মারুফ কামরুল, পথরেখা অনলাইন : কাজী নজরুল ইসলাম কেবলই আমাদের জাতীয় কবি হিসেবে স্মরণীয়, বিষয়টা এমন নয়। তিনি যেন সংকটের ব্যবস্থাপত্র পাঠ করে শোনান তার বাঁশিতে। তিনি এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশি আর অন্য হাতে রণতূর্য নিয়ে আগমন করেছেন। সে আগমনী গানে আজ মানুষ খুঁজে পায় সংকটকালে আশার আলো।
আমাদের বর্ণপরিচয়ের পাঠ থেকে শুরু করে তুমুল যৌবনের নানা সংকটে নজরুলের উপস্থিতি অপরিহার্য হয়ে উঠে। আমাদের শৈশবের স্মৃতিতে গেঁথে থাকা সেই ‘আমি হব সকাল বেলার পাখি’ আজও কি চমৎকার সুর হয়ে বাজে। নজরুল এ কবিতা দিয়ে আমাদের শৈশবের নরম মনে জুড়ে দিয়েছিলেন এক আশ্চর্য আলোর খোঁজ। তিনি কবিতায় বলেছিলেন-
‘আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে?
তোমার ছেলে উঠলে গো মা রাত পোহাবে তবে!’
শৈশবে এ কবিতা কিংবা ছড়া সুর করে ছন্দে ছন্দে পড়লেও জীবনের নানান সময় এসে এ কবিতার শব্দগুলোর অর্থ বদলাতে থাকে। ছোটবেলার সে রাতের আঁধার কেবল রাতের আঁধারই ছিল। যে আঁধার থেকে মুক্তি পেতে হলে সেই শিশু আমাকে জাগতে হবে। কিন্তু জীবনের বাঁক বদলে, নানান সংকটে এবং ঘোর অন্ধকারের বিপরীতে জেগে ওঠার যে তাড়না নজরুল শৈশবে আমাদের মননে গেঁথে দিয়েছিলেন, সে তাড়া আজও যাপিত জীবনে সংকটের ব্যবস্থাপত্র হয়ে ওঠে।
নজরুল তার কবিতায় আলো পেড়ে আনার প্রাথমিক যে পাঠ শিশু-কিশোরবেলায় দিয়েছিলেন, সে পাঠের পূর্ণতা পায় যেন তার বিদ্রোহী কবিতায়। এ কবিতায় নজরুল দেখিয়েছেন আসলে আমাদের কতটা জাগতে হবে, কতটুকু হবে সে স্পর্ধা! সে স্পর্ধা এতো তীব্র ও দীর্ঘ হবে যে, ভগবান বুকে পদচিহ্ন এঁকে দিতে পারার মতো দুঃসাহসিক।
তবে আঁধারের বুক ছিঁড়ে আলো ফোটাবার এ বেলায় এসে নজরুল গেয়েছেন প্রেমের গান। সে প্রেম মানবীয় থেকে শুরু করে নির্যাতিতের ক্ষতচিহ্ন পর্যন্ত বিস্তৃত। সে প্রেম পেতে ও দিতেই নজরুলের আগমন মূলত। তবে এ প্রেমের স্রোতে কেউ বাধা হয়ে দাঁড়ালে তার বিরুদ্ধে চলে নজরুলের বিদ্রোহ। সেটা নজরুলের বিদ্রোহী কবিতায় স্পষ্ট লক্ষ্য করা যায়। কবি বলেছেন-
‘আমি ইন্দ্রাণী-সুত হাতে চাঁদ ভালে সূর্য
মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর রণ-তূর্য;’
কবি প্রেমের জন্য বাঁশি বাজান, ঘোর অন্ধকার তাড়িয়ে আলো আনতে সুর তোলেন বাঁশিতে। ব্যক্তি থেকে রাষ্ট্র, সব সংকটের বিপরীতে তার এ প্রেম ঝর্ণা বিলানো বাঁশি বেজে চলে। তবে বাঁশিতে, সুরে, প্রেমে, কিংবা আলোতে বাধা হলে তার জন্য রয়েছে রণতূর্য।
তবে সংকট মোকাবিলায় এ বাঁধভাঙা জোয়ার, এ তাজা সূর্যের মতো স্পর্ধা তখন হবে, যখন কেউ তার নিজেকে চিনতে পারে। বুঝতে পারে তার অন্তর্গত মানুষটাকে। কবি বিদ্রোহী কবিতায় সে বিষয়েও বলেছেন।
‘আমি উন্মাদ, আমি উন্মাদ!
আমি চিনেছি আমারে, আজিকে আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ!’
সংকটের অন্ধকার মুছে দিতে দরকার উন্মাদনা আর সে উন্মাদনা তখনই আসবে যখন আপনাকে চেনা যায়, আত্মানুসন্ধানে বেরিয়ে আসে সে বিস্ময়কর আলো। তবে সে পথ মোটেও মসৃণ নয়। সে পথ জাহান্নামের মতো ভয়াবহ আগুনে ঠাসা। কবি বিদ্রোহী কবিতায় বলেছেন-
‘আমি ছিন্নমস্তা চণ্ডী, আমি রণদা সর্বনাশী,
আমি জাহান্নামের আগুনে বসিয়া হাসি পুষ্পের হাসি!’
তবে এ সর্বনাশী ঝড় কী বয়ে যাবে! সে বিস্ময়ের উত্তরও আছে বিদ্রোহী কবিতায়। কবি বলেছেন-
‘মহা-বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত,
যবে উত্পীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না–
অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না –
বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত।’
যেতে যেতে কবি রেখে গেছেন সংকট মোকাবিলার এক অমূল্য পাঠ। তরুণদের কানে মন্ত্রের মতো পাঠ করলেন, উত্পীড়িতের ক্রন্দন-রোল ও অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ রুখে দেয়ার আগ পর্যন্ত এ বিদ্রোহ চলবে। বাঁশির সুর বাঁচিয়ে রাখতে রণ-তূর্য চলবে তার গতিতে।
পথরেখা/এআর