ত্ব করতে পারি না অনেকেই।
: আপনি আমার ডাকে সাড়া দেয়ায় আমি খুব খুশি হয়েছি। কাফায়েস্ক কী তা যদি আপনি আমাকে একটু বুঝিয়ে দিতেন তবে খুব উপকৃত হতাম।
: এটা আমি নিজেও জানি না। আমি যখন লিখেছি তখন তো এতো কিছু ভাবিনি। আদতে আমি তো ঠিকঠাক করে লিখিইনি। তুমি তো জানো, বাবা পছন্দ করত না। প্রেমিকারাও পাত্তা দেয়নি। আমি ব্রডকে বলেছিলাম, পুড়িয়ে ফেলো আমার লেখাগুলো। এখন অসমাপ্ত এসব লেখা-টেখা নিয়ে লোকে কতো কী বলছে!
: আপনি বিংশ শতকের সবচেয়ে প্রভাব বিস্তারী লেখক। আপনি জানেন, আপনার সব গল্প আমাদের বাংলাভাষায় অনূদিত হয়েছে।
: কেমন হয়েছে?
: আমার পছন্দ হয়নি। আমি সেইজন্যই জার্মানটা শিখতে চাচ্ছি।
: আমি জানি। তোমার ধৈর্য অনেক। তুমি টানা ৩৪২ দিন চর্চা করছো। নিশ্চয়ই তুমি একদিন মূল ডয়েচ ভাষায় আমাকে পড়তে পারবে।
: পড়তে তো পারবো, বুঝতে কি পারবো?
: আমি তো দুর্বোধ্য নই।
: না, সমালোচকরা বলে, আপনি বেশ কঠিন। মানে এই কাফায়েস্ক ব্যাপারটা।
: হয়তো তোমার বর্তমান পরিস্থিতি তোমাকে কাফায়েস্ক বুঝতে সহায়তা করবে।
: তাহলে কী এই পরিস্থিতি আপনি সৃষ্টি করেছেন? হের কাফকা, আমি কি আপনার সৃষ্ট কোনো চরিত্র?
: না, মুম রহমান। তুমি অন্য কারো সৃষ্ট চরিত্র। তবে হয়তো তোমার মধ্যে আমার প্রভাব তীব্র।
: আচ্ছা হের কাফকা, আমাকে বলে দিন, আমি কী করব?
: আমার বলা কথা তো কেউ শোনেনি, শুনবে না।
: আমি শুনবো, বলুন।
: অপেক্ষা করো হের মুম, দীর্ঘ অপেক্ষা কখনো জট লাগায়, কখনো জট খুলে দেয়। দেখো তোমার ক্ষেত্রে কী ঘটে? আমি আসি?
: কিন্তু... আরেকটু থাকুন... আপনার সঙ্গে কথা বললে আমার ব্যথা বোধ কম হয়।
: হের মুম, আমার শততম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। নানা জায়গা থেকে আমাকে ডাকাডাকি হচ্ছে। দু’য়েক জায়গায় তো হাজির হতেই হবে। তোমার মতো তো অনেকেই বিপদে পড়েই আমাকে ডাকছে।
: শুভ মৃত্যুবার্ষিকী হের কাফকা।
: এটা ভালো বলেছ মুম। জন্ম ব্যাপারটা কখনোই আমাকে টানেনি। জন্ম ক্ষণস্থায়ী এবং একঘেয়ে। মৃত্যু রহস্যময়, দীর্ঘতর। ভালো থেকো মুম, গুটেন টাগ।
: গুটেন টাগ হের কাফকা।
কাফকা চলে গেলেন। আমাকে ভালো থাকতে বলে গেলেন। তিনি বড় লেখক। এতো বড় লেখক তো সাধকও বটে। তিনি যখন ভালো থাকতে বলেছেন নিশ্চয়ই তার মধ্যে কোনো ইশারা আছে। আমি অধম মুম রহমান অবশ্য বুঝতে পারছি না, কী করে ভালো থাকব আমি?
পথরেখা/এআর