• বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৪
    ২৯ কার্তিক ১৪৩১
    ঢাকা সময়: ১৫:১৮

...কারণ মার্ক্সিস্টরা তো নোবেল পান না

  • মত-দ্বিমত       
  • ১৯ অক্টোবর, ২০২৪       
  • ২০
  •       
  • ১৯-১০-২০২৪, ২২:৪৩:২৮

সিদ্দিকী নুর বাপ্পী, পথরেখা অনলাই : অর্থনীতিবিদ, এই পেশাটাকে যিনি অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন তিনি কখনো নোবেল পাননি। না, অ্যাডাম স্মিথের কথা বলছি না। অ্যাডাম স্মিথ পারতপক্ষে অর্থনীতি শাস্ত্রের জনক, তবে তাঁর আগেও বেশ কয়েকজন অর্থনীতি নিয়ে বিস্তর কাজ করে গেছেন। তাদের গল্প আরেকদিন বলা যাবে।

অর্থনৈতিক খবরের সাবস্ক্রিপশন


আধুনিক অর্থনীতিতে তর্কসাপেক্ষে সেরা ব্যক্তিটি লর্ড জন মেইনার্ড কেইন্স। ১৯৩৬ সালে তিনি তাঁর ম্যাগনাম ওপাস এবং অর্থনীতি শাস্ত্রের অন্যতম প্রভাবশালী বই ‘দ্য জেনারেল থিওরি অফ এমপ্লয়মেন্ট, ইন্টারেস্ট এন্ড মানি’ লিখেছিলেন। কেইন্স এবং কেইন্সের বই অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে অনেকেরই। লর্ড কেইন্স কখনো নোবেলের জন্যে মনোনীত হননি। ম্যাগনাম অপাস লেখার মাত্র ১০ বছরের মধ্যেই, ১৯৪৬ সালে তিনি মারা যান।

অর্থনীতিতে নোবেল দেয়া শুরু হয়েছে ১৯৬৯ সালে। সেবার এই মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার  পেয়েছিলেন হান টিনবার্জেন আর র‍্যাগনার ফ্রিশচ। ম্যাক্রোইকোনমিক মডেলিং-এ অবদানের জন্যে তাঁদের নোবেল দেওয়া হয়েছিল সেবার। এখন পর্যন্ত ৫৪ জনকে অর্থনীতিতে অবদান রাখায় নোবেল দেওয়া হয়েছে। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, অর্থনীতির খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশের অর্থনীতিবিদেরা এখন পর্যন্ত নোবেল হাতে নিতে পারেননি।

রোজা লুক্সেমবার্গরোজা লুক্সেমবার্গ

অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব রেখেছেন কার্ল মার্ক্স। কেইন্সের মতো তিনিও নন্দিত, নিন্দিত। তাঁর বিশেষায়িত অর্থনীতির গোত্রভুক্ত কাউকেই নোবেলের জন্যে মনোনীত করা হয়নি। বলা হয়ে থাকে অর্থনীতিতে নোবেল পাওয়ার জন্যে যে ধরনের গবেষণার দরকার তেমন গবেষণা তাদের ছিল না বা নেই। তবে ব্যাপারটা এত সরল নয়। কতটুকু গবেষণায় নোবেল মিলে সেই আলোচনা নিয়েও আছে তর্কবিতর্ক।

অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর করার সময়ে একজন শিক্ষকের কথা শুনে নতুন করে অর্থনীতির প্রেমে পড়ি। স্নাতকে টিএসসিতে কার্ড বা টেবিল টেনিস খেলাই বেশি টানত। আপাতদৃষ্টিতে ‘রসকষহীন’ অর্থনীতি যে কতটা ‘আবেদনময়ী’ হতে পারে তা বুঝতে পেরেছিলাম স্নাতকের পর। আমার ওই শিক্ষক ক্লাসে প্রায়ই রোজা লুক্সেমবার্গ নামের এক নারীর কথা বলতেন। রোজা লুক্সেমবার্গের বেশ কিছু পরিচয় আছে। যার মধ্যে শুধু ‘নারী অর্থনীতিবিদ’ অংশটা নিয়েই আপাতত বলা যাক।

অর্থনীতিতে প্রথম নারী হিসেবে নোবেল পান এলিনর অস্ট্রম, সেটিও ২০০৯ সালে। অর্থাৎ, অর্থনীতিতে নোবেল দেওয়া শুরু হওয়ার ৪০ বছর পর। এরপর ইস্টার ডাফ্লো এবং সর্বশেষ ২০২৩ সালে নোবেল পান ক্লদিয়া গোল্ডিন। অর্থনীতিতে এই তিন নারীর অবদান নিয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই, কিন্তু ‘অর্থনীতিতে নোবেল’ ও ‘নারী’ যখন একসঙ্গে উচ্চারিত হয়, তখন আমার মনে সবার আগে নাম আসে জোয়েন রবিনসনের।

অর্থনীতিতে রবিনসনের অবদান কোন কোন ক্ষেত্রে আছে, সে আলোচনায় একদম পুথিগত আলোচনায় যেতে গেলে অনেক দীর্ঘ হয়ে যাবে এই লেখা। আপাতত সে দিকে না যাই, অর্থনীতির কোর বা মূল আলোচনার একটি হচ্ছে মার্কেট মানে বাজার সংক্রান্ত আলোচনা। সেখান থেকে শুরু করে রবিনসন বিস্তর লিখেছেন ইকোনমিক গ্রোথ নিয়েও। অর্থনীতির ফিলোসোফিকাল অংশের প্রণেতা হিসেবেও তাঁর নামই আসে সবার আগে। জোয়েন রবিনসন কখনো অর্থনীতিতে নোবেল পাননি। জীবদ্দশায় তাঁর শেষ বছরগুলোতে প্রতিবার নোবেল ঘোষণার সময় এলেই সবাই ভাবতেন, এইবার, এইবার হয়তো রবিনসন পেতে যাচ্ছেন। কিন্তু সে ঘোষণা কখনো আসেনি।

Paul-Sweezyপল সুইজি (ডানে)

কেন আসেনি, এই প্রশ্নের উত্তর যদি এক শব্দে বলতে হয়- ‘মার্ক্সিস্ট।’ শুরুতেই বলেছি এখন পর্যন্ত কোনো মার্ক্স-এর গোত্রভুক্ত কেউ অর্থনীতিতে নোবেল পাননি। রবিনসনকে তাঁর ভিন্ন মতধারার সহকর্মীরা একটা সময় ডাকতেন সিনোফাইল বলে। চীনের প্রতি দুর্বলতা থাকলে এই নামে ডাকা হয়।

এছাড়া তাঁর আরেকটা দুর্নাম ছিল, অর্থনীতিতে গাণিতিক অংশের ব্যাপক ব্যবহার অপছন্দ করতেন তিনি। এ কারণে কোয়ান্টিটিভ বিশ্লেষণে তিনি যেতেন না। ক্কিন্তু এর একটি যুক্তিও নোবেল না পাওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়।
 
পল সুইজি ও পিয়েরো স্রফা; বেশ নামকরা দুজন অর্থনীতিবিদ। নোবেল না পাওয়া ছাড়াও এ দুজনের মধ্যে আরেকটি মিল আছে- দুজনই বামপন্থী। সুইজির অর্থনীতির মৌলিক তত্ত্ব নিয়ে সরাসরি অবদান রয়েছে। বিশেষ করে অলিগোপলিতে (কয়েকজন বিক্রেতার বাজার নিয়ন্ত্রণ) কিংকড ডিমান্ড কার্ভ দিয়ে তিনি দেখিয়েছেন বাজার নিয়ে কয়েকজন বিক্রেতার সাইকোলজিকাল যুদ্ধও।

১৮৯৮ সালে ইতালির তুরিন শহরে জন্ম নেয়া বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ পিয়েরো স্রফা অর্থনীতি শাস্ত্রে ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিলেন ক্লাসিক্যাল রূপ। স্রফা পুরোপুরি মার্ক্সবাদী অর্থনীতিবিদ ছিলেন না। তিনি ক্লাসিক্যাল ধারার সাথে মার্ক্সিজিমের মিশ্রণ করতে চেয়েছেন বলেও শোনা যায়। উৎপাদন তত্ত্ব এবং সেখানে পণ্যের ভূমিকা নিয়েই স্রফার মূল অবদান অর্থশাস্ত্রে।

নোবেলের যোগ্য?
হয়তো, হয়তোবা না।

কেন পাননি?
মূলধারার অর্থনীতির সঙ্গে স্রফা যায় না, এমনটাই বলেছে নোবেল কর্তৃপক্ষ। ‘আইডিওলজিকাল বায়াসনেস,’ সুইজি কিংবা স্রফা, তাঁদের বাদ দেওয়ার এটাও ‘ম্যাক্রো’ কারণ বৈকি!

joan-robinsonজোয়েন রবিনসন

মউরিচ ডব, ডেভিড হার্ভি, রিচার্ড উলফ, মারিয়ানা মাজ্জুকাতো, ডায়ান এলসন; মার্ক্সিস্ট অর্থনীতিবিদ যাদের নোবেলের যোগ্য বলে ধরা হলেও কখনো তাদের হাতে এই বিশেষ সম্মাননা উঠেনি।

গতবছর নোবেল পাওয়া ক্লদিয়া গোল্ডিনের ভূমিকা ছিল নারীদের আয় ও লেবার মার্কেট নিয়ে। ফেমিনিস্ট ইকোনমিস্ট হিসেবে বেশ সুনাম রয়েছে তাঁর। যার স্বীকৃতিই নোবেল পুরস্কার। ফেমিনিস্ট অর্থনীতিবিদের আলোচনায় নাম আসতে বাধ্য রোজা লুক্সেমবার্গের। নোবেল পুরস্কার প্রবর্তনের বহু আগেই মারা গিয়েছেন এই পোলিশ-জার্মান বিদ্বান। কিন্তু ক্লদিয়া গোল্ডিন-ইস্টার ডাফ্লোদের মতো নোবেল তিনি কখনোই পেতেন না। জোয়েন রবিনসনের ক্ষেত্রেও একই কথা বলা যায়।

বর্তমান অর্থনীতিবিদদের মধ্যে বেশ পরিচিত নাম থমাস পিকেটি। এই ফ্রেঞ্চ অর্থনীতিবিদ সম্পদ, আয় এবং আয় বৈষম্য নিয়েই মূলত কথা বলেন। ২০১৩ সালে পিকেটির লেখা বই ‘ক্যাপিটাল ইন দ্যা টুয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি’ বেশ হইচই সৃষ্টি করে। আঠারো শতকের শুরু থেকে ইউরোপ এবং আমেরিকায় সম্পদের বৈষম্য নিয়ে লেখা বইটি। অনেকেই বইটি কার্ল মার্ক্সের ডাস ক্যাপিটাল সঙ্গে তুলনা করেন, আবার এটাও বলা হয় বইটি মার্ক্সের বইয়েরই আধুনিক ভার্সন।

piero-sraffaপিয়েরো স্রফা

পিকেটিকে অনেকেই মার্ক্সিস্ট বলে ডাকেন। কিন্তু পারতপক্ষে পিকেটি কখনো মার্ক্সিস্ট বা নন-মার্ক্সিস্ট হিসেবে নিজের অবস্থান জানাননি। মার্ক্স ও পিকেটির মধ্যে বেশ মিল রয়েছে। দুজনেই ক্যাপিটালিজিমের সমালোচনা করেছেন। দুজনই সমান গুরুত্ব দিয়েছেন আয়বৈষম্যে। এদিক থেকে পিকেটিকে মার্ক্সিস্ট বলতেই পারি। যদিও ক্যাপিটালিজিমের ভবিষ্যৎ নিয়ে পিকেটি মার্ক্সের মতন কঠোর হননি। অর্থাৎ মার্ক্সের উলটো পথেও হেঁটেছেন।

আইডিওলজিকাল বায়াস, মূলধারার বিপরীত পন্থা, গবেষণার অভাব এসব যুক্তি দিয়ে মার্ক্সিস্ট অর্থনীতিবিদদের নোবেল না দেওয়াটা যথেষ্ট দৃষ্টিকটু, অন্যায়ও বটে। বিংশ শতকে কিছু মার্ক্সপন্থা অবলম্বনকারী অর্থনীতির ব্যর্থতাও হয়তোবা এর কারণ হতে পারে।

মার্ক্সিস্ট অর্থনীতিবিদেরা এখনো নোবেল পাননি। থমাস পিকেটি হয়তোবা এই ট্রেন্ড ভেঙে দিতে পারেন। তবে তার জন্যে অপেক্ষার প্রহর গুনতে হবে হয়তো আরো অনেক বছর। তখন হয়তো দেখা যাবে নোবেল পেলেও পিকেটির মার্ক্সিস্ট আইডিওলজিটা আড়ালে রয়ে যাবে, কারণ মার্ক্সিস্টরা তো নোবেল পান না!

আজ ২০২৪ সালের জন্যে অর্থনীতিতে নোবেল বিজয়ীর নাম ঘোষণা করা হবে। ভবিষ্যদ্বাণী করে দিচ্ছি এবারও জিতবে না মার্ক্স গোত্রের কোনো অর্থনীতিবিদ।

কারণ? এতক্ষণে তো জানা হয়েই গেছে!!

[এই মতামত লেখকের নিজস্ব। এর সঙ্গে ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের প্রাতিষ্ঠানিক সম্পাদকীয় নীতিমালার কোনো সম্পর্ক নেই।]
পথরেখা/এআর

  মন্তব্য করুন
আরও সংবাদ
×

পথরেখা : আমাদের কথা

আমাদের পোর্টালের নাম— pathorekha.com; পথরোখা একটি অনলাইন নিউজ পোর্টাল। আমরা এই প্রতিষ্ঠানকে প্রতিদিনের সত্য-সংবাদের পথরেখা হিসেবে প্রমাণ করতে চাই। পথরেখা সারাদেশের পাঠকদের জন্য সঠিক ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ এবং মতামত প্রকাশ করবে। পথরোখা নিউজ পোর্টাল হিসেবে ২০২৩ সালের জুন মাসে যাত্রা শুরু করলো। অচিরেই পথরেখা অনলাইন মিডিয়া হিসেবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ে নিবন্ধনের প্রক্রিয়া শুরু করবে। পথরোখা  দেশ কমিউনিকেশনস-এর অঙ্গ প্রতিষ্ঠান।
 
পথরোখা জাতীয় সংবাদের উপর তো বটেই এর সঙ্গে রাজনীতি, আন্তর্জাতিক, খেলাধুলা, কৃষি, বিনোদন, অর্থনীতি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, তথ্য ও প্রযুক্তিসহ বিভিন্ন বিভাগকেও গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করে। মাল্টিমিডিয়া সাংবাদিকতা এবং চৌকস ফটোগ্রাফিকে বিশেষ বিবেচনায় রাখে।
 
পথরোখা’র সম্পাদক আরিফ সোহেল এই সেক্টরে একজন খুব পরিচিত ব্যক্তিত্ব। সাংবাদিক হিসেবে তার দীর্ঘ ৩০ বছর কর্মজীবনে তিনি দৈনিক বাংলাবাজার পত্রিকা, আজকের কাগজ, রিপোর্ট২৪ ডটকম প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন। এ ছাড়া তিনি সরকারী ক্রীড়া পাক্ষিক ‘ক্রীড়া জগত’ ও লাইফস্টাইল ম্যাগাজিক অপ্সরা নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন। তিনি জনপ্রিয় অনলাইন দেশকণ্ঠের নির্বাহী সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।
 
পথরেখা দেশের মৌলিক মূল্যবোধ, বিশেষ করে জাতীয় সার্বভৌমত্ব, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ। এছাড়াও, এটি দেশের নাগরিকের মানবিক ও নাগরিক অধিকারের পক্ষে কথা বলবে। ন্যায়পরায়ণতা, নির্ভুলতা এবং বস্তুনিষ্ঠতা বজায় রাখতে আমরা অঙ্গীকারাবদ্ধ। আমরা বিশ্বাস করি যে জনগণের বিশ্বাসযোগ্যতা আমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। পথরেখা রাজনৈতিক ইস্যুতে নির্দলীয় অবস্থান বজায় রাখবে। একটি নিরপক্ষ অনলাইন হিসেবে আমরা নিজেদের কর্মকাণ্ডে প্রমাণ করার শতভাগ প্রছেষ্টা করব। তবে সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করেও কিছু ভুল হতেই পারে। যা ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রাখছি সব মহলেই। সততা পথে অবিচল; আলোর পথে অবিরাম যাত্রায় আমাদের পাশে থাকুন; আমরা থাকব আপনাদের পাশে।
 
উল্লেখ্য, পথরেখা হিসেবে একটি প্রকাশনী দীর্ঘদিন থেকে প্রকাশিত হয়ে আসছে। এবার উদ্যোগ নেওয়া হলো অনলাইন অনলাইন নিউজ পোর্টাল হিসেবে প্রকাশ করার।